ঘটনাটি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিলো ২০১৬ সালের দিকে — ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে “ক্যাম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা” (ব্রিটিশ ডেটা এবং পলিটিক্স এনালাইসিস ফার্ম)/CA কে হায়ার করেছিলেন।
“Today in the United States we have somewhere close to four or five thousand data points on every individual … So we model the personality of every adult across the United States, some 230 million people.”
— Alexander Nix, chief executive of Cambridge Analytica, October 2016.
তখন ব্যপারটি নিয়ে অল্পসল্প লেখালেখি হলেও খুব একটা আমলে নিয়া হয়নি কেননা নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে প্রার্থীরা কত রকমেরই পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এতটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল………
কিন্তু, সম্প্রতি বিষয়টি আবারো লাইমলাইটে আসে গত ১৩ই মার্চ, সোমবার ব্রিটিশ টেলিভিশন ষ্টেশন চ্যালেন ফোর এর প্রচারিত হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজ এর মাধ্যমে যেখানে দেখা যাচ্ছে সিইও নিক্স বিভিন্ন সাজেশন দিচ্ছিলেন পলিটিক্যাল প্রার্থীদের কিভাবে ভোটে বিজয়ী হওয়া যায়।
এই প্রতিবেদনটি মূলত প্রচার হয়েছিলো “নিউ ইয়র্ক টাইমস” এবং “দ্য অবজারভ” পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করে। যেখানে বলা হয়ে-
!!ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুকের ডেটা ব্যবহার করে ট্র্যাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে!!
হ্যাঁ!! আপনি আমি বিশ্বাস ও নির্ভরতার সাথে প্রতিনিয়ত যেসব ব্যক্তিগত তথ্য যে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ার সার্ভারে জমা করে যাচ্ছি, সে ফেসবুক-ই নাকি প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউজার প্রফাইলের তথ্য ক্যাম্ব্রিজ এনাল্যটিক্যাল সংস্থার কাছে বিক্রি করেছে !!!
কি ভাবছেন? এর মাঝে আপনার প্রফাইল ও আছে কিনা? – না আপাতত এটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। প্রফাইল গুলো ছিলো প্রায় ৩২০,০০০ ইউএস ভোটার এবং তাদের ফ্রেন্ডলিস্টের ফ্রেন্ডের প্রোফাইল !!! এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে—
রাজনীতিতে সাধারন মানুষের সোশ্যাল প্রোফাইল দরকার হল কেন?
আসুন একটু জানার চেষ্টা করি, আমরা যেসব এক্টিভিটি এফবিতে করি যেমনঃ স্ট্যটাস দেয়া,লাইক,কমেন্ট,পিক আপলোড,বিভিন্ন ফান গেম বা কুইজে অংশ নেয়া ইত্যাদি। এসব জিনিষ হয়ত হয়ত সাধারন মানুষের চোখে তেমন কিছুই না। কিন্তু , একজন ডেটা এনালিস্ট বা একটি এনালাইজিং সংস্থার জন্যে অনেককিছু!! কারন এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে সহজেই আপনার ব্যক্তিত্ব বলে দিয়া যায় ,আপনার পছন্দ,অপছন্দ বলে দেয়া যায় এমনকি ভবিষ্যতে আপনি কি করতে যাচ্ছেন তাও ধারনা করা যায়।এটাকে বলা হয় আপনার “সাইকোগ্রাফিক প্রোফাইল ”।
শুরুটা যেভাবে…………
২০১৪ সালে আলেকজ্যান্ডার কোগান এবং তার কোম্পানী গ্লোবাল সাইন্স রিসার্চ (GSR) একটি ফেসবুক অ্যাপলিকেশন তৈরী করে যেটির নাম ছিল “thisisyourdigitallife” । প্রায় দুইশত সতেরো হাজার মানুষ এই অ্যাপটি ডাউনলোড করেছিলো!!
