খুব দারুণ একটা আইডিয়া আছে মাথায় আর হাতে টাকাও আছে পর্যাপ্ত। এই আইডিয়া আর টাকা নিয়ে একটা ব্যবসায় নেমে পড়লেন। আপনি খুব বিচক্ষণ, সারা পৃথিবীর খবর রাখেন। নিজেও একদিন বিল গেটস বা স্টিভ জবস এর মত বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে চান। সুতরাং আপনি ভাবছেন আপনার ব্যবসার কর্মকৌশলও হতে হবে ওই সব বড় ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের মত। কেননা, আপনার ধারণা কর্মকৌশল আর বিনিয়োগ বড় না হলে প্রতিষ্ঠান বড় হয় না! একজন স্টার্টআপ ব্যাবসায়ী হিসাবে যদি আপনার ব্যাবসায়িক ধারণা এমন হয়, তাহলে আপনি যত বিচক্ষণই হোন না কেন আপনি শতাব্দির সবচেয়ে বড় ভুল বিনিয়োগকারী হতে চলেছেন।
আসলে বড়সড় আরম্ভ সবসময় বড় কোম্পানির পক্ষেই মানায়। কেননা, তাদের আছে বৃহৎ গবেষণা টিম, বড় অনুষ্ঠান পরিচালনা, বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপনের সক্ষমতা আর দুনিয়া জোড়া বিশাল বাজার। তারা বাজারে আছে দীর্ঘদিন, তারা জানে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।
অ্যাপলের মত বড় কোম্পানি নতুন কোন পণ্য বাজারে আনলে বা নতুন কোন ব্যবসা আরম্ভ করলে তার সুচনা হবে বিশ্বব্যাপী এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। যেমন গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, এক বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্য দিয়ে তারা এক সাথে আইফোন ৮, আইফোন ৮ প্লাস ও আইফোন টেন বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি নভেম্বরে বাজারে আসবে আইফোন টেন, এখনই ক্রেতাদের অগ্রিম বুকিং ব্যবস্থা চালু করেছে। এটা অ্যাপলের পক্ষেই সম্ভব। কেননা আইফোন বাজারে আছে গত ১০ বছর ধরে। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ আইফোন ব্যবহার করেছে। সুতরাং তারা জানে আইফোন টেন কেমন হতে পারে। কাজেই আগ্রহীদের অগ্রিম বুকিং করতে কোন সংকোচ হবে না।
এবার ভাবুন তো, আপনার নতুন ফ্যাশন হাউজ, গার্মেন্টস, মেশিনারিজ বা ফুড ফ্যাক্টরি বা ফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে এমনটা সম্ভব কিনা? চলুন, এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌছায়।
কচ্ছপ গতি
সীমিত অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু করা স্টার্টআপ ব্যবসায়ীদের অন্য পা শক্ত অবস্থানে রেখে একটু একটু করে পুকুরে পা চুবিয়ে শীতের দিনে জলের তাপমাত্রা মাপার মত করে এগোনো উচিত, অর্থাৎ ধীরে ধীরে বাজারে প্রবেশ করা ভাল। তাতে হঠাৎ হাইপোথার্মিয়া হওয়ার সম্ভাবনা তথা হঠাৎ বিপর্যয় নেমে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। আপনিও একসময় ঘোড়ার গতিতে ছুটবেন, কিন্তু তার আগে ঘোড়া চালানো শিখতে হবে আর ঘোড়ার লাগামটা শক্ত করে ধরে নিতে হবে। তার আগ পর্যন্ত কচ্ছপ গতিতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যান।
প্রারম্ভিক বিপণন
আপনার ফ্যাশন হাউজের বিজ্ঞাপনের জন্য শুরুতেই কি দীপিকা পাড়ুকোন কে ডেকে আনবেন নাকি ফেসবুকে একটা পেজ খুলবেন? কোথায় দীপিকা পাড়ুকোন আর কোথায় ফেসবুক পেজ! নতুন ব্যবসার সঠিক বিপণনের জন্য এটা আপনার কাছে সস্তা উপায় মনে হতে পারে, যা বড় কোম্পানি কখনোই করে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা অর্থের প্রসঙ্গ নয়, অভিজ্ঞতার। পুঁজি যাই হোক, আপনার অভিজ্ঞতা যেহেতু কম, কাজেই ফেসবুকে পেজ খোলাটাই আপনার জন্য প্রথম সঠিক পদক্ষেপ হবে। দীপিকা পাড়ুকোনকে সেই দিনই ঘরে আনবেন, যেদিন তার মত বিশ্বসুন্দরী সামাল দেওয়ার শক্তি অর্জন করবেন।
গ্রাহক প্রতিক্রিয়া ও প্রতিদ্বন্দ্বীতা
ব্যবসায় প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে। কিন্তু তাই বলে প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে গিয়ে ব্যবসার প্রধান ফোকাস ক্রেতা সন্তুষ্টিতে মনোযোগ হারিয়ে ফেললে চলবে না। অধিকাংশ তরুণ স্টার্টআপ এই ভুলটা করেন। মনে রাখতে হবে, ব্যবসা ক্ষেত্রে আপনি এখনও শিশু। আর শিশুকে আগে নিজে দাঁড়াতে ও হাঁটতে শিখতে হয়, অন্যের সাথে যুদ্ধ নয়। এখনও যে শিশু নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, সে অন্যের সাথে যুদ্ধ করবে কীভাবে? সুতরাং ব্যবসায় শুরুতেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা নয়, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীর কর্মকান্ডের থবর রাখতে হবে। আর প্রধান ফোকাস দিতে হবে ক্রেতা সন্তুষ্টি ও ক্রেতার প্রতিক্রিয়ার দিকে। নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে ক্রেতা সন্তুষ্টির জন্য, প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য নয়। হতে পারে আপনার ইতিমধ্যে করা বিনিয়োগের মধ্যেই আরও ভাল কর্মকৌশল লুকিয়ে আছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
বিনিয়োগকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা
সম্পূর্ণ আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে বা ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করতে আপনার অন্য বিনিয়োগকারী প্রয়োজন হতে পারে। স্টার্টআপ অবস্থায় চাইলেই কি বিনিয়োগকারী পাওয়া যায়? না, এজন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। সবার আগে অর্জন করতে হয় কাঙ্খিত বিনিয়োগকারীর বিশ্বাস। মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকারী আপনাকে ব্যবসার জন্য নগদ অর্থ ঢালবে, সম্মান বা বাহবা নয়। এর বিপরীতে সে হিসাব কসে দেখবে তার বিনিয়োগ লাভ সব উঠে আসবে কিনা। সুতরাং এখানে আবেগের কোন জায়গা নেই। আপনাকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনার যোগ্যতা। আপনার প্রবৃদ্ধির কথা বিশ্বাস করতে বিনিয়োগকারীরা বাস্তব প্রমাণ দেখতে চাইবে। তারা সূক্ষ্ম নিক্তিতে মেপে নিবে আপনার সম্ভাব্যতা। সুতরাং ব্যবসার শুরুতে বিনিয়োগকারীর বিশ্বাসভাজন হতে প্রবৃদ্ধি কম হোক, তবুও সঠিক হিসাব রেখে ভাল আউটপুট আনার চেষ্টা করুন। কেননা, স্টার্টআপ শুরু করার চেয়ে বিনিয়োগকারীর সমর্থন আদায় করা বেশি কঠিন।
ঝড়ের মুখে ডিঙ্গি নৌকা
তরুণ উদ্যোক্তাদের ব্যবসা অনেকটা ঝড়ের মুখে ডিঙ্গি নৌকার মত। ডিঙ্গি নৌকা ঝড়ের মুখে পড়লে যেমন বাঁচার জন্য সব দিকে সমান নজর রাখতে হয়, তেমনি স্টার্টআপ ব্যবসায় সব দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। দ্রুত ছোট ব্যবসা বড় করার চিন্তায় অধিকাংশ উদ্যোক্তা সব দিক সামলানোর এই ব্যাপারটা ভুলে যায়, যা বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন ধরা যাক, আপনার একটা ই-কমার্স আছে। অন্য একটা কুরিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে আপনি পণ্য ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। এখন কোন একজন ডেলিভারি ম্যান আপনার কোন ক্রেতা সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে ক্রেতা কিন্তু কুরিয়ার কোম্পানির প্রতি অসন্তষ্ট হবে না, হবে আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি। সেজন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে কী দায়িত্ব দিচ্ছেন সেটা ভাল করে জেনে বুঝে নিন। এরকম খুব ছোট ছোট আরও অনেক বিষয়েও নজর রাখতে হয়।
যে যত পরামর্শই দিক, আপনার ব্যবসার ধরণ বুঝে আপনার নিজেকেই সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই পরামর্শগুলো সেই সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে মাত্র। শুভ কামনা প্রিয় উদ্যোক্তাগণ।