দ্যা মুঘল এম্পায়ারঃ রাইজ অফ দ্যা মুঘলস – পর্ব ১
ভূমিকা
বালকটির পিতার কবুতর পালনের খুব শখ ছিলো। আর তাই নিজ বাসভবনের ছাদের এককোণে কবুতর পালন করতেন। এর ঠিক সরাসরি নিচে স্রোতস্বিনী নদী।
বালকের পিতা নিজ হাতে কবুতরদের খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাৎ ভূমিধ্বসে কবুতর আর ছাদসহ উচু থেকে নদীতে পরে তিনি সাথে সাথেই মারা গেলেন। বালক যেহেতু আমাদের মত সাধারন কেউ না, তাই পিতার মৃত্যুর পর শত্রুদের হাতে বালকের মৃত্যুর আশংকা ছিলো প্রবল।পিতার মৃত্যুর সময় বালক ৩০ মাইল দূরে আন্দিজানে অবস্থান করছিলো। আর তাই এই পরিস্থিতে রাজপ্রসাদে যাবে কি না, এই নিয়ে বালক চিন্তিত। প্রাসাদে গেলে বালক হয় সুলতান হবে, নয়তো বন্দী। আর এই অবস্থায় বন্দী হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্য।
নিজেকে ভাগ্যের হাতে সপে দিয়ে ১২ বছর বয়স্ক কিশোর রওয়ানা দিলো ফারগানার দিকে, তার পৈত্রিক অধিকার আদায় করতে। ষড়যন্ত্রকারীরা কিন্তু বসে নেই। মৃত সুলতানের সিংহাসন কিভাবে কম ঝামেলায় সহজে দখল করা যায়, তারা সে হিসাব নিকাশ কষতে ব্যাস্ত।
এদিকে বিশ্বস্ত কিছু গোত্রপ্রধানের সহায়তায় আর তার নিজ নানীজানের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে বালক নিজের পৈত্রিক অধিকার আদায় করে নেয়। সিংহাসন! ফারগানার সিংহাসন! বালককে কি এখন আর বালক বা কিশোর বলা যাবে? না, ১২ বছর বয়সের বালকটি এখন ফারগানার সুলতান!
সিংহাসন তো আদায় করা গেলো, তাই বলে কি কিশোর সুলতান নিরাপদ? না। নিজের আত্মীয়ের দ্বারাই আবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয় আমাদের এই কিশোর সুলতান। তবে ভাগ্য ভালো, এই যাত্রায় বেঁচে যায় কিশোর সুলতান। বালক অবশ্য বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার আরেক মহান পুর্বপুরুষের রাজধানী দখলের বাসনা জাগে তার মনে! ২ বারের চেষ্টায় দখলও করে ফেলে কিশোর সুলতান। সমরকন্দ! মহান বিজয়ী তৈমুরে রাজধানী সমরকন্দ কিশোর সুলতানের আয়ত্বে!
তবে কিশোর সুলতানের ভাগ্য ততটা ভালো ছিলো না। আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে নিজের পিতৃভূমি ফারগানাই হাতছাড়া হয়ে যায় সুলতানের। ফারগানা দখল করতে গিয়ে আবার সমরকন্দ হাতছাড়া হয়ে যায় সুলতানের। পথে পথে কিছুদিন ভবগুড়ের ন্যায় ঘুড়েন। কিন্তু যার কপালে আরো মহান কোন গৌরব লেখা আছে, তিনি বেশিদিন পথের ভিখিরি হয়ে থাকবেন কেনো?
কিশোর সুলতান আবারো সমরকন্দ দখল করেন। তবে ঐ যে বলেছিলাম না, বালকের ভাগ্য হয়তো ততটা ভালো না। আরেকবার তার প্রমাণ মিললো। কারন তিনি আবারো সমরকন্দ হাড়ান। এবার কিন্তু কিশোর সুলতানকে আরেকটু বেশি মূল্য দিতে হয়। রাজ্যের সাথে সাথে নিজের আদরের বোনকেও কিছুদিনের জন্য হাড়াতে হয় তাকে।
আবারো সেই পথে পথে থাকার দিন শুরু। তবে বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে হয় নি এবার। নিজ চাচার মৃত্যুর পর অনেকটা নিজ থেকেই কাবুল তার হাতে ধরা দেয়। কিশোর সুলতান এখন আর রাজ্যহারা নয়। তিনি এখন কাবুলের সুলতান। কাবুলে এসে থিতু হয়ে অনেকদিন বেশ শান্তিতেই জীবন কাটতে থাকে কিশোর সুলতানের। তবে শান্তি কি আল্লাহ এই কিশোর সুলতানের ভাগ্যে রেখেছেন?