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের প্রায় ২ থেকে ৫ ডলার পর্যন্ত দেয়া হতো বিভিন্ন প্রকারের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক টেষ্টে অংশ নিবার জন্য!এই অ্যাপ ব্যবহার করতে হলে ফেসবুকের লগইন করতে হতো।
দ্বিতীয়তঃ এই অ্যাপ টি বিভিন্ন ডেটা যেমনঃ লাইক,ব্যক্তিগত তথ্য,এবং টেষ্টে অংশকারীর ফ্রেন্ডলিস্টের তথ্যও সংগ্রহ করতো।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কেন ফেসবুক তার ইউজারের ইনফরমেশনের এক্সেস দিলো?
যেহেতু ফেসবুক বিশ্বের একটি টেক জায়ান্ট কোম্পানী তাই সে ডেটা এনালাইসিস করার জন্যে,গবেষণা করার জন্যে তাদের অনুমতি দিয়েছিল। সাথে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছিলো। এসব টার্ম এবং কন্ডিশনের ভিত্তিতেই GSR কে অনুমতি দেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু, Kogan তার অ্যাপটির ফলাফলের ডেটাবেস ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারনার জন্যে ক্যমব্রিজ এনালিটিকার কাছে বিক্রি করে দেয়। যা ফেসবুকের পলিসির বহির্ভূত ছিলো। তাই ফেসবুক দাবী করছে এই অ্যাপ টি ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়,এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার ডেটা মুছে ফেলা হয়।
কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,যেসব CA’র এখনো অই ৫০ মিলিয়ন প্রফাইলের উপর এই দু’বছর ধরে নির্বাধ এক্সেস রয়েছে।
“ আগে সুখ স্বাচ্ছঁদ্য,পরে গোপনীয়তা “
নির্মম সত্য হলো এই যে, আমাদের মত সাধারন ফেসবুক ইউজাররা নিজেদের প্রাইভেসির ব্যপারে একদমি চিন্তিত নই। আমরা নির্দ্বিধায় নিজেদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন শেয়ারযোগ্য বা শেয়ারঅযোগ্য তথ্য শেয়ার করে যাচ্ছি।কুইজ জাতীয় বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের তথ্যের উপর বিভিন্ন কোম্পানির এক্সেস দিয়ে যাচ্ছি।
একটু যদি ভিন্ন করে কথাটা বলা হয় তবে বলা যায় যে, খেলার ছলে নিজেদের হাঁড়ির খবর নিজেরাই মাঠে ভেঙ্গে দিচ্ছি!!!!
মনে রাখতে হবে, আপনার প্রতিটি তথ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করছেন তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
যাই হোক, চলুন আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি…
এইক্ষনতো জানলাম কিভাবে এত্তগুলো মানুষের ডেটা CA ‘র হাতে গেলো।এবার আসুন জানার চেষ্টা করি কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যগুলো নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে কাজে লেগেছিলো।
আপনি যদি রাজনীতি পরিবর্তন করতে চান ,তবে আপনাকে সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হব,আপনি যদি সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে চান তবে আপনাকে সংস্কৃতির উপাদানগুলো জানতে হবে।
আর কোন দেশের জনসংখ্যা সংস্কৃতির উপাদানের একটি অংশ।তাই আপনাকে যদি সংস্কৃতি বদলাতে হয় তবে আপনাকে মানুষের সাইকোলজি পরিবর্তন করতে হবে!!!
