যেভাবে ক্ষমতার সর্বচ্চোশিখরে পৌঁছেছেন ভ্লাদিমির পুতিন

বর্তমান বিশ্বেরর প্রেক্ষাপটে একজন সুদক্ষ এবং সুতীক্ষ্ণ মেধাশীলতার অধিকারী রাজনৈতিক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে ভ্লাদিমির পুতিন স্বীয়-মহিমায় সুপরিচিত। আজ আমরা জানব তার সংগ্রামপূর্ণ জীবনগাঁথা।

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন (জন্মঃ ৭ অক্টোবর, ১৯৫২) লেনিনগ্রাদের জন্মগ্রহণকারী রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ২য় মেয়াদে ৭ মে, ২০১২ তারিখ থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন। এর পূর্বে ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০০ ও ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনাইটেড রাশিয়া দলের সভাপতি এবং রাশিয়া ও বেলারুশের মন্ত্রীসভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৬০-১৯৬৮ সালের মধ্যে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি লেনিনগ্রাদে স্কুল নং-১৯৩ এ ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে অষ্টম গ্রেডের পর তিনি স্কুল নং-২৮১ তে হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭০ সালে পড়া শেষ করেন।১৯৭০ সালে পুতিন লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ সালে ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে পুতিন মস্কোর KGB স্কুল নং-১ এ পড়াশুনা করেন।

 

৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ সালে পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের আকস্মিকভাবে পদত্যাগ গ্রহণ করার প্রেক্ষাপটেই তাঁর এই দায়িত্বভার গ্রহণ। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতিনির্বাছন তিনি জয়লাভ করেন। ২০০৪ সালে পুতিন ২য় মেয়াদে পুণরায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর এ মেয়াদ শেষ হয় ৭ মে, ২০০৮ সালে। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে ৩য় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদের বিজয় লাভ করেন। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ রাশিয়ার  প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনকে মনোনীত করেন। অতঃপর ৮ মে, ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাপ্তরিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি ৩য় মেয়াদের জন্য নতুন করে ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি ৩য় মেয়াদে জয়লাভ করেন। তার এ মেয়াদকাল ৬ বছর।

পুতিন তাঁর সময়কালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন।এছাড়াও, তিনি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন চেচনিয়ায় ২য় চেচেন যুদ্ধের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলোর অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। পুতিনের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক মানদণ্ড ৯ বছরের মধ্যে জিডিপি ৭২% বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্যতা কমপক্ষে ৫০% কমে যায়। গড় মাসিক বেতন $৮০ থেকে $৬৪০ ডলার বৃদ্ধি পায়। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় পুতিন লভ্যাংশের উপর কর হ্রাসসহ ১৩% হারে আয়কর ধার্য্যের বিষয়ে আইন পাশ করেন। জ্বালানী নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার ফলে রাশিয়া জ্বালানী খাতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।বৃহৎ জ্বালানী প্রকল্প হিসেবে রাশিয়ার আনবিক শক্তিতে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও অনেকগুলো বৃহৎ রপ্তানী সহায়ক পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবহণ ব্যবস্থার অবকাঠামো নির্মাণেরও সূচনা হয়। তন্মধ্যে রয়েছে ইস্টার্ণ সাইবেরিয়া-প্যাসিফিক ওশেন অয়েল পাইপলাইন বা এসপো এবং নর্ড স্ট্রিম প্রকল্প অন্যতম।

পুতিনের রাষ্ট্রপতিত্ব নিয়ে পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ও দেশের অভ্যন্তরে বিরোধীরা তাকে অগণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করে।কিন্তু দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন ও স্থিতিশীলতা আনয়ণের প্রেক্ষাপটে রুশ সমাজব্যবস্থায় তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

লেনিনগ্রাদে অবস্থানকালীনযুবক বয়সে পুতিন বেশ কয়েকবার জুডো এবং স্যাম্বো (মার্শাল আর্ট) খেলার চ্যাম্পিয়ন  হয়েছিলেন। রাশিয়ার ক্রীড়া উন্নয়নেও তিনি প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। স্মর্তব্য যে, ২০১৪ সালে সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক রাশিয়ায় আয়োজনের লক্ষ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

৪ জুলাই, ২০০৭ সালে ভ্লাদিমির পুতিন পরিপূর্ণ ও স্বাভাবিকভাবে ইংরেজি ভাষা প্রয়োগ করে সোচি’র জন্য ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিক এবং ২০১৪ সালের শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকের জন্য সফলভাবে নিলাম ডাকে অংশ নেন। গুয়াতেমালা সিটিতে অনুষ্ঠিত ১১৯তম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অধিবেশনে তিনি যোগ দিয়ে এ সফলতা অর্জন করেন।এর মাধ্যমেই রাশিয়া প্রথমবারের মতো শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করতে সক্ষম হয়। ২০০৮ সালে কাজান শহরে ২০১৩ সালের অনুষ্ঠিতব্য ২৭তম গ্রীষ্মকালীন ইউনিভাসিয়েড প্রতিযোগিতা বা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যলয় ক্রিয়ার নিলামে জয়ী হয়। এ প্রতিযোগিতায় শহরটি স্পেনের ভিগো এবং দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাভূত করে স্বাগতিকের আয়োজকের মর্যাদা পায়। এছাড়াও, রাশিয়া ২০১৭ সালের ফিফা কনফেডারেশন্স কাপসহ প্রথমবারের মতো ২০১৮  সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পায়।

রুশভাষী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জার্মান ভাষাও কথা বলতে পারেন। বাড়ীতে তিনি ও তাঁর পরিবার জার্মান ভাষায় কথা বলে থাকেন। প্রেসিডেন্ট হবার পর জানা যায় যে, তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করছেন। তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি বুশ ও ইংরেজভাষীদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনার সময় তিনি এখনও অনুবাদকের সহায়তা গ্রহণ করে চলেছেন। পুতিনকে প্রকাশ্যে ইংরেজিতে প্রথমবারের মতো কথা বলতে দেখা যায় ২০০৩ সালে। তখন তিনি বাকিংহাম প্রাসাদে ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা এলিজাবেথ রোজ-লিওনের মৃত্যুতে ইংরেজিতে অল্প কিছু শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি সোচিতে  অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের নিলাম ডাকের অনুষ্ঠানে খুবই স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজি ভাষা প্রয়োগ করেন। গুয়াতেমালা সিটিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অধিবেশনে তাঁর এ ভূমিকা সকলকে আকৃষ্ট ও চমৎকৃত করেছিল।

পুতিন রুশ অর্থোডক্স গির্জার সদস্য। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত পুতিন ২৮ জুলাই, ১৯৮৩ তারিখে কালিনিনগ্রাদে জন্মগ্রহণকারী ও সাবেক বিমানবালা লিদমিলা স্রেবনেভাকে বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে মারিয়া পুতিনা ও ইয়েকাতেরিনা পুতিনা নামে দুই কন্যা রয়েছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত উভয়ে জার্মানিতে বসবাস করেন।

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই থাকে একটি অদ্যম-উচ্ছ্বাস, সে নিজে একটু চেস্টাতেই তার উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। ভ্লাদিমির পুতিন  সেরকমই একটি প্রজ্জলিত দীপশিখার নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *