বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বিভিন্ন ক্যাডারের শূন্য পদগুলো পূরণ করা হয় বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। মেধাতালিকা তৈরির পর প্রার্থীর মেধাক্রম, পছন্দ ও প্রাধিকার কোটা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠায়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে পুলিশি তদন্তের পর উপযুক্তরা নিয়োগ পান। সুতরাং এ সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রাধিকার কোটার ব্যাপকতা মেধাকে পেছনে ফেলছে বটে। তবে প্রাধিকারধারীদেরও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে এ তালিকায় আসতে হয়। কারিগরি ও সাধারণ ক্যাডার মিলিয়েই পরীক্ষাটি নেওয়া হচ্ছে।
এর দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। চাকরি প্রার্থীসহ সবাই চান এ প্রক্রিয়ার সময়কাল যত হ্রাস করা যায়, ততই উত্তম। বেশি সময় চাকরি করতে পারবেন সফল প্রার্থীরা। সরকারও তুলনামূলক তরুণদের সেবা পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সময়সীমা কোনোভাবেই যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত করা যাচ্ছে না। অথচ একই প্রশাসনিক উত্তরাধিকারের দেশ ভারত ও পাকিস্তান বছরের পরীক্ষা বছরেই শেষ করে চাকরিতে যাচ্ছেন সফল প্রার্থীরা। কিছুটা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নানা কারণে এ দীর্ঘসূত্রতা। বিশেষ করে বিসিএসের সব ক্যাডারের জন্য একই পরীক্ষা আর প্রাধিকার কোটার বিভাজন বাছাই প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে রেখেছে। পিএসসি সক্রিয় হয়েও এসব বাধা উতরাতে পারছে না। অবশ্য কোটাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি সরকারের; পিএসসির নয়। এটা নিয়ে আগে অনেক লেখা হয়েছে। আর আজকের নিবন্ধ একে কেন্দ্র করেও নয়। মূলত সাধারণ ও কারিগরি—সব ক্যাডারের একই সিলেবাসে পরীক্ষাই এখানে আলোচনায় আসছে।
সাধারণ ক্যাডার হিসেবে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, কর, শুল্ক, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদিকে বিবেচনা করা যায়। কারিগরি ক্যাডারগুলো মূলত বিশেষায়িত চাকরি। এর মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারি কলেজের সব বিষয়ের শিক্ষক, কৃষিবিদ—এসব চাকরি থাকছে। আর প্রকৃতপক্ষে মোট শূন্যপদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পদই বিশেষায়িত। সাধারণ ক্যাডারের পদসংখ্যা তত বেশি নয়। তাই নিয়োগ দেওয়ার সুবিধার্থে বারবার দাবি করা হয়েছে একাধিক পিএসসি করার। সরকারকেও একপর্যায়ে ইতিবাচক মনে হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি পৃথক পিএসসি হবে, এরূপ ঘোষণাও আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনেছি। প্রকৃতপক্ষে কিছুই হয়নি। একটি পিএসসি সনাতনী ঘরানার পদগুলো ছাড়াও এত ধরনের বিশেষায়িত পদে নিয়োগ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এতে সময় যেমন বেশি লাগছে, তেমনি বিশেষায়িত পদগুলোর চাহিদার সঙ্গে অনেকটা সংগতিবিহীন একটি সিলেবাসের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সবাই বিসিএস হবেন—ভালো কথা। নিয়োগ স্তরে থাকবে সমান সুযোগ-সুবিধা। এতেও কারও আপত্তি নেই। সব ক্যাডার থেকেই একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে উপসচিব পদে নিয়োগ ও পরবর্তী পদোন্নতির নিশ্চয়তা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। আর তাই বলে সব ক্যাডারের নিয়োগ পরীক্ষা প্রায় একই সিলেবাসে নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ভিন্ন ভিন্ন সিলেবাসে বিসিএস হলেও সমমানধারী হতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
সিলেবাসটা একটু পর্যালোচনা করা দরকার। সবার জন্য ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা রয়েছে। এতে দুই থেকে আড়াই লাখ প্রার্থী অংশ নেন। সাধারণত ৫ শতাংশের কম টেকেন লিখিত পরীক্ষার জন্য। সে পরীক্ষা ৯০০ নম্বরের। আর তা মোটামুটি একই সিলেবাসে। সাধারণ ক্যাডারের জন্য বাংলা, ইংরেজি ও বাংলাদেশ বিষয়াবলি ২০০ নম্বর করে আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অঙ্ক ও মানসিক দক্ষতা এবং সাধারণ বিজ্ঞান ১০০ নম্বর করে। বিশেষায়িত ক্যাডারে শুধু বাংলায় ১০০ নম্বর কম এবং সাধারণ বিজ্ঞান নেই। তবে তাঁদের পদসংশ্লিষ্ট ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। এতে আছে ৭২টি বিষয়। উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের মৌখিক পরীক্ষা ২০০ নম্বরের। তাহলে বিশেষায়িত ক্যাডারের প্রার্থীরা যা নিয়ে কাজ করবেন, তার প্রতি বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগটি যথার্থ বলে লক্ষণীয় হচ্ছে।
ড. আকবর আলি খান তাঁর অবাক বাংলাদেশ—বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইতে লিখেছেন ‘পৃথিবীর আর কোনো দেশে বিশেষজ্ঞ নিয়োগে এ ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হয় কি না, এ সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীর মতো বিশেষজ্ঞদের নির্বাচনে তাঁদের বিশেষ বিষয়ের ওপর জ্ঞানের জন্য রাখা হয়েছে ২০০ নম্বর।’ আর সাধারণ ক্যাডারের মতো অন্যান্য বিষয়ে রাখা হয়েছে ৭০০ নম্বর। অথচ তাঁদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান যাচাই এখানে হচ্ছে না বলেই উল্লেখ করা যায়। সাধারণ পদের জন্য পাঠ্যক্রমকেও ত্রুটিপূর্ণ এবং একবিংশ শতাব্দীর জন্য অনুপযুক্ত বলেছেন ড. খান। তিনি লিখেছেন, ‘অঙ্ক, প্রাত্যহিক বিজ্ঞান এবং অনেক ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে এসএসসি পর্যায়ের প্রশ্ন করা হয়।’
যেসব যুক্তি একক সমন্বিত বিসিএস পরীক্ষার পক্ষে বলা হয়, তার মধ্যে আছে সব ক্যাডারের লোককেই কোনো না কোনো সময়ে প্রশাসনিক কাজ করতে হয়। তা ছাড়া, ভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হলে একটি বৈষম্যমূলক মনোভাবও সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এসব যুক্তির কোনোটিই ধোপে টেকে না। সব ক্যাডারেরই ঊর্ধ্বতন পদগুলো অনেকাংশে প্রশাসনিক। আর সে প্রশাসন পরিচালনার জন্য সাধারণ ক্যাডারের মতো এসব সিলেবাসে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে আসার প্রয়োজন হয় না। বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা মূলত পেশাদারি দায়িত্ব পালন করবেন। এটা করতে তিনি উপযুক্ত কি না, সেটা যাঁচাই করাই পিএসসির দায়িত্ব। পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলে যখন কিছু প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব পাবেন, সেখানেও সাধারণত দক্ষই হবেন। আগে পৃথক পৃথক ব্যবস্থায় পিএসসি কর্তৃকই প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগ হতো। তখনকার শিক্ষকদের কেউ কেউ স্বনামধন্য অধ্যক্ষ হয়েছেন। কেউ বা তখনকার শিক্ষা অধিদপ্তরের শীর্ষপদ জনশিক্ষা পরিচালক কিংবা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনেক কাজ তাদের শিক্ষকেরাই করেন। উপাচার্য তো তাঁরাই হন। আর পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা দিলে সে বিসিএস কর্মকর্তারা অচ্ছুত হবেন, এমন আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক। বরং পেশাগত জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে চাকরি পেয়েছেন বলে অধিকতর গৌরববোধ করবেন।
আলোচনা করা যায় কীভাবে এটা পুনর্বিন্যাস করা চলে। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর জন্য একটি পৃথক পিএসসি সর্বোত্তম বিকল্প। কোনো কারণে সরকার এটা করতে না চাইলে বর্তমান পিএসসির এ বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। সংশোধন করতে হবে কিছু বিধিবিধান। সে ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোকে সাধারণ ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত বিষয়গুলোর ওই ৭০০ নম্বরের পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটা খুব ঝামেলাপূর্ণ নয় বলে একসঙ্গে সেটাতে সবাই অংশ নিতে পারেন। এ পরীক্ষার সিলেবাসে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞানসহ বেশ কিছু বিষয় থাকে। একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার এ ধরনের জ্ঞান থাকা সংগত। বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে যাঁরা সফল হবেন, তাঁদের তালিকা পৃথক করে ওই নম্বরটাও মূল্যায়নের জন্য রাখা যায়। তারপর তাঁরা ২০০ নম্বরের বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দেবেন।
এ ছাড়া তাঁদের শিক্ষাজীবনে প্রাপ্ত ডিগ্রি ও ডিপ্লোমাগুলোর জন্য রাখা যায় ১০০ নম্বর। আর মৌখিক পরীক্ষাটিও মূলত হবে বিষয়ভিত্তিক। পৃথক পৃথক বোর্ডে। সেখানে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ থাকতে হবে। এভাবে মোট ৭০০ নম্বরের পরীক্ষার মাধ্যমে বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর মূল্যায়নপর্ব সম্পন্ন করা চলে। সাধারণ ক্যাডারের সিলেবাসও সময় ও দেশের ক্রমপরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ক্রমাগতভাবে মূল্যায়ন ও প্রয়োজনে পরিবর্তন করা দরকার। ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার অনুসরণে শূন্যপদের দ্বিগুণসংখ্যক প্রার্থীকেই শুধু মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা যায়। এভাবে পরীক্ষাটা হলে সময় অনেক বেঁচে যাবে বলে ধারণা করা হয়।
তবে এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাব তৈরির আগে ওয়ার্কশপ, সেমিনার-জাতীয় কিছু আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারে পিএসসি। নিতে পারে বিভিন্ন ক্যাডারের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাবিত ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম কিছু বের হয়ে আসতে পারে। আমলাতন্ত্র পরিবর্তনবিমুখ বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। আর ধারণাটি একেবারেই অমূলক নয়। তবে পরিবর্তন করতে হয় সময়ের বিবর্তনে। ১৯১২ সালে রচিত রবিঠাকুরের অচলায়তন নাটকটিতেও চিরায়ত বিশ্বাসের প্রতি অনমনীয় অবস্থানের বিপরীতে পরিবর্তনের দাবিও ছিল ব্যাপক। আর তা হয়েছেও। কবির কল্পনার অচলায়তন ছিল কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সূত্র: প্রথম-আলো