এই ডেটা এনালাইসিস কোম্পানিটি কালেক্টেড প্রফাইলের ইনফরমেশন থেকে প্রতিটি মানুষের সাইকোলজিক্যাল প্রফাইল তৈরী করে। সেই ম্যাসিভ ডেটাবেস থেকে “ডেমোগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন” বের করে এবং কে কোন পলিটিক্যাল দল সাপোর্ট করে, ট্রাম্পের সমর্থক কে কে এসব বিচার বিশ্লেষন করে নির্বাচনী বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা চালানো হতো।এর সাথে প্রচারের জন্য বিভিন্ন রকমের সিধান্ত নিবার মডেলও তৈরী করে দিতো। এমনকি প্রচারণা চালানোর জন্যে কিভাবে ডোনার পাওয়া যাবে সে ব্যপারেও পরামর্শ দিত।
এসব কিছু জনসম্মুখে আনার পিছনে যে মানুষটির অবদান আছে তিনি হলেন ক্যম্ব্রিজ এনাল্যেটিকার প্রাক্তন ডেটা সাইন্টিস্ট ।তিনি মিডিয়ার কাছে ডেটা স্ক্যন্ডেলটি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন………
তিনি বলেন — “ইতিহাসে দেখা যায় ডেটা নিয়ে এর আগেও এমন unethical experiments হয়েছিলো, CA’র ঘটনাটিও ঠিক তাই।কেননা, এর মাধ্যমে পুরো জাতির (আমেরিকার) সাইকোলজি নিয়ে খেলা হয়েছিল,মানুষের অজান্তেই তাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে এই এনালাইসিস চালানো হয়েছে………………আপনি যখন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর চারপাশের ইনফরমেশন কন্ট্রোল করতে পারবেন আপনি তখন বুঝতে পারবেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের আচরণ কেমন হতে চলেছে……………”
“We exploited Facebook to harvest millions of profiles. And built models to exploit that and target their inner demons”
—–Christopher Wylie
তিনি আরো বলেন যে kogan তার অ্যাপ এর মাধ্যমে CA-কে ফেসবুকের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে প্রফাইলের ইনফরমেশন সংগ্রহ করার প্রস্তাব দেন।
কিন্তু , এখন kogan এই দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন । উল্টো তিনি দাবী করছেন ফেসবুক এবং ক্যাম্ব্রীজ এনাল্যটিকা নিজেদের দোষ ঢাকতে তাকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে!!
“We thought we were doing something normal”—- CA
অপরদিকে CA ও Wylie’র কথা অস্বীকার করে বলছে যে তারা যা করেছে তা নীতিবিরুদ্ধ কিছু নয়।নিছক ডেটা নিয়ে লিগ্যালি এনালাইসিস তারা করে এসেছে।তারা বলছে তারা ইউজারের অনুমতি ব্যতিত কোন তথ্য সংগ্রহ করেনি।
“ভুলের জন্যে মার্ক মার্ক জুকারবার্গের ক্ষমা প্রার্থনা ”
CNN কে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে যা হয়েছে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেছেন তাদের third-party application এর নীতিমালায় পরিবর্তন আসছে।
তিনি আরো বলেন জে,ফেসবুকের আর মানুষের মাঝে মেলবন্ধন হলো বিশ্বাস।যদি তারা ডেটা প্রটেক্ট করতে না পারে তবে সেবা প্রদানের কনো যোগ্যতাই এর প্রতিষ্ঠানটির নেই।
“We know that this was a major violation of people’s trust, and I deeply regret that we didn’t do enough to deal with it.”
—- Mark Zuckerberg
এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্যে যথাযত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কি হতে চলছে?
যা হয়েছে তার দায়ভার ফেসবুকের বলে দাবী করছে বিভিন্ন মিডিয়া।ধরে নেয়া হচ্ছে তাদের গাফেলতির কারনেই ডেটা হ্যাক্ট হওয়া সম্ভব হয়েছিল। আর তাই এ ঘটনার রেস ধরে ইতিমধ্যে ফেসবুক বাজারে তার ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো গড় মুল্য হারিয়েছে। এর পাশাপাশি #deletefacebook ক্যম্পেইন ও শুরু হয়ে গেছে। অন্যদিকে UK পার্লামেন্ট থেকে Zuckerberg কে তার বয়ান দিবার জন্যে ডাকা হয়েছে।
মোদ্দাকথা কোম্পানি গুলোর মাঝে কাঁদা ছোড়াছুড়ি লেগেই আছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে এবং মুল ঘটনা সবার সামনে আনার জন্যে ফেসবুক UK ও US এর আইন প্রণেতাদের কাছে তদন্ত করার আহ্বান জানায়।
এখন শুধু দেখার অপেক্ষা কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়.
Written By
Mehnaz Tabassum
Dept. of CSE
Daffodil International University