মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ড এবং আদালতে হত্যাকারীর ঐতিহাসিক জবানবন্দি
করমচাঁদ মোহনদাস গান্ধী হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সারাজীবন হিন্দুদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থেকেও তিনি নিজ ধর্মের অনুসারীদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেননি তাকে একজন হিন্দুর হাতেই জীবন দিতে হয়। তিনি এমন এক হিন্দুর গুলীতে প্রাণ হারান যে ছিল তার মতই উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মন। তার নাম নাথুরাম গডসে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হিন্দুদের এক বিরাট অংশ গান্ধী হত্যাকাণ্ডে গডসের যুক্তিকে সঠিক বলে মনে করত। গডসের ফাঁসি হয়েছে একথা ঠিক। তবে সে যে চিন্তায় আলোড়িত হতো সে চিন্তার এখনো মৃত্যু হয়নি। এখনো ভারতের কোটি কোটি হিন্দু গডসের চিন্তা ও চেতনায় আলোড়িত হয়। তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। আদালতে দেয়া তার জবানবন্দির আলোকে নাটক মঞ্চস্থ করে।
নাথুরাম গডসের পরিচিতি: নাথুরাম গডসে হত্যাকারী হলেও সে অল্পশিক্ষিত ছিল না। গডসে ছিল তার সময়ের শিক্ষিত লোকদের একজন। হিন্দু ইতিহাস ও হিন্দু শাস্ত্র এবং তদানীন্তন ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে ছিল তার গভীর জ্ঞান। তিনি আদালতে তার জবানবন্দিতে নিজেকে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি মুক্ত, বর্ণবাদ বিরোধী, এবং হিন্দু ইতিহাস ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেন “আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করি যে, হিন্দু সনাতনী আদর্শই কেবলমাত্র আমার মাতৃভূমি হিন্দুস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণ করতে পারে।”
‘মহাত্মা গান্ধীকে’ হত্যা: ১৯৩৪ সালের জুলাই থেকে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৬ বার গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। নাথুরাম গডসে ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে সে আবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি একই চেষ্টা চালায়। পর পর দু’বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি সে সফল হয়। সেদিন গান্ধী দিল্লীতে বিড়লা হাউসে এক প্রার্থনা সভায় যোগদান করেছিলেন। সেখানেই নাথুরাম গডসের গুলীতে তিনি নিহত হন। গান্ধীকে হত্যা করার জন্য গডসের কোন অনুতাপ ছিল না। সে প্রাণভিক্ষাও চায়নি। প্রাণদন্ডের জন্য সে ছিল সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে আদালতে জবানবন্দিতে নাথুরাম গডসের যুক্তি:
- হিন্দু মন-মানসিকতা ও চেতনার আলোকে তার কাছে মনে হয়েছিল যে, গান্ধী তদানীন্তন উপমহাদেশের ১০ কোটি মুসলমানের প্রাণের দাবি পাকস্তান প্রতিষ্ঠায় সায় দিয়ে হিন্দুদের পুণ্যভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেন “গান্ধীকে জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যদি তাই হয় তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশকে ভাঙ্গার সম্মতি দিয়ে তিনি তার পিতৃসুলভ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, গান্ধী তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নিজেকে পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। জিন্নাহর বজ্রকঠিন ইচ্ছাশক্তির কাছে তার অন্তরাত্মা, আধ্যাত্মিক শক্তি ও অহিংস মতবাদ সবই পরাজিত ও ক্ষমতাহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।”
- নাথুরাম গডসে বিশ্বাস করত যে, গান্ধী মুসলিম লীগ ও মুসলমানদের রাজনৈতিক ছাড় দিয়েছেন। হিন্দু স্বার্থের চেয়ে মুসলিম স্বার্থকে বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। জিন্নাহর প্রতি নমনীয় দৃষ্টি ভংগী প্রদর্শন করেছেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেন “দিল্লীর কয়েকটি মসজিদ হিন্দুরা দখল করে নিলে গান্ধী আমরণ অনশন শুরু করেন। তিনি শর্ত দেন যে এসব মসজিদ খালি করে দেয়া না হলে তিনি অনশন ভঙ্গ করবেন না। কিন্তু যখন পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর ভয়াবহ হামলা চালানো হয় সে সময় গান্ধী টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি এবং তিনি নিন্দাও করেননি। তিনি জানতেন যে অনশন করে মরে গেলেও কোনো পাকিস্তানী মুসলমান তার জন্য দু:খ পাবে না। একারণে তিনি মুসলমানদের উপর কোন শর্ত আরোপ করেননি।”
- দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর ভূমিকাকে নাথুরাম গডসে সমর্থন করলেও ভারতীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকাকে সে পুরোটাই অন্যায় বলে বিবেচনা করেছে। গান্ধীর অহিংস বাণী ও সত্যাগ্রহ ছিল তার দৃষ্টিতে হিন্দু ইতিহাসের পরিপন্থী। নাথুরাম বিশ্বাস করতেন -গান্ধী নিজেকে বৃটিশ রাজের অনুগত ব্যক্তি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। নাথুরাম মনে করতো অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠা দস্যু শিবাজি, রাজা রাবণের বিরুদ্ধে ভগবান রাম ও কংসের বিরুদ্ধে অর্জুনের মতো হিন্দু বীরদের সংহিস লড়াইয়ের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অহিংস পথ অবলম্বন করে গান্ধী হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছেন। তাই তাকে হত্যা করা পূন্যের কাজ। নাথুরাম আদালতে বলেন “কখনো কখনো দেশ আমাদেরকে অহিংসার পথ অগ্রাহ্য করতে এবং শক্তিপ্রয়োগে বাধ্য করে। আমি কখনো এ কথা চিন্তা করিনি যে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ অন্যায়। আমি আগ্রাসী শত্রুকে শক্তি প্রয়োগে পরাভূত এবং প্রতিরোধ করা ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করেছি। কিন্তু সে কর্তব্য পালনে গান্ধী পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তার অহিংস নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে।”
- নাথুরাম জবানবন্দিতে গান্ধীর একগুঁয়েমি এবং পুরনো ধ্যান ধারণার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন “গান্ধী ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর তার মধ্যে রাজানুগত্যের একটি মনোভাব জন্মতনি এমন এক পরিস্থিতিতে কাজ করতে থাকেন যেখানে তার কাজ কর্মের ভালোমন্দের বিচার করতেন শুধু তিনি নিজে। হয়তো কংগ্রেসকে তার পাগলামী, খামখেয়ালী ও পুরনো ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে হবে নয়তো কংগ্রেসকে গান্ধীকে বাদ দিয়ে চলতে হবে। অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে গান্ধীর মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা। এ আন্দোলনের কৌশল কারো জানা ছিল না। কখন আন্দোলন শুরু করতে হবে এবং এ আন্দোলনে বিরতি দিতে হবে তা সবই ছিল গান্ধীর একক সিদ্ধান্ত। তার ইচ্ছেই ছিল চুড়ান্ত। ‘একজন সত্যাগ্রহী কখনো ব্যর্থ হতে পারে না’ এটাই ছিল তার মূলমন্ত্র। কিন্তু সত্যাগ্রহী বলতে কি বুঝায় তিনি ছাড়া তা আর কারো জানা ছিল না। এভাবেই গান্ধী নিজেই নিজের কাজ কর্মের বিচারক ও জুরি দু’টিই হয়ে দাঁড়ান।”
- তিনি জবানবন্দিতে আর একটি যুক্তি দেখান সেটা হল – গান্ধী রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে হিন্দির দাবীকে অগ্রাহ্য করেছেন। তিনি বলেন “জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির দাবী ছিল সর্বাগ্রে। ভারতে তার ক্যারিয়ারের শুরুতে গান্ধী হিন্দির প্রতি অতীব গুরুত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মুসলমানরা হিন্দি পছন্দ করে না তখন তিনি হিন্দুস্তানী ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত একটি ভাষার প্রবক্তা সাজেন। ভারতের প্রত্যেকেই একথা জানে যে, হিন্দুস্তানী নামে কোনো ভাষা নেই। এ ভাষার কোনো ব্যাকরণ অথবা কোনো শব্দ ভাণ্ডার নেই। হিন্দুস্তানী ভাষা হচ্ছে একটি কথ্য ভাষা। তবে লিখিত ভাষা নয়। এটা হচ্ছে হিন্দু ও উর্দুর সংমিশ্রণে একটি জারজ ভাষা। কিন্তু গান্ধীর প্রচারণা সত্বেও এটি জনপ্রিয় হতে পারেনি। তিনি মুসলমানদের তুষ্ট করার জন্য বলেছিলেন যে, হিন্দুস্তানী হবে ভারতের জাতীয় ভাষা।”
যায়হোক গডসে আদালতে উল্লেখ করেন যে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি জনগণের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারেন না। তবে তিনি একই সঙ্গে একথাও ভেবেছিলেন যে গান্ধীর অবর্তমানে ভারতের রাজনীতি নি:সন্দেহে বাস্তব ভিত্তিক বলে প্রমাণিত হবে। আদালতে তার বক্তব্যের শেষ অংশটি ছিল এমন : “আমি যা করেছি সেজন্য সকল মহল থেকে আমাকে ভর্ৎসণা করা হচ্ছে। এতে আমার আস্থায় বিন্দুমাত্র ফাটল ধরেনি। আমার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সৎ ঐতিহাসিক গণ আমার কাজের যতাযথ মূল্যায়ন করবেন এবং ভবিষ্যতে একদিন প্রকৃত সত্যের মূল্য দেবেন।”
এই হচ্ছে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আদালতে দেয়া জবানবন্দি। সন্দেহ নেই যে, নাথুরাম গডসে একটা গভীর হিন্দু আবেগ থেকে সে ভারতের জাতির পিতা বাপুজী গান্ধীজীকে হত্যা করেছে। গডসে হিন্দু না হয়ে কোনো মুসলমান ঘরে জন্ম নিলে দেখতে পেত যে, গান্ধী কখনই মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। তা সম্ভবও নয়। তদানীন্তন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্য গান্ধীর নাড়ীর টান নাথুরাম গডসের চেয়ে কখনো দুর্বল ছিল না। এখানে যে বিষয় টা উল্লেখ না করে পারা যায় না তা হলো হিন্দু মহাসভার নেতা বীর সাভারকার ছিলেন গডসের দৃষ্টিতে নির্দোষ। এ কথা সবাই জানে যে, বীর সাভারকারের মত চরমপন্থি নেতাদের জন্যই মুসলমানরা আলাদা রাষ্ট্র দাবি জানিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে আহমেদাবাদে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সাভারকার ঘোষণা করেছিলেন যে, আজ ভারতেকে একটি দেশ ও একটি হিন্দু জাতি হিসেবে মেনা নেয়া যায় না। এখানে রয়েছে দু’টি জাতি- একটি হিন্দু ও আরেকটি মুসলিম। উপমহাদেশে বিভক্তির জন্য যে কয়’টি উস্কানিমুলক উক্তি দায়ী, সাভারকারের এ উক্তি হচ্ছে সেগুলোর একটি। পাকিস্তান সৃষ্টির অপরাধের জন্য কাউকে দায়ী করতে হলে সাভারকারকে সর্বাগ্রে দায়ী করা উচিত ছিল। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে গান্ধীর প্রতি গডসের আক্রোশের কারণ সত্যি দুর্বোধ্য। গডসে তার কার্যকলাপের ভার ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিয়েছে। থাক সে দায়িত্ব ইতিহাসের উপর।
দেলোয়ার জাহান সোহাগ
সভাপতি, চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব
[ তথ্য সুত্রঃ বিশ্বের আলোচিত বিশটি ঘটনা