বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করা বেশ দুঃসাধ্য। প্রতিনিয়ত আমরা এমন অনেক কাজই করি বা আমাদের এমন কিছু অভ্যাস রয়েছে যেগুলো বুদ্ধিমত্তার সাথে বেশ গভীর যোগাযোগ রাখে। বিজ্ঞান ইতোমধ্যে এরকম অনেক অভ্যাসের প্রমাণ দিয়েছে যেগুলো জানলে আপনি নিজেও চমকে উঠবেন। যে অভ্যাসগুলো প্রায়শই ভাবা হয় বদলে ফেলি সেগুলোর সঠিক পরিচর্যা এনে দিতে পারে অনেক সাফল্য।

১. অগোছালো পরিবেশ

শুনতে খুব অদ্ভুত শোনালেও এটি সত্য যে, আপনার এলোমেলো টেবিলটি কিন্তু আপনার বুদ্ধিমত্তার প্রকাশক। Cornell professor Robert J. Sternberg বলেছেন, বুদ্ধিমত্তা এমন একটি দক্ষতা যা অর্জন করতে হয় অভিজ্ঞতা, নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, বিমূর্ত ধারণাকে উপস্থাপন, একটি নতুন পরিবেশকে নিপূণভাবে মানিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। উপলব্ধি, শিক্ষা, স্মৃতিশক্তি, যুক্তি এবং সমস্যা সমাধানের এই দক্ষতা গুলো অর্জিত হয় বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। আপনার কিছু কিছু অভ্যাস প্রমাণ করে আপনি কতটুক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, যারা সবকিছু গুছিয়ে রাখে, যাদের সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে তারা হয়তো অনেক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। কিন্তু আসলে ব্যাপার টা হয়তো এরকম না।

The University of Minnesota এর এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, যারা অনেক বেশি গোছালো তার চেয়ে যারা অগোছালো তারা বেশি সৃজনশীল হয়। লেখক Kathleen Vohs, PhD বলেছেন অগোছালো পরিবেশ প্রথাগত ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে, যা প্রকাশ করতে পারে নতুন অর্ন্তদৃষ্টি। পরিপাটি পরিবেশ সাধারণত একটি দিককেই প্রকাশ করে। এরকম পরিবেশ চিন্তাশক্তি কে বিকশিত করতে দেয় না। বিজ্ঞানী Jonathan Wai বলেছেন, অগোছালো পরিবেশ সৃজনশীলতাকে বিকাশিত হতে দেয় না, বরং সৃজনশীলতা অগোছালো পরিবেশ তৈরি করে। আমাদের যেসব ভ্রান্ত ধারণা আছে অগোছালো পরিবেশকে নিয়ে, চাইলে এখনি বদলে নিতে পারি।

২. রাত জাগা 

সিনেমায় আমরা প্রায়ই দেখি, সৃজনশীল লোকজন রাতভর জেগে কাজ করে এবং এটি প্রায় তাদের জীবনে বাঁধাধরা নিয়মের মতোই। London School of Economics এবং Political Science এর একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, যারা রাতে দেরিতে ঘুমায় তাদের IQ প্রচন্ড শক্তিশালী হয়, কারণ আমাদের পূর্বপুরুষেরা রাতে ঘুমাতেন না শুধুমাত্র তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করার জন্য।এছাড়াও রাত জেগে যেকোনো নতুন ধারণা আবিস্কার করার উত্তম সময় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। Dr. Wai বলেছেন, প্রতিভাবান ব্যক্তিদের অনেকেই রাত জাগেন, কারণ কোনো ধরনের বাধা বা শব্দ ছাড়া,শান্ত পরিবেশে তারা চিন্তা এবং সমস্যা সমাধান করতে ভালোবাসেন। আপনি যদি রাতের পেঁচা হয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই সাত ঘন্টা ঘুম নিশ্চিত করবেন সুস্থ জীবন যাপনের জন্য।

Image Source: WordPress.com

৩. কারণ অকারণে শপথ নেওয়া 

সাধারণত ভাবা হয় যারা কথায় কথায় কসম কাটে, বা শপথ নেয় তাদের ভেতরে শিক্ষা এবং বুদ্ধিমত্তা নিম্নভাবে অবস্থান করছে। এটি ভাবা হয় কারণ কেউ যখন যৌক্তিক কিছু খুঁজে না পায় তখন তারা কসম দিয়ে ব্যাপারটির যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করে। শপথ এবং অভিশাপ বিদ্যার বিশেষজ্ঞ Timothy Jay এবং তার সহকর্মীদের একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, যাদের কথায় কথায় শপথ বা অভিশাপের অভ্যাস আছে তাদের শব্দভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ থাকে।

Medical Daily কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে Dr. Jay বলেছেন, নিষিদ্ধ এবং শপথ শব্দগুলো সাধারণত ইতিবাচক মৌখিক সাবলীলতা। অর্থাৎ এই ধরনের কথা একপ্রকার সাবলীল যোগাযোগের লক্ষণ। একটি শ্রেণী থেকে আপনি একটি শব্দ বলা মানে হলো ওই শ্রেণী থেকে আরো কিছু নতুন শব্দ আপনার শব্দভাণ্ডারে যোগ হবে। ভাষাগত দক্ষতা হচ্ছে উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষের বৈশিষ্ট্য। তাই চটপটে বুদ্ধিমান মানুষ অনেক বেশি শপথ বা অভিশাপের শব্দ জানেন। এসব শব্দ সাধারণত পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। Dr. Jay বলেছেন, এই ধরনের শব্দগুলো হলো আবেগময় দক্ষতা কখন, কিভাবে সেগুলোর ব্যবহার করে পরিবেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন।

৪. ঠান্ডা পানিতে গোসল

অনেকেই হয়তো শুনেছেন ঠান্ডা পানিতে গোসল করার অভ্যাসটি অনেক বেশি শক্তি যোগায় যেকোনো কাজের জন্য। Finland এর এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, শীতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তি দূর করে এবং আপনার মন এবং স্মৃতিশক্তিকে করে আরো প্রখর। আর এসব আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করবে। New York Times এর ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসলের এক প্রতিবেদন এ জানা গিয়েছে, নিজস্ব আরামের জায়গা থেকে বের হয়ে আসার অভ্যাসটি আপনার সারাদিনের কর্মদক্ষতাকে বাড়াবে কয়েকগুণ। অর্থাৎ আপনি হয়তো গরম পানি গোসল করতে পছন্দ করেন, কিন্তু ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার এই নতুন ঝুঁকি কিন্তু আপনার কর্মদক্ষতাকে বাড়াবে অনেকাংশেই।

৫. চিবানোর শব্দ 

আপনি হয়তো অপরের চিবানোর শব্দে বিরক্ত বোধ করতে পারেন অথবা অনেকেই আছে যাদের খাওয়ার সময় শব্দের কারণে খুব বেশি বিরক্ত বোধ করেন। Northwestern University এর গবেষণায় জানা গিয়েছে, যারা খাবার জোরে চিবিয়ে শব্দ করে খায় তাদের সৃজনশীল চেতনাবোধ অপ্রয়োজনীয় সংবেদনশীল ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করে।কাজেই যারা খাবার খাওয়ার সময় শব্দ করে খান তাদের ক্ষেত্রে এই শব্দ মস্তিষ্কে অপ্রয়োজনীয় ভাবনাগুলো দূরে সরিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখে।

৬. হিজিবিজি চিত্র আঁকা 

বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের আরেকটি প্রধান গুণ হচ্ছে তারা যখন যেমন অবসর পান যা ইচ্ছা তাই আঁকিবুঁকি করেন। কাজেই আপনি যদি অবসর কাটানোর জন্য ছবি আঁকতে ভালোবাসেন নিঃসন্দেহে আপনার মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়বে। The Doodle Revolution বইয়ের লেখক Sunni Brown এর মতে, হিজিবিজি চিত্র আঁকা একটি চিন্তা যন্ত্র যা প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের তথ্যগুলোকে সাজাতে এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। U.K এর এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, ছবি আঁকার সময় মানুষ ২৯ শতাংশ বেশি তথ্য স্বরণ করতে পারে। হিজিবিজি চিত্র আঁকা স্বরণ শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ধারণা এবং আবেগগুলোকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।

Image Source: WordPress.com

৭. নিজের সমালোচনা করা

আমরা মনে করি, যারা বুদ্ধিমান তারা নিজের ব্যাপারে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু সবক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যাপারটা এরকম না। ১৯৯৯ সালে ল্যান্ডমার্কে Cornell University র বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, বুদ্ধিহীন মানুষেরাই নিজের অযোগ্যতাগুলোকে বের করতে পারেন না। আর এতে নিজের প্রতি মূল্যায়নের জায়গাটি স্ফীত হয়ে যায়। Dunning তার Pacific Standard বইয়ে লিখেছেন, জেনে নিন আপনি কতটুক দক্ষ আর অদক্ষ। এতে আপনার কর্মদক্ষতা বাড়বে।

এ গবেষণায় আরো জানা গিয়েছে, উচ্চ উপযুক্ত মানুষ তার নিজস্ব ভুলগুলো সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। দক্ষ ব্যক্তিরা জানেন কোথায় কী ভুল হয়েছে, সেই ভুলগুলো থেকে কিভাবে শিক্ষা নিতে হবে। উচ্চ আত্মবিশ্বাসী না হয়ে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষগুলো আত্মসমালোচনা বেশি করেন, যাতে নিজেকে আরো বেশি দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

Image Source: WordPress.com

৮. দিবাস্বপ্ন 

University of California এর এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, যখন কাউকে কোনো বেশ বড় চাহিদা সম্পন্ন কাজ দেওয়া হয়, তখন সে যদি কিছুটা বিরতি নিয়ে ওই কাজের কোন দিকে চাহিদা নেই এরকম উদ্ভট ভাবনায় সময় ব্যয় করে তাহলে তার কাজটি অনেক বেশি কার্যকরী ফলাফল এনে দিবে। গবেষণায় আরো জানা গিয়েছে, মস্তিষ্ককে যখন অযৌক্তিক ভাবনার জন্য সময় দেওয়া হয়, তখন মস্তিষ্কের সমস্যা সমাধান এবং সৃজনশীল ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আরো এইজন্যই যখন আপনি দিবা স্বপ্ন দেখছেন বা উদ্ভট চিন্তায় মগ্ন আছেন আপনার অজান্তেই বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৯. নিজের সাথে কথা বলা 

আপনি ভাবতেই পারেন নিজের সাথে কথা বলা হয়তো মানসিক সমস্যার লক্ষণ। কিন্তু এই অভ্যাসটি আপনার চিন্তা, কল্পনাশক্তি এমনকি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। অনেক গবেষণায় ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, নিজের সাথে কথা বলা বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে সহায়ক।

যে অভ্যাস গুলোর জন্য নিজেকে মনে হতে পারে আপনি হয়তো সবার চেয়ে আলাদা আচরণ করছেন বা অনেকেই যে অভ্যাসগুলোর জন্য অনেকে সময় নানান কথার সম্মুখীন হয়েছেন, সেই অভ্যাসগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা জানিয়ে চমকে দিতে পারেন যে কাউকে।