কিশোর সুলতান তার মহান পুর্বপুরুষ তৈমুরের মতোই সমৃদ্ধশালী ভারত দখলের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন যেনো তাকে ঘুমাতেও দিচ্ছিলো না।
অবশেষে কিশোর সুলতান ১৫০৫ সালে ভারতে অভিযান চালান। ভালো কথা, সুলতানকে কি আর কিশোর বলা যাবে? না, তিনি এখন ২২ বছরের তরুন, অফুরন্ত সম্ভাবনাময় এক তরুন। যার ভাগ্যে লেখা হতে যাচ্ছে মহান এক গৌরবের কাহিনী। আজ থেকে শত শত বছর পরেও পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্ত থেকে এই তরুনকে শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সাথে স্মরন করা হবে। তরুন সুলতান তা হয়তো জানেন না। তিনি অবশ্য এতো কিছু নিয়ে ভাবেন না, তার মাথায় শুধুই ভারত!
তরুন সুলতানের এই অভিযান অবশ্য ভারত দখলের জন্য না। শুধুমাত্র ভারত দখলের সম্ভাবনা যাচাই করার জন্যই এই অভিযান। এদিকে নিজ শত্রুদের দমন করার জন্য তাকে ভারত সীমান্তের ঐ পাশেই কাটাতে হয় আরো কিছু বছর। ১৫১৯ সালে সুলতান, যাকে এখন আর তরুনও বলা যাবে না, আবারো ভারতে অভিযান চালান। কয়েকটি প্রাথমিক অভিযান চালিয়ে তিনি বুঝতে পারেন স্বপ্নের ভারত দখল করতে হলে তাকে অবশ্যই আগে কান্দাহার দখল করতে হবে। তিনি কান্দাহার দখল করে নেন। ১৫২৪ সালে চতুর্থবারের মতো ভারতে অভিযান চালান, কিন্তু চূড়ান্ত আক্রমণ না চালিয়েই ফিরে আসেন। সুলতানকে আরো প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতে দখলের চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্ততি।
১৫২৫ সাল, নভেম্বর মাস। সুলতান আর তাঁর সেনাবাহিনী ভারতের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। এ এক স্বপ্নপূরণের যাত্রা। এক মহান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যাত্রা……
১.
শাহান-ই-গুরখানি, দৌলত-ই-মোগলিয়া, শাহান-ই-মোগল, সালতানাত-ই-মোগলিয়া অথবা, মহান মুঘল সাম্রাজ্য- যে নামেই ডাকা হোক না কেনো, মুঘল সাম্রাজ্য এখন শুধুমাত্র ইতিহাস হলেও এই সাম্রাজ্যের প্রভাব এখনো আমরা আমাদের জীবনে অনুভব করি। প্রায় ৩২ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই সাম্রাজ্যটি ছিলো সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। সম্পদ, বিলাসিতা আর আভিজাত্যের দিক থেকে ৩ মহাদেশশাসন করা উসমানী খিলাফতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো মুঘল সাম্রাজ্য। তবে সম্পদ কিংবা আভিজাত্য মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জন না। মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয়ে থাকা ভারতবর্ষের ভূখন্ডগুলোকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসা। মুঘল পতাকা। মুঘল সাম্রাজ্য যদি প্রতিষ্ঠা না হতো, বা পরবর্তীতে একই রকম অন্য কোনো রাজবংশ ভারতের উপর আধিপত্ত বিস্তার না করতো, তা হলে ভারত হয়তো আজ ছোট ছোট ৫০/৬০ টির মত রাষ্ট্রে বিভক্ত থাকতো। ভারতবর্ষের প্রতি মুঘলদের আরেকটি অবদান হচ্ছে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান। যার ফলে হিন্দু-মুসলিমদের ঐক্যের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্য বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। ঠিক ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না কুটিল ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতে তাদের “ডিভাইড এন্ড রুল” পদ্ধতির সফল প্রয়োগ না করলো।
তাই না চাইলেও “বাবর কা আওলাদদের” আমাদের ধন্যবাদ দিতেই হয়।
মুসলিম শাসন এই বিশাল ভারত ভূখন্ডে মুঘলদের দ্বারা শুরু হয় নি। বরং তার থেকেও অনেক আগে, ৭১১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সের মুহাম্মদ বিন কাশিম ভারত দখলের মাধ্যমে শুরু হয়। এর পর থেকে পরবর্তী প্রায় ৩ শতাব্দী ধরে মুসলিম খিলাফতের সাথে উত্তর ভারতের রাজপুত রাজ্যগুলোর যুদ্ধ লেগেই থাকতো। যার ফলে ধীরে ধীরে উত্তর ভারতে সুলতানী শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। এদিকে আরব বিশ্বের সাথে বানিজ্যের সুবাদে তারও বহু আগে দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আরবদের বসবাস শুরু হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স) এর মাধ্যমে পুনরায় ইসলাম প্রচার শুরু হলে, এইসব আরবদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এসব আরব মুসলিমদের দ্বারা দক্ষিণ ভারতে বাহমানি সালতানাত আর দাক্ষিনাত্য সালতানাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে তুর্কীরা সাবেক রাজপুত ভুখন্ডগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেন দিল্লী সালতানাত। খিলজী রাজবংশ গোটা মধ্যভারতই দখল করে নেয়। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের পূর্বে কেউই গোটা ভারতকে এক সুতোয় গাঁথতে পারেন নি। ভারতের ছোট ছোট রাজ্যগুলো নিজেদের ভেতরে কিংবা মুসলিমদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধতেই ব্যস্ত থাকতো।
তাই বলা যায়, ভারতবর্ষে মুঘলদের আগমনের বহু পূর্বেই ভারতে মুসলিম শাসন ছিলো। দাস বংশ, খিলজী রাজবংশ, তুঘলক আর লোদি বংশের ধারাবাহিকতায় মুঘলরা ভারতে এসে পৌছায়। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের শাসন ক্ষমতায় ছিলো দিল্লী সালতানাতের লোদী রাজবংশ।
ভারতের ভাগ্যপরিবর্তনকারী যুদ্ধগুলোর কথা যদি বলতে হয়, তাহলে তরাইনের প্রথম আর দ্বিতীয় যুদ্ধের কথা সবার আগে চলে আসবে।
তরাইনের যুদ্ধে একপক্ষে ছিলেন আফগানিস্তানের মুহাম্মদ ঘোরি, অন্যদিকে ছিলেন তৃতীয় রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহান। রাজপুতদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে মুহাম্মদ ঘোরিকে ভারত আক্রমনের অনুরোধ জানান পৃথ্বিরাজ চৌহানেরই শ্বশুর মশাই। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ঘোরি আক্রমণ করে চৌহানের রাজপুত রাজ্যকে শুধুমাত্র দুর্বল করেই চলে যাবেন। কারন তাঁর আগেও গজনীবীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ ও বিজয় লাভ করেও নিজ রাজ্যের অন্তর্দ্বদ্বের কারণে ভারতে স্থায়ী শাসন বিস্তার করতে পারেন নি। কিন্তু মোহাম্মদ ঘোরীর উদ্দ্যেশ্য ছিলো সম্পূর্ন ভিন্ন। তিনি মুসলিম শাসিত ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
১১৯১ সালের তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘোরি প্রায় ৩৫ হাজার তুর্কী সৈন্য নিয়ে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। রাজপুত বাহিনী ছিলো প্রায় ২০ হাজার অশ্বারোহীসহ প্রায় ৫০ হাজার সৈন্যের। এ যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘোরি প্রচলিত তুর্কী কৌশল প্রয়োগ না করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, যার মাশুল তাকে পরাজয় দিয়ে শোধ করতে হয়েছিলো। কথিত আছে, তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তিনি এতোই অপমানিত হয়েছিলেন যে, যুদ্ধে পরাজয়ের দিন তিনি যে পোষাকে ছিলেন, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ের পূর্বপর্যন্ত তিনি সেই পোষাকেই ছিলেন। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের স্ত্রীর কাছেও যান নি।
এদিকে চৌহান যুদ্ধ বিজয় করে যখন নিজ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন গোটা রাজধানী জুড়ে তাকে সম্মান জানানো হয়। তাঁর বিরোচিত গল্পের কথা কিংবদন্তীর ন্যায় ছড়িয়ে পরে।
১১৯২ সাল।
প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের ঠিক পরের বছরই ঘোরি প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের এক বাহিনী নিয়ে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানের মুখোমুখি হন। ঘোরির আক্রমণে বিরক্ত চৌহান এবার ৩ লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটান। তাঁর সাহায্যে পাশে এসে দাঁড়ান ১৫০ জন রাজপুত রাজা।
তুর্কী সৈন্যদের একটি বিশেষ কৌশল ছিলো- যুদ্ধের কিছুক্ষণ পরে পরাজিত হওয়ার ভান ধরে করে সবাই একযোগে পালানো। যখন প্রতিপক্ষ পেছন থেকে তাদের তাড়া করে, তখন হঠাতই তাঁরা পেছনে ঘুড়ে তীর নিক্ষেপ করতেন। মুহাম্মদ ঘোরি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে এই তুর্কী কৌশলটি প্রয়োগ করতে ব্যার্থ হন। ২য় যুদ্ধে অবশ্য এই ভুলটি তিনি করেন নি। যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘোরি বিজয় লাভ করেন।
পৃথ্বিরাজ চৌহান এই যুদ্ধে নিহত হন। তবে তিনি ঠিক কিভাবে মারা যান, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে যেভাবেই হোক, বীর রাজপুত নিশ্চই বীরত্বের সাথে লড়াই করেই মৃত্যবরণ করেছেন।
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুহাম্মদ ঘোরি তাঁর তুর্কী সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবেককে দিল্লী দখল আর দিল্লীর প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যান।
১২০৬ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মুহাম্মদ ঘোরির রাজ্য তাঁর সেনাপতিদের ভেতরে ভাগ হয়ে যায়। কুতুবউদ্দীন আইবেক দিল্লীতে স্থাপন করেন দাস রাজশাসন। কুতুবউদ্দীন আইবেক ছিলেন মুলত মামলুক সেনাপতি, আর মামলুকরা শুরুতে ছিলো দাস। তাই কুতুবউদ্দীনের বংশ দাসরাজবংশ হিসেবে পরিচিতি পায়।
১২১০ সালে লাহোরে পোলো খেলার সময় কুতুবউদ্দীন আইবেক ঘোরার পিঠ থেকে পরে মারা যান। তাঁর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর ভাই আরাম শাহ। কিন্তু অনভিজ্ঞ আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লী সালতানাত দখল করেন শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ।
ইলতুৎমিশের পর তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ ১২৪৬ থেকে ১২৬৬ সাল পর্যন্ত ভারত শাসন করেন। নাসিরুদ্দীনের পর গিয়াসউদ্দীন বলবন ১২৮৬ সাল পর্যন্ত, কায়কোবাদ ১২৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পক্ষাগাতগ্রস্থ ও পরে নিহত হলে ভারতের আকাশে সূচনা হয় খিলজী রাজবংশের।
১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত শাসন করা এ রাজবংশের সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো ক্রমাগত বর্বর মোঙ্গল আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করা। শত শত বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতাগুলো বর্বর মোঙ্গলরা নিমেষেই মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলো। কাজেই ভারত আক্রমণ করে তারা সফলতা পেলে হয়তো ভারতের ইতিহাসই আজ অন্যরকম থাকতো। এ রাজবংশের সুলতান আলাউদ্দীনকে ক্ষমতার দিক দিয়ে মুঘল সম্রাটদের সমতুল্য বিবেচনা করা হয়। ইতিহাসের পাতায় তিনি মোঙ্গল আক্রমণ থেকে ভারতকে নিরাপত্তা দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রাজপুত শক্তিগুলোকে দুর্বল করাও ছিলো তাঁর আরেকটি সাফল্য।
১৩২১ সালে গাজী মালিক গিয়াসউদ্দীন তুঘলক ভারতে আরেকটি নতুন শক্তির উত্থান ঘটান। ইতিহাসে যে শক্তি তুঘলক রাজবংশ নামে পরিচিত। ১৩৯৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তুঘলক রাজবংশ ভারতের রাজদন্ডের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ছিলো। এই সময়েই আমীর তৈমুর লং ভারতে অভিযান চালান। যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে পতন ঘটে আরেকটি রাজবংশের।
দিল্লী সালতানাতের চতুর্থ রাজবংশ হলো সৈয়দ পরিবার। ১৪১৪ থেকে ১৪৫১ সাল পর্যন্ত তাঁরা দিল্লী সালতানাতের অধিকর্তা ছিলেন। এ রাজবংশ নিজেদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বংশধর দাবী করতেন। তৈমুর লং-এর ভারত আক্রমণের সময় তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খলার সময় তাঁরা সিংহাসনের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন। ৩৭ বছর ধরে সৈয়দ বংশের ৪ জন সুলতান ভারতের ক্ষমতায় ছিলেন।
সৈয়দ বংশের পর ভারতের আকাশ আরেকটি রাজবংশের দেখা পায়। লোদী রাজবংশ। বাহালুল লোদী ১৪৫১ সালে এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বাহালুল খান লোদীর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সিকান্দার শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তিনি ১৪৮৯ সালের ১৭ জুলাই দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইব্রাহীম খান লোদী দিল্লী সালতানাতের দায়িত্ব পান। ইব্রাহীম খান লোদী ছিলেন একজন দক্ষ আর নির্ভীক শাসন। তাঁর শাসনামলে ভারতের অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা প্রায় ভেঙ্গে পরেছিলো। রাজপুত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো। আফগান শক্তিগুলো দিল্লীর জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিলো। তিনি শক্ত হাতে সব শক্তিকে দমন করেন। তবে তিনি একটি শক্তিকে দমন করতে পারেন নি। যে শক্তির জন্য পানিপথের প্রান্তরে তাকে জীবন হারাতে হয়েছিলো।
গতপর্বে উল্লেখ করা আমাদের কিশোর সুলতানের কথা মনে আছে তো? মাত্র ১২ বছর বয়সে যিনি ফারগানার সিংহাসনে বসেছিলেন? তিনি কিন্তু এখন টগবগে যুবক। যার তীক্ষ্ণ চোখ সবসময়েই ভারতের উপর নিবদ্ধ থাকে। ভারতকেও তিনি নিজের উত্তরাধীকার সূত্রে দাবী করেন।
১৫২৫ সাল, নভেম্বর মাস। টগবগে সুলতান ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। সাথে ১৫ হাজারের এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী।
উত্থান আর পতনের খেলায় ভারতের আকাশ নতুন আরেকটি সূচনা দেখতে যাচ্ছে। আর একেকটি সূচনা মানে পূর্বের কিছুর সমাপ্তি। এই সমাপ্তি অসীম সাহসী ইব্রাহীম লোদির, আর সূচনা আমাদের টগবগে তরুণ সুলতানের। যিনি উত্থান ঘটাতে যাচ্ছেন নতুন এক রাজবংশের, নতুন এক শক্তির। যে রাজশক্তি ৩০০ বছরেরও বেশি সময় উপমহাদেশ দাপিয়ে বেড়াবে, যে শক্তি সংগঠিত করবে আধুনিক ভারতকে। যাদের গল্পগুলো কিংবদন্তীর ন্যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের মনে গেঁথে থাকবে। শত বছর কিংবা হাজার বছর পরও তাদের স্মরণ করা হবে শ্রদ্ধার সাথে। ভারতের আকাশে আজ নতুন সূর্যোদয় হতে যাচ্ছে। সিংহের গর্জন এগিয়ে আসছে। মুঘল সিংহ।
Author: Masud Ferdous Eshan