মাতৃভাষা বাংলার বিকাশ ও উৎকর্ষ

0

391606_10151304972093408_544441539_n

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

পেশাঃ প্রকৌশলী, টেকনিক্যাল আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন, নেদারল্যান্ডস।

আধুনিক সময়ে বাংলা বিপনননের ভাষা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষা, কিছু পর্যায়ে কর্পোরেট ভাষা, শিক্ষার প্রাথমিক স্তর গুলোর ভাষা, শিল্পের অধুনা রূপ গুলোর ভাষা, স্থানীয় প্রশাসনের ভাষা হওয়ায় এর বিকাশ, প্রসার এবং ধারণ অব্যহত ভাবেই বর্ধমান। ভাষা কে প্রান ময় বলে ধরে নিলে এই ভাষা অবশ্যই জীবিত এবং সতেজ। বিশ্ব ব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি মানুষের চলনে বলনে ছন্দ ও রুচির সাথে বাংলা মিশে আছে।

বাংলা ভাষার বিকাশে একুশের ভুমিকা তাই শুধু প্রতীকী হয়েই পড়ে থাকে নি বরং প্রায়োগিক দিক থেকে যথেষ্ট কার্যকর হয়ে আবির্ভূত হয়েছে একুশ। বাংলার প্রতি পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষের এই আদি ও অক্রিত্তিম প্রানের টান এই মধুময় সুধাময় ভাষাটিকে চির সঞ্চালিত রাখবে তা সকল সংশয়ের আবকাশ মুক্ত বলাই চলে। বাংলা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার ভাষা। এর সচলতার অন্যতম কারন এটাই।

নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশে একজনও ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাভাষি না থাকলেও আমাদের এই প্রানের ভাষা কে ইংরেজি ও হিন্দির সাথে পাল্লা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের আদালত ও সংবিধান এর প্রধান ভাষা এখনও ইংরেজি, বাংলা এর আনুবাদ সংস্করণ। আদালতের রায় লিখিত হয় ইংরেজিতেই। অন্যদিকে হিন্দি বিনোদনের ভাষা, বিকৃত কথ্য বাংলায় এর অনুপ্রবেশ লক্ষণীয়। তাই বাস্তবিক অর্থে বাংলা হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ব্যাপক শিকার।

অন্যদিকে বাংলা এখনও উচ্চ শিক্ষার বা কারিগরি জ্ঞানের ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি, আসলে বলা উচিত আমরা এখন উচ্চ শিক্ষার ভাষা হিসেবে বাংলাকে মর্যাদা দিতে পারিনি। বলা হয়ে থেকে অপরের ভাষায় লিখিত কিংবা অনুবাদক্রিত শিল্প সাহিত্য বা দর্শন পড়ে যেমন আধ্যাত্বিক পর্যায়ে পৌঁছানো যায় না, ঠিক তেমনি অন্য ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেও এর উৎকর্ষে উঠা যায় না। এর জন্য চাই আগে নিজের ভাষার জ্ঞান বিজ্ঞানের হাতেখড়ি। আমাদের বিদ্যাপীঠ সমূহ বলতে গেলে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনও চৌকশ কর্পোরেট নির্বাহী কিংবা সেকেলে প্রশাসনের গতানুগতিক মানের আমলাই তৈরি করে যাচ্ছে। জীবিকার খাতিরে আমাদের মেধাবী রা ইংরেজি কেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন বা দিতে হচ্ছে। সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে এই প্রতিযোগিতা দিন দিন হয়ে পড়ছে অসম, এতে বাংলা পিছনে পড়ছে যার প্রভাব এখনই পশ্চিম বাংলায় দৃশ্যমান, পূর্ব বাংলায় এই প্রভাব অনুমেয়। অতি অদূরদর্শী ভাবে আমরা অগ্রসর বাঙালীরা প্রান প্রিয় ভাষাকে জীবিকা নির্বাহের ভাষা হিসেবে দূরে ঠেলে রেখে শুধু মাত্র প্রান্তিক আর অনগ্রসর কায়িক শ্রমজীবী মানুষের পেশা গত ভাষা হিসেবে রেখে দিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছি।

মাতৃভাষা বাংলার প্রাঠিস্থানিক বিকাশ এবং জ্ঞান বিজ্ঞান এর জগতে এর উতকর্ষে আমরা কতটুকু চিন্তাশীল, আন্তরিক আর দ্বায়িত্বশীল তা ভাবার কথা সময় বার বার আমাদের বিবেকের নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। একুশ এই বার্তা নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের কাছে হাজির হয় প্রতি বছর।

জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার বাইরে বাংলার ব্যাপক বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বিকাশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতই উত্তেজনাকর ভাবে আবির্ভূত যে ভাষার মান সংরক্ষণে এর অপধারার লাগাম টেনে ধরা নিতান্তই জরুরি মনে করছি । অধুনা রাজনীতির আর বিনোদন শিল্পের বিকৃত বাংলা এর মৌলিকতা কে চ্যালেঞ্জ করছে বললে বাড়াবাড়ি হবে না বোধ হয়। কিন্তু এতে বাংলার শৈল্পিক আবেদন যে দিন দিন বিসৃত ও মলিন হচ্ছে না নির্দ্বিধায় বালা যায়। আজকের বাংলা একদিকে যেমন যশোর ও নদীয়া জেলার সাধু বাংলা নয়, তেমনি কথ্য বাংলার শিল্পিত রূপটিও নয়। ভাষার প্রয়োগ উদাসীনতার এই কদর্য দিক একদিকে যেমন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ভাষা গুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে আজ ঠিক তেমনি এটি বাংলার শৈল্পিক দিকটিকেও একদিন হেয় করে বসবে।

তাই বাংলা একাডেমি কে শুধুমাত্র পারিভাষিক শব্দ খোঁজায় বছর পার করলে চলবে না, কিভাবে এই ভাষাকে বিজ্ঞান ও গবেষণার জগতে উৎকর্ষ ময় করা যায়, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে অন্য ভাষার আধিপত্য ছাপিয়ে টিকিতে রাখা যায় এবং ক্রমবিকশিত করা যায় সেই দিকে মনযোগী হতে হবে। বাংলা একাডেমি বাইরে দেশের তথ্য প্রযুক্তিবিদ আর প্রোগ্রামারদের ও এগিয়ে আসতে হবে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো আর শিক্ষানুরাগী অগ্রসর নাগরিক বৃন্দ প্রানের ভাষার উতকর্ষে নিবেদিত হবে এটাই প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *