গত কয়েক দশক ধরে পুরো পৃথিবী জুড়ে যে প্রক্রিয়াটি চলমান সেটি হলো নগরায়ন। ২০০৯ সাল থেকে চলমান জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে সারা পৃথিবী ব্যাপী প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ শহরমুখী হচ্ছে, যার প্রধান কারণ হিসেবে উন্নত জীবন ব্যবস্থা ও ভালো উপার্জনের সুযোগকে চিহ্নিত করা যায়। নগরায়ন অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি যেসব ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে বা করবে তা হলো জনসংখ্যার ঘনত্ব, সম্পদের বণ্টন, আবর্জনা অপসারণ পরিকাঠামোর উপর চাপ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও দূষণের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করণ ইত্যাদি। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্ভাবিত হয় টেকসই শহর ব্যবস্থার ধারণা।

টেকসই শহর ব্যবস্থা হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষ পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা পাবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন কোনোভাবে সুফল থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করবে। অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন হল আন্তঃপ্রজন্মগত সমতা। অন্যভাবে বলা যায় টেকসই উন্নয়ন হলো দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী উন্নয়ন যার সুফল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোগ করবে। বর্তমানের টেকসই শহর ব্যবস্থাকে একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যেতে পারে।

ধরা যাক, একটি আপেল গাছে অনেক আপেল ধরেছে। এখন কেউ যদি আপেল নিতে চায় সে দুটি কাজ করতে পারে। এক,  সে এক বা একাধিক আপেল পেড়ে নিতে পারে অথবা পুরো আপেল গাছটা কেটে সব আপেল একসাথে নিয়ে নিতে পারে। এতে যা হবে, সে পরবর্তীতে আর আপেল পাবে না, সেই সাথে তার পরবর্তী প্রজন্মও আপেল থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুযোগগুলোর পরিকল্পনা মাফিক ব্যাবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তা নিশ্চিত করার ধারণা বাস্তবায়ন করাই হল টেকসই শহর ব্যাবস্থার কিংবা টেকসই উন্নয়নের মূল ধারণা।

ছবিসূত্র: itu.int

আর্কেডিস একটি শীর্ষস্থানীয় পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান যারা পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসৃষ্ট সম্পদের পরিকল্পনা্র ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাদের মতে একটি টেকসই শহর ব্যবস্থা তিনটি মূল বিষয়ের উপর নির্ভর করে।

মানুষ

এখানে স্বাস্থ্য (গড়আয়ু, চিকিৎসার মান), শিক্ষা ( সাক্ষরতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ), আয়ের সমতা, একে অন্যের উপর নির্ভরযোগ্যতার হার, অপরাধ, কাজ ও জীবনের ভারসাম্য, গৃহায়ণ খরচ, মোট কথা জীবন মানের উপর আলোকপাত করে।

পৃথিবী

এখানে খনিজ সম্পদ ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের হার, মোট আয়তনে সবুজের পরিমাণ, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, গ্রিণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি, খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, বায়ু দূষণ ইত্যাদির উপর আলোকপাত করা হয়।

মুনাফা

এখানে অর্থনৈতিক উন্নতি তথা ব্যবসার সহজ সুযোগ, যাতায়াত অবকাঠামো, জিডিপি, পর্যটন, বৈশ্বিক ব্যবসা শহরের প্রশাসনিক গুরুত্ব, মোবাইল যোগাযোগ, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারের সুযোগ, কাজের সুযোগ ইত্যাদির উপর আলোকপাত করা হয়। শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়নের ফলে সামগ্রিকভাবে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা মোকাবেলা করার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ টেকসই শহর ব্যবস্থার ধারণা সাদরে গ্রহণ করেছে এবং করবে। ধারণা করা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর প্রায় ৭০% মানুষ এমন টেকসই শহর ব্যবস্থায় জীবনযাপন করবে।

ছবিসূত্র: greenmatch.co.uk

যে শহরগুলো উপরোক্ত তিনটি মূল বিষয় অনুসরণ করে টেকসই শহর ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ৪০টি দেশের অবস্থান নিম্নে মানচিত্রে দেখান হলো।

শীর্ষ ১০ শহর

ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় টেকসই শহর ব্যবস্থার বিকল্প নেই বললেই চলে। এই টেকসই শহর ব্যবস্থা থেকে আরো একধাপ এগিয়ে এই ব্যবস্থার সব মূল বিষয় মেনে যে ধা্রণা মানুষকে আরো উন্নত জীবনযাত্রার হাতছানি দিচ্ছে তা হলো, স্মার্ট সিটির ধা্রণা। এবার জেনে নেওয়া যাক স্মার্ট সিটি বলতে আমরা কী বুঝি। স্মার্ট সিটি বলতে আমরা এমন একটি শহর ব্যবস্থা বুঝি, যে ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনযাত্রার মানকে আরো উন্নত করবে এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও সেবা ত্বরান্বিত করবে, আজকের এবং আগামী প্রজন্মের পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা নিশ্চিত করবে।

ছবিসূত্র: greenmatch.co.uk

এখন শহরের একটি সকালের দৃশ্য কল্পনা করা যাক, যেখানে পুরো শহরের মানুষ বেরিয়ে পড়েছে  তাদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য। যাদের ব্যক্তিগত যানবাহন আছে তারা তাদের যানবাহন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, আর যাদের ব্যক্তিগত যানবাহন নেই তারা গণপরিবহন ব্যবহার করছে। উভয় শ্রেণীই একটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তা হলো যানজট। যাদের ব্যক্তিগত যানবাহন আছে তারা গণপরিবহণে চলাচলের ঝামেলা না পোহালেও, বাড়তি ঝামেলায় পড়ছেন তাদের গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল পার্ক করা নিয়ে।

এখানেও তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় ব্যয় হচ্ছে, সাথে ভোগান্তি তো আছেই। এই সময়ের অপচয় যদি অর্ধেকে কমিয়ে আনা যায় এবং মানুষের ভোগান্তি দূর করা যায়, তাহলে মানুষের জীবনযাত্রা আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে, আরো ত্বরান্বিত হবে। এভাবেই আসে স্মার্ট সিটির ধারণা। এই ধারণা প্রথমে বাস্তবায়ন করে যুক্তরাজ্যের শহরগুলো। এদের মধ্যে শীর্ষ  ১৭টি শহরকে নিম্নের মানচিত্রে দেখানো হলো।

ছবিসূত্র : greenmatch.co.uk

এদের মধ্যে শীর্ষ ১০ শহর হলো

ছবিসূত্র: greenmatch.co.uk

পুরো পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে হুয়াওয়ে একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। হুয়াওয়ে স্মার্ট সিটির সূচক তথ্য ও মূল্যায়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে এই ১৭টি শহরের স্মার্ট সিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিত্র ফুটিয়ে তোলে । হুয়াওয়ে দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তাদের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে, আর তা হলো পরিকল্পনা কৌশল এবং তার বাস্তবায়ন। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দিক থেকে লন্ডন ৮০.৫ পয়েন্ট নিয়ে ১৭টি শহরের শীর্ষে অবস্থান করছে। লন্ডন শহরকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের জন্য যে প্রকল্পগুলো শুরু করেছিল তার মধ্যে একটি হল লন্ডন ডাটা স্টোর। এর মাধ্যমে জনসাধারণ লন্ডন শহরের সব তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকবে।

আরেকটি প্রকল্প হলো কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং তাদের লক্ষমাত্রা হলো লন্ডনের কার্বন মাত্রা ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৬০% কমানো। লন্ডনের অন্য প্রকল্পগুলো হলো শহরে ট্রাফিক সেন্সর, পার্কিং সেন্সর ব্যবহার করে এবং যাতায়াতের বিকল্প মাধ্যম ব্যবহার করে মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা। টেকসই পারিবেশিক লক্ষ অর্জন করা। এভাবেই লন্ডন শহরকে অনুসরণ করে বাকি শহরগুলোও স্মার্ট সিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তালিকায় ৮০.২ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রিষ্টল শহরটি  ‘ব্রিষ্টল স্মার্ট এনার্জি সিটি’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছে যেখানে তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

কিছু শহর স্বয়ংক্রিয় যানবাহন নিয়েও পরীক্ষা চালাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের যে ৪টি শহর স্বয়ংক্রিয় যানবাহন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে তার মধ্যে মিল্টন কিন্স একটি। এই শহরটি ২০১৫ সাল থেকে পরীক্ষা চালাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন নিয়ে এবং চেষ্টা করছে অন্যান্য যাতায়াত ব্যাবস্থায় তা সংযোজন করা যায় কিনা। এর পাশাপাশি এই শহরটি আবর্জনা রাখার পাত্রে, পার্কিং এলাকায়, মাটির আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য সেন্সর ব্যবহারের মতো অনেক ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নিয়েছে যাতে রাস্তায় যানবাহনের ঘনত্ব কমে, শহরে সবুজের পরিমাণ বাড়ে এবং মানুষজন বাইরে বের হতে উৎসাহী হয়।

যে সমস্যা অথবা সমস্যার পূর্বাভাস থেকে টেকসই শহর ব্যাবস্থা ও স্মার্ট সিটি ধারণার উদ্ভব সেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব যদি পৃথিবী্র অন্যান্য শহরগুলো একযোগে এগিয়ে আসে। এদিক থেকে ইউরোপ এগিয়ে সবার থেকে। নিম্নে স্মার্ট সিটির সংখ্যার একটি তালিকা দেয়া হলো।

ছবিসূত্র: greenmatch.co.uk

এর মধ্যে ৩৫ ভাগের অবস্থান ইউরোপে। এর পরের অবস্থানে আছে এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা। নগরায়নের ফলে শহর বাড়ছে, বাড়ছে মানুষ। বাড়ছে এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোও। আর এই সমস্যা মোকাবেলায় টেকসই শহর ব্যবস্থা ও স্মার্ট সিটির পরিকল্পনা করা এবং সেই পরিকল্পনা মোতাবেক এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র পন্থা। নয়তো আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের অবস্থা হবে কিছুটা পূর্বে উল্লিখিত উদাহরণের আপেল গাছটার মতো। যদি আজ আমরা নিজ স্বার্থ চরিতার্থের জন্য সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা না করি তাহলে কেবল স্বার্থপর হয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। অদূর অভিষ্যতের অসংখ্য মানুষ কোনো সুফল ভোগ করতে পারবে না।