“খালিদের ইয়ারমুখ যুদ্ধ” – কিস্তিঃ পাঁচ : মেজর ডি এইচ খান

কিস্তিঃ এক

কিস্তিঃ দুই

কিস্তিঃ৩

কিস্তিঃ চার

অধুনা যুদ্ধে ডি-ডের (যুদ্ধ শুরু হবার তারিখ) তথ্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সযত্নে লুকিয়েই রাখা হয় না শুধু, পাশাপাশি একচুয়াল ডি-ডের তারিখ সম্পর্কে ডেলিবারেটলি শত্রুকে মিসলিডও করা হয়। রাত আর দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়া কে আক্রমনের আদর্শ সময় আর অপ্রস্তুত শত্রুর কন্সেন্ট্রেশনের ওপর অতর্কিতে হামলাকে আদর্শ রণকৌশল গন্য করা হয়। অধুনা যুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন যুদ্ধক্ষেত্র বলতে কিছুই নেই, আর সেনাপতি আর অফিসারদের সবার আগে আক্রমন করা হয় সৈন্যদের মধ্যে লিডারশিপ ক্রাইসিস তৈরি করতে। এই এক যন্ত্রনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অফিসারদের যেন দূর থেকে চিহ্নিত না করা যায় সে জন্য চকচকে পিতলের র্যাথঙ্কের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে কাপড়ের ফিল্ড র্যা ঙ্ক পরিধানের প্রচলন হয়ে গেল।

কিন্তু আগেকার যুদ্ধের কিছু নর্ম ছিল সত্যি বেশ রাজসিক। যেমন উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র, ডি-ডে ইত্যাদি নির্ধারন করা হত। ক্ষেত্র বিশেষে রণডঙ্কা বা দামামা বাজিয়ে দিনের যুদ্ধ শুরু হত, মূলযুদ্ধ শুরুর আগে বেলিজারেন্ট চ্যাম্পিয়নরা মল্লযুদ্ধে অবতীর্ন হত। সাধারন সৈন্যরা সাধারনত সেনাপতি বা রাজাদের সরাসরি এনগেজ করত না, অবশ্য তাদের হাইলি স্কিল্ড বডি গার্ডদের পেরিয়ে তার কাছে পৌছানো প্রায় দুঃসাধ্য ছিল, সেটাও একটা কারন ছিল। আবার দিনশেষে দামামা বাজিয়ে দিনের যুদ্ধে ইতি টেনে সৈন্যরা যার যার শিবিরে রিট্রিট করত; আর অভিজাত সেনাবাহিনী রাতে সাধারনত কোন যুদ্ধে লিপ্ত হত না, এবং শত্রুর আগোচরে শত্রুর ক্যাম্প রেইডের তো প্রশ্নই ওঠেনা।

ভাহান আর খালিদের নিস্ফল পার্লে শেষে ১৫ আগস্ট ৬৩৬ ইয়ারমুখ যুদ্ধের ডি-ডে নির্ধারিত হয়ে গেল। অবশ্য উভয় পক্ষই ইতোমধ্যে ফাইনাল প্রিপারেশন শুরু করে দিয়েছে। ব্যাটেল প্রসিডিউরের অংশ হিসেবে কমান্ডাররা তাদের নিজ নিজ ব্যাটালিয়নের জায়গা রেকি করে নিল, অফিসার আর এনসিওরা লাস্ট অর্ডার পাস করার পর সৈন্যদের অস্ত্র-বর্ম আর ঘোড়ার নাল ইন্সপেক্ট করল, ধর্ম যাজকেরা ভরপেট খেয়ে নিয়ে মোটিভেশনাল স্পিচ দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল। রাত গভীর হবার আগেই আজ লাইটস অফ হয়ে গেল। যুদ্ধের আগের রাতে সৈন্যদের পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে ডিউটি অফিসাররা তাবুতে তাবুতে উকি দিতে লাগল। আর প্রিয় কারো স্মৃতিচিহ্ন মুঠোর ভেতর আকড়ে ধরে সৈন্যরা অন্ধকার তাবুর ছাদের দিকে অপলক চেয়ে থেকে থেকে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ল।

শুধু জেনারেলরা জেগে থাকল গভীর রাত অবধি। দীর্ঘ সামরিক জীবনের উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে একেকজন জেনারেলের জন্ম। বিগত প্রত্যেকটা যুদ্ধে নিজেকে প্রমান করতে পেরেছেন বলেই আজ তারা জীবিত আর জেনারেল। আর জেনারেল বলেই পরদিন সকাল থেকে শুরু হতে যাওয়া যুদ্ধটা নিয়ে তারা ভীষনভাবে চিন্তিত। নিজের পৈতৃক প্রাণটা বাঁচানোর সহজাত তাগিদেই যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেক সৈন্য প্রাণপণে লড়ে, কিন্তু সচেতন আর অবচেতনে তারা বিশ্বাস করে তার কমান্ডার আর জেনারেল এই যুদ্ধ জিতবার জন্য সেরা প্ল্যানটাই করেছেন; এবং দিনশেষে তারাই জিততে যাচ্ছে।

এ এক আমোঘ দায়বদ্ধতা যা প্রত্যেক কমান্ডার আর জেনারেলকে সারাক্ষন তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিপক্ষ দুই জেনারেলের কেউই কারো চেয়ে যুদ্ধের অঙ্ক কম বোঝেন না। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে কিছু নির্দিস্ট পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা কাউকে জিতিয়ে দেয় আর কেউ হেরে বসে। পরাজিত জেনারেলও ভাল করেই জানেন ঠিক কী কারনে তিনি হারতে যাচ্ছেন, আর কী করতে পারলে এই অবস্থা থেকেও জিতে বের হয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তখন আর সেই করনীয়টা করবার মত ফোর্স অথবা রিসোর্স তার হাতে থাকে না। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রত্যেক জেনারেল যুদ্ধের সব পর্যায়ে একটা রিজার্ভ ফোর্স আর রিসোর্স হাতে রাখতে চান, আর প্রতিপক্ষের রিজার্ভ ফোর্স অথবা রিসোর্সটাকে নস্ট করবার জন্য তক্কে তক্কে থাকেন।

বাইজান্টাইন ফিল্ড কমান্ডার ভাহান সৈন্য সংখ্যায় তার প্রতিপক্ষের চে ঢের এগিয়ে। তারপরও এই বেলিজারেন্ট রেশিওর এডভান্টেজ তাকে স্বস্তি দিতে পারছে না। ইউরোপিয়ান, আর্মেনিয়ান, আরব ইত্যাদি মিলিয়ে এমন হেটারোজেনাস বাহিনী কমান্ডের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তার নেই। এমেসায় ছোট্ট একটা মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধের কথা বলে এদের বেশিরভাগকে আনা হয়েছিল। এমেসায় জিতলে সে মোরালে পরের ক্যাম্পেইনে নিয়ে যেতে তেমন সমস্যা হতনা। জয়ের জন্য যেমন মোরাল অপরিহার্য, তেমনি জয়ের চে বড় মোরাল আর কিছুই হয় না। কিন্তু খালিদের ট্যাক্টিক্যাল রিডেপ্লয়মেন্টের কারনে ইয়ারমুখ পর্যন্ত আসতে আসতে এরা ইতোমধ্যে বেশ ক্লান্ত, অনেকেই ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বহুজাতিক বাহিনীতে তুচ্ছ সব কারনে নিজেদের ভেতর ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। গত একমাসের বেশি সময় ধরে তাই নতুন এরাবিয়ান টেরেইন আর ওয়েদারে এদের এক্লেমেটাইজ করে নেয়াটা জরুরী ছিল।

একই ফ্যাসাদ বাইজান্টাইন কমান্ড লেভেলেও। হেরাক্লিয়াস তার কোষাধ্যক্ষ ট্রিথুরিয়াসকে পাঠিয়েছিলেন বাইজান্টাইন আর্মির স্ট্রেটেজিক কমান্ডার হিসেবে যেন বেতন নিয়ে সৈন্যদের মনে অযথা সংশয় না দেখা দেয়। কিন্তু সেই ট্রিথুরিয়াস এখন ভাহানের ওপর খবর্দারির চেস্টা করছে। খ্রিস্টান আরব প্রিন্স জাবালাহর চেয়ে ভাল করে আর কোন বাইজান্টাইন কমান্ডার এই টেরেইন বোঝার কথা না, অথচ জাবালাহর কোন কথাই ইউরোপিয়ান কমান্ডারেরা পাত্তা দিচ্ছে না। কমান্ডারদের এই মিউচুয়াল মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং সৈন্যদের মাঝে রিউমার আর মিসট্রাস্টের নতুন নতুন ডালপালা গজিয়ে চলেছে।

