বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচ উত্তেজনায় ভরপুর। উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচে দুই দলের খেলোয়াড়দের মাঝে অনেক সময়ই ঠোকাঠুকি লেগে যায় কিংবা অনেক সময় অন্যায়ভাবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে আঘাত করে থাকেন খেলোয়াড়রা। এসব বিষয়গুলো সামলানোর জন্য খেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রেফারিকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রেফারি অনেক সময় অনেক খেলোয়াড়কে লালকার্ড প্রদর্শন করে থাকেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে অনেক খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছেন। তবে এর মাঝে বিখ্যাত হয়ে আছে বেশকিছু লাল কার্ড। আজ এমনই ৫টি বিখ্যাত লাল কার্ডের ঘটনা সম্পর্কে জানাবো।
ওয়েইন রুনি, ২০০৬ বিশ্বকাপ
প্রতিপক্ষ: পর্তুগাল
২০০৬ বিশ্বকাপে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ওয়েইন রুনির লাল কার্ড । ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের হয়ে খুব ভালো খেলতে পারেননি ওয়েইন রুনি সেই সাথে কোয়ার্টার-ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে লাল কার্ড তাকে আরো সমালোচিত করে। তবে ওয়েইন রুনির এই লাল কার্ডটি বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অবদান।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে একসাথে খেলতেন রোনালদো এবং রুনি। কিন্তু জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে দুই খেলোয়াড় দেশের হয়ে যখন মুখোমুখি হন তখন তারা বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হন। ওয়েইন রুনি পর্তুগিজ খেলোয়াড় রিকার্ডো কারভালহোকে আঘাত করেন। সেটি কার্ড পাওয়ার মতই ফাউল ছিল কিন্তু তার ক্লাব সতীর্থ ক্রিস্টিয়ানো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রেফারির কাছে লাল কার্ড দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান। পুরো ঘটনা ক্যামেরায় ধরা পড়ে। লাল কার্ড পাওয়ার পর রুনিকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ট্রাইবেকারে ইংল্যান্ড হেরে যায়। অন্যদিকে ইংলিশ ফুটবল ভক্তদের চক্ষুশূলে পরিণত হন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
জসিপ সিমুনিক, ২০০৬ বিশ্বকাপ
প্রতিপক্ষ: অস্ট্রেলিয়া
জসিপ সিমুনিক বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার যিনি একই ম্যাচে তিনটি হলুদ কার্ড দেখেছেন এবং তিনবার হলুদ কার্ড দেখার পর তিনি মাঠ ছেড়েছেন। তবে এটি হয়েছে রেফারির সামান্য এক ভুলের কারণে। কিন্তু রেফারির এই সামান্য ভুলে জসিপ সিমুনিকের লাল কার্ডটি বিখ্যাত হয়ে আছে। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার সিমুনিক প্রথমবার হলুদ কার্ড দেখেন ম্যাচের ৬১ মিনিটে।
এরপর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো হলুদ কাড পান ৯০ মিনিটে। কিন্তু রেফারি গ্রাহাম পোল সিমুনিকের জায়গায় সেটি অস্ট্রেলিয়ার তিন নম্বর জার্সিতে খেলা ক্রেইগ মুরের নামে তোলেন। রেফারি তখন তার ভুলটি বুঝতে পারেননি। কিন্তু ম্যাচ শেষে তিনি যখন তার ভুল বুঝতে পারেন তখন তিনি সিমুননিক তৃতীয়বারের মতো হলুদ কার্ড দেখান। বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনবার হলুদ কার্ডেরর মাঠ ছেড়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন জসিপ সিমুনিক।
লুইস সুয়ারেজ, ২০১০ বিশ্বকাপ
প্রতিপক্ষ: ঘানা
ফুটবলের অন্যতম ‘ব্যাডবয়’ লুইস সুয়ারেজ বিশ্বকাপে অনেক আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। সুয়ারেজের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল ঠেকানো এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে ইতালির জর্জো কিয়েলিনিকে দাঁত দিয়ে কামড় দেওয়া। কামড় দিয়ে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন।
কিন্তু বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল ঠেকানোর কারণে তাকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত উরুগুয়ে টাইব্রেকারে ম্যাচটি জিতে সেমিফাইনালে উঠে যায় এবং সুয়ারেজ নিজ দেশে নায়ক বনে যান। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানা এবং উরুগুয়ের ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ের শেষদিকে যখন ১-১ গোলে সমতায়। ঠিক সেই মূহুর্তে ঘানার একটি আক্রমণ যখন গোল গোলপোস্টে ঢুকে যাবে ঠিক তখন সুয়ারেজ হাত দিয়ে সেটি প্রতিহত করেন। রেফারি তার কাজের জন্য তাকে লাল কার্ড দিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন এবং ঘানাকে পেনাল্টি দেন। কিন্তু পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন আসামোয়াহ গিয়ান। শেষ পর্যন্ত ঘানা টাইব্রেকারে উরুগুয়ের কাছে হেরে যাওয়ায় লুইস সুয়ারেজ ঘানার ভক্তসহ বিশ্বের অনেকের কাছেই বিতর্কিত হয়ে পড়েন।
ডেভিড বেকহাম, ১৯৯৮ বিশ্বকাপ
প্রতিপক্ষ: আর্জেন্টিনা
ফকল্যান্ড যুদ্ধ এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’ এর পর থেকে ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার ম্যাচ মানে অন্যতম এক উত্তেজনা আর সেটা যদি হয় বিশ্বকাপের মঞ্চে তাহলে তো কথাই নেই। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড।
সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় এবং বর্তমানে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ কোচ দিয়েগো সিমিওনি ডেভিড বেকহামকে ফাউল করলে ডেভিড বেকহাম মাথা গরম করে মাঠে শুয়ে থেকেই দিয়েগো সিমিওনির পায়ে লাথি মারেন। রেফারি খুব কাছে থেকেই বিষয়টি দেখেন এবং তিনি তাদের দুজনকে প্রথমে উঠতে বলেন। এরপর রেফারি দিয়েগো সিমিওনিকে হলুদ কার্ড দেখান এবং ডেভিড বেকহামকে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বের করে দেন নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময় ম্যাচটি ২-২ গোলে সমতায় থাকার পর ম্যাচ ট্রাইবেকারে আর্জেন্টিনার কাছে ৪-৩ গোলে হেরে যাই ইংল্যান্ড। ডেভিড বেকহামের এই কান্ডের জন্য ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়ায় নিজ দেশের মানুষের কাছে খলনায়ক বনে যান। এমনকি তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।
জিনেদিন জিদান, ২০০৬ বিশ্বকাপ
প্রতিপক্ষ: ইতালি
শুধুমাত্র ২০০৬ বিশ্বকাপ নয় বরং বিশ্বকাপের ইতিহাসে জিনেদিন জিদানের লাল কার্ডটি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছে। ২০০৬ সালে জার্মানিকে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদান একাই নিজের দেশ ফ্রান্সকে ফাইনালে নিয়ে যান। কিন্তু ফাইনালে ইতালির খেলোয়াড় মার্কো মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে গুতা মেরে ফেলে দেয়ার কারণে জিদানকে রেফারি লাল কার্ড দিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স ট্রাইবেকারে ইতালির কাছে হেরে বিশ্বকাপের শিরোপা খোয়ায়।
পরবর্তীতে জানা যায় মার্কো মাতেরাজ্জি জিনেদিন জিদানের বোনকে নিয়ে খারাপ ভাষায় গালি দেওয়ার কারনে জিনেদিন জিদান তাকে মাথা দিয়ে গুতা মারেন। সেদিনের সেই ম্যাচে জিনেদিন জিদান শেষ পর্যন্ত খেলতে পারলে ইতিহাস হয়তো অন্য রকম ভাবে লেখা হতো। কিন্তু জিনেদিন জিদান এমন এক খেলোয়াড় তার এই কাজের পরও তিনি ভক্তদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী এক স্থান তৈরি করে নিয়েছেন।
Featured Image: espn.com