আমাদের চারপাশে প্রচুর মানুষের বিচরণ। রোজ কর্মক্ষেত্রে, পাবলিক প্লেসে, রেস্তোরায়, চা-কফির দোকানে অসংখ্য নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয় বা নতুন মানুষের দর্শন মেলে। কিন্তু দিন শেষে এই অসংখ্য মানুষের সবার কথা বা চেহারা কি আমাদের মনে থাকে? নিশ্চয় সবার কথা মনে থাকে না! এই অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে কেবল মনে থাকে সেই সব হাতে গোনা দুই একটা চেহারা বা মানুষকে, যারা আমাদের মনে বিশেষ কোন ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই বিশেষ ছাপ তারা কীভাবে ফেলতে সক্ষম হয়? তাদের চেহারা সুন্দর? কথা সুন্দর? দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দর? পোষাক সুন্দর নাকি ব্যবহার সুন্দর? আলাদা আলাদা ভাবে এসবের কোন একটা সুন্দর হলেই কি সে অন্য কারো মনে জায়গা করে নিতে পারে?

আপনি কেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী তা চেহারায় ফুটে উঠে,   photo source: psychologist world

ধরুন, একটা মেয়ে দেখতে খুব সুন্দর। প্রথম দর্শনেই তাকে ভাল লেগে গেল। কিন্তু কথা বলার সময় বুঝলেন সে অপরিষ্কার, তার গালে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ! নিশ্চয় নিমিষেই তার প্রতি আপনার মুগ্ধতা উবে যাবে। আবার হয়তো কেউ দেখতে সুন্দর, পরিপাটি কিন্তু কথা বলেন তার আঞ্চলিক ভাষায়, যার অধিকাংশ কথা আপনি বুঝতে পারেন না। নিশ্চয় সেও আপনার মনে জায়গা করে নিতে পারবে না।

তাহলে পারবে কে? পারবে সেই মানুষটা যে এমন অসংখ্য গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছে নিজের মধ্যে আর হয়ে উঠেছে তার আশপাশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে অনন্য। এই অনন্য মানুষগুলোকে এককথায় বলে ব্যক্তিত্ববান।

মানুষ যেমন জন্ম নিলেই মানুষ হয় না, তেমন একজন সাধারণ মানুষ আপনা আপনি ব্যক্তিত্ববান হয়ে ওঠে না। ব্যক্তিত্ববান হতে হলে দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তিত্বের চর্চা করতে হয়। চলুন, আরও বিষদভাবে জেনে নিই আমজনতার মধ্য থেকে অনন্য তথা ব্যক্তিত্ববান কীভাবে হয়ে ওঠা যায়।

এই অভ্যাসগুলো রোজ চর্চা করুন, ব্যক্তিত্ববান হয়ে উঠুন,   photo source: HEC

চেহারা

ব্যক্তিত্ববান হতে কি সুন্দর চেহারার অধিকারি হতে হয়? অথবা সুন্দর চেহারা থাকলেই কি ব্যক্তিত্ববান হওয়া যায়? আমি আগেই বলেছি, ব্যক্তিত্ব আপনা থেকে আসে না, চর্চা করতে হয়। চেহারা আপানার জন্মগতভাবে পাওয়া, এখানে আপনার কোন হাত নেই। আপনি ফর্সা, কালো, শ্যামলা, মোটা, খাটো, যে কোন চেহারার হতে পারেন। কিন্তু এই চেহারা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা, অধিকার সম্পুর্ণ আপনার। কাজেই ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে আপনার চেহারাকে আপনি কীভাবে উপস্থাপন করছেন তার উপর। একজন মানুষের চেহারা দেখে আমাদের মস্তিষ্কে প্রথমেই তার সমন্ধে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। সুতরাং আপনার উপস্থাপিত চেহারা দেখিয়ে অন্য মানুষের মনে কেমন প্রাথমিক ধারণা তৈরি করতে চান তা বিবেচনা করেই নিজের চেহারাকে যথাসম্ভব মার্জিত ও দর্শনীয় করে উপস্থাপন করতে হবে। তাহলেই সেই চেহারায় ফুটে উঠবে সুন্দর ব্যক্তিত্বের ছাপ।

স্টাইলিশ হওয়া

তাহলে কি ব্যক্তিত্ববান হতে খুবই স্টাইলিশ হতে হয়? না, তাও নয়। স্টাইলিস হওয়া লাগে না, লাগে মার্জিত হওয়া। অর্থাৎ আপনি যেমন, তাই কিছুটা স্বতন্ত্র আর মার্জিতভাবে উপস্থাপন করেই হয়ে উঠতে পারেন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

ভাল ইংরেজি বলতে পারা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু ইংরেজি জানতেই হবে, না হলে ব্যক্তিত্ববান হওয়া যাবে না, এমন নয় photo source: The QuickSearch Blog

ইংরেজি বলার দক্ষতা

ব্যক্তিত্ববান হতে কি ভাল ইংরেজি জানতে হয়? না, একদমই তা নয়। ভাল ইংরেজি বলতে পারা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু ইংরেজি জানতেই হবে, না হলে ব্যক্তিত্ববান হওয়া যাবে না, এমন নয়। যেটা দরকার তা হল, যা জানেন তার শুদ্ধ ও সঠিক প্রয়োগ। আপনি একজন বাঙালি, ভাল বাংলা বলতে পারেন, এটাই আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। কিন্তু ব্যক্তিত্ববান হতে গিয়ে ভুল বা হাস্যকরভাবে ইংরেজি ব্যবহার করলে সেটা ব্যক্তিত্বের পরিচয় হবে না বরং হবে হাস্যকর ব্যাপার।

সুন্দর করে বলা

সুন্দর বলতে পারা আর সব যোগ্যতার চেয়ে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কথাই সব। কথা বন্ধুকে শত্রু বানাতে পারে, শত্রুরে বন্ধু। আবার একই কথা ব্যক্তি ও পরিবেশেভেদে ভিন্ন সুর ও অর্থ বহন করে। সুতরাং কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতেই হবে। আবার ভোববেন না, স্বাধীনভাবে কথা বলব সেখানেও সমস্যা!

কারো সাথে কথা বলার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, কথা বেশি বললে ভুল বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার আপনার জন্ম দেশের যে কোন প্রান্তে হতে পারে, তবে কারো সাথে কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে আপনি আপনার নিজের অঞ্চলের ব্রান্ডিং করছেন না, কোন একজন মানুষের সাথে কথা বলছেন। সুতরাং কথা বলার সময় আঞ্চলিকতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করুন। কেননা আপনার পার্টনার আপনার সব কথা হয়তো বুঝতে নাও পারে, তাতে ঐ ব্যক্তির কাছে আপনার ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। খুব দ্রুত বা খুব ধীরে, অথবা একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। জানা শব্দভান্ডার থেকে সুন্দর সুন্দর শব্দ চয়ন করে গুছিয়ে কথা বলুন। আপনি কথা দিয়েই সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন।

অন্যের কথায় মনোযোগী হোন  photo source: Quora

অন্যের কথায় মনোযোগ

এই ভুলটা আমরা প্রায়শই করি। কথা বলার সময় অন্যকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই অনর্গল বলে যাই। বাস্তবতা হল, এতে আমাদের সম্মান বাড়ে না বরং ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যজনকে কথা বলার সুযোগ দিন, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তারপর ঠান্ডা মেজাজে তার কথার জবাব দিন। দিন শেষে ভেবে দেখুন, কথা বলার ক্ষেত্রে আপনার কোন বিষয়গুলো অন্যের চোখে দৃষ্টিকটু দেখায়, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। ব্যক্তিত্ব আপনা থেকেই ফুটে উঠবে।

মানুষকে মূল্যয়ন

আমাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক মানুষ আছে যারা চাকরিতে উচ্চপদস্থ, বা ক্ষমতাবান হওয়ার কারণে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় ভাবতে শুরু করে আর সবসময় একটা গুরুগম্ভীর ভাব বজায়ে রাখে। এই ধারণাটা একদম ভুল। অকারণ গুরুগম্ভীর থাকলে ব্যক্তির গুরুত্ব বাড়ে না বরং কমে। এমন গুরুগম্ভীর যারা থাকেন তারা নিশ্চয় অন্যের কাছে গুরুত্ব পান, কিন্তু যারা আরও প্রাণবন্তভাবে মিশতে জানেন তা আরও হাজার গুণ বেশি গুরুত্ব পান।

আপনার কথা বলা, চাহনি এবং অন্যের সাথে ভাব বিনিময় যেন বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে শুরুতেই কাউকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা বা আপনার চেয়ে কম জানে – এমন জ্ঞান করা বোকামি। আপনার বহুবছর পরে জন্ম নিয়েছে, এটা তার অযোগ্যতা নয়, বরং ছোট হয়েও সে আপনার সাথে মিশতে পারছে, এটাই তার যোগ্যতা। কাজ বিবেচনা করে অন্য মানুষকে মুল্যয়ন করুন। ঐ ব্যক্তির কাছে আপনি হবেন শ্রদ্ধেয়।

আজ থেকে অন্যের প্রশংসা করতে শুরু করুন  photo source: jesus-is-savior.com

অন্যের প্রশংসা

অন্যের প্রশংসা করা সবচেয়ে বড় মনের পরিচয়। এই ছোট্ট গুণটা অধিকাংশের মধ্যে থাকে না। আজ থেকে অন্যের প্রশংসা করতে শুরু করুন। অন্যের ভালো কাজ বা সাফল্যে প্রশংসা করে তাকে উৎসাহ দিন। সহযোগিতা পেলে, তাকে অন্তর থেকে বিনয়ের সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কুন্ঠ বোধ করবেন না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশই আপনার ব্যাক্তিত্ব বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ আর আপনার জন্য ঐ মানুষটার মনে একটা স্থায়ী আসন তৈরি হয়ে যায়।

পরিবারিক প্রশংসা

প্রতিবার সাজগোজের পর মা অথবা সঙ্গি/সঙ্গিনীকে অকপটে জিজ্ঞেস করুন, আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে? দেখবেন তার মুচকি হাসির সাথে ছোট্ট একটু প্রশংসা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে বহুগুন। এই প্রশংসা আপনাকে সারাদিন চনমনে রাখবে, যা আপনা থেকেই আপনার সুন্দর ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলবে।

ব্যক্তিত্ববান হওয়ার প্রধান শর্ত হল সৎ হওয়া photo source: Business News Daily

সৎ মানুষ হয়ে ওঠা

কথায় বলে, এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গরুর প্রস্রাব পড়লে সব দুধ নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি অসংখ্য আচরণগত পরিবর্তন করেও যদি মানুষ হিসাবে সৎ হতে না পারেন তো সব কিছুই ভেস্তে যাবে। সুতরাং ব্যক্তিত্ববান হওয়ার প্রধান শর্ত হল সৎ হওয়া। সৎ চরিত্র ছাড়া ব্যক্তিত্ববান হওয়া সম্ভব নয়।

আমিত্ব পরিহার

কিছু একটা করতে পারলে বা কোন কাজে সাফল্য পেলে আমার নিজেকে জাহির করতে শুরু করি। “আমি” অমুক, আমি বড়, এমন একটা গাম্ভীর্য চলে আসে। এই আচরণগুলোতে ব্যক্তিত্ববান বা ব্যক্তিত্বহীনের পরিচয় ফুটে ওঠে। সুতরাং, নিজেকে জাহির করা পরিহার করুন, অন্যরা আপনাকে জাহির করে দিবে। আর ব্যক্তিত্ব, সে তো আপনা থেকেই ফুটে উঠবে।