র্বোধ্য মুস্তাফিজ, সরল মুস্তাফিজ

ছোট্ট ঘর। এক পাশে রাখা শোকেসটা আর ‘শোকেস’ নেই; হয়ে গেছে ট্রফিকেস। ঠিক ট্রফির জন্য বানানোও হয়নি ওটা। কিন্তু মাত্র এক বছরে যে এত এত ট্রফি বাসায় আসবে, তা-ও কি কেউ ভেবেছিল? সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়ায় মুস্তাফিজুর রহমানের সেই শোকেসে আরও দুটি ট্রফি যোগ হলো। ২০১৫ সালের বড় দুটি পুরস্কারই যে জিতেছেন তিনি। বিচারকদের পাশাপাশি পাঠকের ভোটেও রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার ২০১৫ জিতেছেন এই কাটার মাস্টার।
এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন—তাঁর বেলাতেই এই কথা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভালো যায়। এখন হাত দিয়ে, নির্দিষ্ট করে বললে বাঁ হাত দিয়ে যা ছুঁয়ে দিচ্ছেন, হয়ে যাচ্ছে সোনা। পরশপাথরের সেই হাত নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আসার মাত্র আট মাসেই গত বছর যা যা করেছেন, তাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেছে সবার।
এ কারণেই হয়তো তামিম ইকবাল গত বছর টেস্ট-ওয়ানডে দুই ধরনের ক্রিকেটে দুর্দান্ত একটি বছর কাটালেও, মাহমুদউল্লাহ বিশ্বকাপে টানা দুটি সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়েও পেছনে। পাঠকদের দেওয়া দুই লাখেরও বেশি ভোটে মুস্তাফিজ বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন তো বটেই, বিচারকেরাও বেছে নিয়েছেন তাঁকে। দলের দুই বড় ভাইকে ‘রানারআপ’ বানিয়ে মুস্তাফিজই হয়ে গেলেন সেরা।
এই বড় ভাইয়েরাই তাঁর সব। সেটা দুই পরিবারেই, নিজ পরিবারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও তো তাঁর হয়ে গেছে সবচেয়ে বড় পরিবার। এই ভাইদেরই একজন, চার ভাইয়ের সবচেয়ে বড়জন মাফুজার রহমান ভাইয়ের হয়ে পুরস্কার নিয়ে বললেন, ‘আমাদের আদরের সবচেয়ে ছোট ভাইটি এখন তো শুধু আমাদের পরিবারের নয়; দেশেরই সব পরিবারের আপনজন হয়ে গেছে। দোয়া করবেন, যেন দেশের জন্য আরও গৌরব নিয়ে আসতে পারে।’
টানা ক্রিকেটের ধকল তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে তাঁকে ঘিরে মানুষের অন্তহীন উৎসাহ। মাত্রই আইপিএল খেলে ফিরেছেন। বাড়ি ছেড়ে কখনো এত দিন দূরে থাকেননি। কথা ছিল দেশে ফিরে ঢাকায় মামার বাসায় বিশ্রাম নিয়ে, বিসিবির ফিজিওর কাছে নিজের ফিটনেসের সর্বশেষ অবস্থার পরীক্ষা দিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবেন। এর ফাঁকে আসবেন অনুষ্ঠানেও। সেভাবে সব আয়োজন করেও রাখা হয়েছিল।
কিন্তু দেশের বিমানবন্দরে পা রাখতেই মন আর টানল না। বিদেশের মাটিতে থাকলে দেশ মায়ের বুকে ফিরতে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর দেশে ফিরলে সাদাসিধে মায়ের ঘামভেজা আঁচলের কোলে। আইপিএল খেলে ফিরে ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েই ফিরে গেছেন সেই চিরচেনা গ্রামে। পাঁচতারকা হোটেলের কৃত্রিম নীলচে জলে সাঁতরে কি আর মন ভরে? গ্রামের পুকুরের সোঁদা জলেই না আসল মজা! কবুতরগুলোর খোঁজ নেওয়াও তো বাকি।
মাফুজার কাল রাত ১০টা পর্যন্ত ছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে। তিনিই ফোন করে খবরটা দিলেন ছোট ভাইকে। মুস্তাফিজ দুকূলপ্লাবী ভালোবাসায় আপ্লুত। ফোনেই বললেন, ‘পাঠক আর বিচারক দুই পুরস্কারই পেয়েছি, এ জন্য আরও বেশি ভালো লাগছে। সবার দোয়া চাই। সাকিব ভাই, মুশফিক ভাইয়েরা আগে পেয়েছেন। আমি তাড়াতাড়িই পেয়ে গেলাম।’
দলের দুই বড় ভাইকে হারিয়ে পুরস্কার জিতেছেন, এ নিয়ে খেপাবে না তো? একটু খুনসুটি হলেও হতে পারে। তবে মুস্তাফিজ তৈরি, ‘সবাই তো আমার বড় ভাই, অনেক আদর করে। তিন লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছি। তামিম–রিয়াদ ভাই রে খাইয়ে দেবানে। দলের সবাইরেই খাওয়ানো দরকার।’
বললেন, ‘আরও ভালো করতে চাই’। কী হতে পারে সেই আরও ভালো! প্রতি ম্যাচেই তাহলে সাত-আটটা করে উইকেট নিতে হবে! রসিকতাটা বুঝলেন। ফোনের ও প্রান্ত থেকে সরল হাসিটা স্পষ্ট বোঝা গেল। বললেন, ‘তাইলে দোয়া করবেন, যেন এই রকমই থাকতে পারি।’
‘এই রকমই’ থাকতে চাওয়া শুধু বোলিংয়ের দুর্বোধ্যতায় নয়; মানুষ মুস্তাফিজের আশ্চর্য রকম সরলতাতেও!

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *