যারা বিদেশী ভাষা শিখতে চান তাদের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত হয়ে দাঁড়ায় তাদের বয়স। বাচ্চারা যত সহজে একটি ভাষা শিখতে পারে, বড়রা তত সহজে কিংবা দ্রুত গতিতে কোনো ভাষাকে আয়ত্ত করতে পারে না। সাধারণত দেখা যায়, বাচ্চারা কোনো নির্দেশনা কিংবা সহায়তা ছাড়াই তাদের প্রথম ভাষাটি রপ্ত করে ফেলে। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ভাষা রপ্ত করতে গিয়ে সেই ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে অনেক চিন্তিত থাকেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বড়দের তুলনায় ছোটরা দ্রুত এবং সহজে একটি নতুন ভাষা রপ্ত করতে পারে।
কিন্তু ঠিক কোন কারণে তারা এত সহজে ভাষা শেখার মতো কঠিন কাজটি এত দ্রুত রপ্ত করতে পারে এ ব্যাপারে তারা কেউ একমত নন। অনেকেই মনে করেন কোনো জৈবিক কারণে শিশুরা এত সহজে একটি নতুন ভাষা শিখে ফেলেন। কেননা নতুন মস্তিষ্কের নমনীয়তা অনেক বেশি থাকে।
যেকোনো কিছু তাদের মস্তিষ্কে খুব সহজেই গেঁথে যায়। অন্যদিকে হার্ভাড সাইকোলজিস্ট স্টিভেন পিংকার এ ব্যাপারে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের ভাষা শেখার জন্য যে প্রেরণাগুলো কাজ করে সেগুলো বিলীন হতে শুরু করে। এছাড়া আরো অনেকে মনে করেন শিশুদের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ পরিবেশ রয়েছে যেগুলো তাদের মস্তিষ্ককে উদ্দীপনা দিয়ে কোনো ভাষা শিখতে সহায়তা করে। শিশুদের অন্তরে নতুন কিছু শিখতে পারার অনুপ্রেরণা থাকে। তারা বড়দের মতো ভুল নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকেনা। বরং তারা ভুল করে করেই নতুন কিছু শেখে। অথচ প্রাপ্তবয়স্কদের দেখা যায়, তারা কোনো ব্যাকরণ কিংবা শব্দ চয়নে বিশেষ খেয়াল রাখে বলে উক্ত ভাষা রপ্ত করতে পারে না অথবা রপ্ত করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়ায়।
নতুন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে শব্দ একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বিদেশী ভাষার একটি টোন থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা উচ্চারণ এবং স্বরাঘাতে বিশেষ লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করে। এতে নতুন ভাষা শিখতে কিংবা আয়ত্তে আনতে তাদের সময় বেশি লাগে। হেনরি কিসিংগার বলেন, গত ৮ দশক ধরে আমেরিকায় নতুন জীবনের আশায় শত শত মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে। এত সময় পার হয়ে গেলেও ভিনদেশী ভাষা রপ্ত করতে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়।
ভিনদেশী ভাষা শেখা এবং সে ভাষায় কথা বলা এক প্রকার সহজ কাজই বলা যায়। তবে অপেক্ষাকৃত অনেক কঠিন মনে হয় তখন, যখন উক্ত ভাষার ব্যাকরণ জানার প্রয়োজন হয়। মুখে মুখে ভাষা বলার চেয়ে ব্যাকরণ ঠিক রেখে কথা বলা অনেক কষ্টের। তবে শিশুরা ব্যাকরণ অনুসরণ করে না। বড়রা ব্যাকরণ অনুসরণ করতে গিয়ে ভাষা শেখায় বিলম্ব করে ফেলে। যাই হোক, যেকোনো ভাষা শেখা অসম্পূর্ণ থাকে যদি না তার ব্যাকরণ সম্পর্কে অবগত থাকে। তাই যেকোনো ভাষার ক্ষেত্রেই ব্যাকরণ জানা খুব জরুরি। শিশুদের তুলনায় বড়রা ব্যাকরণ শেখার ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে।
যেহেতু শিশুরা অবচেতন মনে একটি ভাষা শিখে, সেহেতু তারা সেই ভাষার ব্যাকরণে তেমন একটা পারদর্শী হয় না। কিন্তু ব্যাপক বিশ্লেষণী ক্ষমতার কারণে বড়রা এই বিষয়ে এগিয়ে থাকে। বোস্টন কলেজের জসুয়া হার্টসর্নের সাথে মি: পিংকার এবং জসুয়া টেনেনবাম একটি গবেষণা করেন। এই বিশাল গবেষণায় তারা একটি হাইপোথেসিস বা অনুমান করার চেষ্টা করেন। এজন্য তারা অনলাইনে ৬,৭০,০০০ জন মানুষের একটি ইংরেজি ভাষার টেস্ট বা পরীক্ষা নেন। এই পরীক্ষায় তারা কুইজ হিসেবে কিছু প্রশ্ন করেন। এই পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য ছিল যে, প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকে জানা যে, তারা কবে থেকে ভাষার ব্যাকরণ চর্চা শুরু করেন। এ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা সেই নির্দিষ্ট বয়সটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এ পরীক্ষাটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
দেখা যায় যে, ভাষা চর্চা যারা খুব ছোট বয়স থেকে শুরু করেন তারা কিছুটা এগিয়ে থাকেন। কেননা তারা অন্যের থেকে ভাষা এবং ব্যাকরণ চর্চার জন্য সময় বেশি পান। অনেক তথ্য উপাত্ত নিয়ে করা এ গবেষণার ফলাফল অনেক বিস্তৃত ছিল। দেখা যায় যে, বয়:সন্ধিকালের আশেপাশেই সাধারণত এই গবেষণার ফলাফল ছিল। নতুন একটি অধ্যয়ন বলে, এই ফলাফল ১৭ বছর বয়স কিংবা তার একটু পরেই।
সাধারণত ১০ বছর বয়স সবচেয়ে ভালো সময় কোনো ভাষা শেখার জন্য। সেই সাথে সেই ভাষায় বাকপটুতা অর্জনের জন্য ১০ বছর বয়স সবচেয়ে মোক্ষম সময়। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন, আপনার দেরি হয়ে গিয়েছে সেই ক্ষেত্রে ১৪ বছর বয়সও খারাপ নয়। এই বয়সে আপনি হয়তো বাকপটুতা নাও পেতে পারেন কিন্তু ভাষা চর্চা করতে পারেন। এই বয়সে সাধারণত বাচ্চারা সংবেদনশীল হয় এবং ভাষাগতভাবে কোনো ভুল ত্রুটি করলে তারা খুব অপমানবোধ করে। একটি ছোট বাচ্চা ৫ কিংবা ১০ বছর বয়সে তার ভাষা চর্চা শুরু করেছে এটি পরবর্তী জীবনে তেমন কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।
কিন্তু সুইডেন এবং ডেনমার্কের স্কুলগুলোতে দেখা যায় যে, তারা অনেক ছোট বয়স থেকেই শিশুদের ভাষা বিষয়ক জ্ঞান দিয়ে থাকেন। সংকটকালীন সময় পার হয়ে গেলে যে ভাষা শিক্ষা সম্ভব নয় এ তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। অনেকেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলেও অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করতে পারে যেকোনো ভাষায়। হার্টসর্ন তার পরীক্ষার একটি পর্যায়ে দেখেন অনেক সময় ব্যাকরণে মাস্টার হতে অনেক বয়স লেগে যায়। এমনকি ভ্রমণকালে সবচেয়ে সহজে কোনো ভাষা সম্পর্কে অনেক কিছু শেখা যায়।
নীতি নির্ধারকেরা তাদের সংশ্লেষ সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট। ভাষা শেখার জন্য সময়ের কোনো নির্দিষ্টতা নেই, বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। কিন্তু আগে আগে ভাষা শেখার বিকল্প নেই। কিন্তু একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শুধু শিখলেই হবে না সেই ভাষাকে চর্চার মাধ্যমে জীবন্ত অর্থাৎ চলমান রাখতে হবে।
No Comments Yet