সামনে মুসলিম ক্যাম্পে প্রতিদিনই দলে দলে রিইনফোর্সমেন্ট যোগ দিচ্ছে। পেছনে দামেস্ক পাঁচটা বিশাল বাইজান্টাইন আর্মির রশদ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। গ্রীষ্ম প্রায় শেষ, শিগগিরই খাদ্যশষ্য আর ঘোড়ার খাদ্যে টান পরবে। দামেস্কের গভর্নর মনসুর ইতোমধ্যে তাগাদা দিচ্ছে যা করবার তারাতারি করতে।

সবচে দূর্ভাবনা খালিদকে নিয়ে। ফ্রন্টে মুসলিম আর্মি সাকুল্যে তিন চার ফাইলের বেশি পদাতিক সৈন্য দাড় করাতে পারবে না, অথচ বাইজান্টাইনদের ন্যুনতম দশ ফাইল সৈন্য দাঁড়াবে। তাই ওয়েট অব এটাক নিয়ে ভাহানের মনে কোন সংশয় নেই, মুসলিম ফ্রন্ট আক্রান্ত হবার পর দুমড়ে যাওয়াটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু খালিদের মোবাইল গার্ড নিয়েই যত বিপত্তি। ক্যভুলরি নিয়ে ফ্ল্যাঙ্কিং ম্যানুভারে রোমানরাও কম যায় না, যদিও ভাহান ইনফেন্ট্রি ট্যাকটিক্সেই বেশি স্বচ্ছন্দ্য। কিন্তু খালিদ এই ব্যাপারটায় মাস্টার। যুদ্ধক্ষেত্রে আনএক্সপেক্টেড সব টাইম আর ডিরেকশনে এসে উপস্থিত হবার রেকর্ড তার আছে।

তাছাড়া ব্যাটেলফিল্ডে তার নিজের লোকেশনটাও ভাহানের ঠিক মনপুত হচ্ছে না। সারা ইয়ারমুখ প্রান্তরে একটাই উচু টিলা, সেটা আবার মুসলিম আর্মির ভাগে পড়েছে। ভাহানের জন্য মোটামুটি উচু একটা স্থানে একটা উচু মাচা করা হয়েছে অবশ্য, কিন্ত সেটা তার এয়রে অফ ফোর্সের ঠিক স্কয়ার না হয়ে কিঞ্চিত ডানে পড়ে গেছে। ফলে যুদ্ধের সময় বাইজান্টাইন বাম ফ্ল্যাঙ্কের ব্যাটেল ডেভেলপমেন্ট অব্জার্ভ করা দুরূহ হয়ে পরবে বলেই মনে হচ্ছে। একরাশ উদ্বেগ আর অস্বস্তি নিয়ে ভাহান ঘুম না আসা পর্যন্ত তাই তাবুময় অস্থির পায়চারি করতেই থাকলেন।

সেই তুলনায় খালিদ বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন। গত একমাসে প্রায় ৬০০০ সৈন্যের ফ্রেশ রিইনফোর্সমেন্ট এসেছে। এর বেশির ভাগই ইয়েমেনী তীরন্দাজ। সৈন্য সংখ্যা বেশি তাই শুরু থেকেই ভাহান অফেন্সিভ লড়বে, অতএব ডিফেন্সিভ লড়াই ছাড়া খালিদের গত্যান্তর নেই; অন্তত প্রথম দুই তিনদিন তো নয়ই। এমন ডিফেন্সিভ ব্যাটেলে প্রতিপক্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে আর শত্রুকে ধীরে ধীরে কাহিল করতে তীরন্দাজদের গুরুত্ব অপরিসীম। তার উপর প্রায় ১০০০ জনের মত সাহাবী পাঠিয়েছেন খলিফা উমর যাদের ভেতর প্রায় ১০০ জন বদরের যুদ্ধের ভেটেরান। আর আছেন মহানবী (সাঃ) এর আত্মীয় আবু সুফিয়ান আর তার স্ত্রী হিন্দ। এদের উপস্থিতির কারনে মুসলিম আর্মির মোরাল আর মোটিভেশন এখন তুঙ্গে।

মুসলিম আর্মির স্ট্রেটেজিক কমান্ডার আবু উবাইদা অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে হিন্দ এর নেতৃত্বে প্রত্যেক মুসলিম গৃহিনীকে ক্যাম্পে স্ট্যান্ডবাই রেখেছেন যেন মুসলিম যোদ্ধারা পিছু হটার কথা ভাবতে না পারেন, আর যুদ্ধে আহতদেরও যেন দ্রুত শুশ্রসা নিশ্চিত করা যায়।
বাইজান্টাইন ওয়েট অব এটাক নিয়ে খালিদও দুশ্চিন্তায় আছেন। বিশেষত গ্রেগরির ইউরোপিয়ান আর্মি টেস্টুডো ফর্মেশনে লড়বে। এরা সামনে আর চার পাশে ম্যান টু ম্যান শেকল বেধে এগোয়, ফলে কিছুটা স্লো এগুলেও এদের থামান কঠিন। তাছাড়া শেকলের কারনে ক্যভুলরি চার্জ করেও খুব একটা সুবিধা করা কঠিন, কারন শেকলে বেধে শুরুতেই ঘোড়া হোচট খেয়ে পরে যায়।

খালিদও ভাল করেই জানেন বাইজান্টাইন এটাকের মুখে মুসলিম ফ্রন্ট কোথাও না কোথাও ভাংবেই। তাই রাত জেগে তিনি কখন কোথায় ভাঙ্গন ধরলে কিভাবে কোন পথে কী করবেন সেই কন্টিজেন্সির হিসেব নিকেশ করতে থাকলেন।

১৫ আগস্ট ৬৩৬। এক মাইলের কিছু কম ব্যবধানে ইয়ারমুখ প্রান্তরের কেন্দ্রে বাইজান্টাইন আর মুসলিম আর্মি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। বাইজান্টাইন রোমান লিজিয়ন তাদের সুশোভিত বর্ম-শিরস্ত্রান, রংবেরঙের রেজিমেন্টাল পতাকা আর উচু উচু ক্রুশ দেখিয়ে মুসলিম সৈন্যদের চোখ ধাধিয়ে দিল প্রায়। কিন্ত বাইজান্টাইন সৈন্যদের চোখে মুসলিম সৈন্যদের প্রতি সমীহও চোখ এড়ালো না কারো, সিরিয়ান আর পার্সিয়ান ক্যাম্পেইনে অবিশ্বাস্য মুসলিম সাফল্যের প্রেক্ষিতেই যে এই সমীহ তা আর নতুন করে বলে দিতে হয় না।

প্রায় ঘন্টা খানেক কোন পক্ষই কোন ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তারপর হঠাত বাইজান্টাইন সেন্টার থেকে একজন অফিসার দুলকি চালে তার ঘোড়া ছুটিয়ে মুসলিম সেন্টারের দিকে এগিয়ে এল। সেই সময়ে যুদ্ধ শুরুর আগে দুই পক্ষের চ্যাম্পিয়ন যোদ্ধারা এভাবেই দুই প্রতিপক্ষের মাঝের নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে প্রতিপক্ষের চ্যাম্পিয়ন যোদ্ধাদের দ্বন্দ যুদ্ধে আহবান জানাত। মুসলিম চ্যাম্পিয়নদের বলা হত মুবারিজুন। বাইজান্টাইন এই অফিসারের নাম জর্জ। মুসলিম সেন্টারের কাছাকাছি এসে জর্জ তার ঘোড়া থামিয়ে উচু গলায় খালিদ বিন ওয়ালিদকে এগিয়ে আসতে আহবান জানাল। কিছুক্ষনের ভেতরই মুসলিম ফ্রন্টের একটা অংশে সৈন্যরা দুপাশে চেপে গিয়ে পথ করে দিল, আর সে পথে খালিদ তার ঘোড়ার পিঠে চড়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে বেড়িয়ে এল।

Writer : Major Del H Khan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *