আসিফ ও বন্যার বিয়ে হয়েছে চার বছর। জীবনে ব্যস্ততা বাড়ছে, তাঁদের মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে যেন। বন্যার অভিযোগ, আসিফ তাঁকে আরেকটু সাহায্য করলে পারেন। আসিফেরও মনে হতে থাকে, বন্যার ছেলেমানুষি বাড়ছে। এতে দুজনের মধ্যে রাগ বাড়ছে এবং ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার একপর্যায়ে বন্যা তাঁর সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। এতে আসিফেরও রাগ হতে থাকে। দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
এ ঘটনা থেকে দেখলাম যে রাগ বাড়ার কারণে এবং দুজনের পক্ষ থেকে সমাধান না করার কারণে একসময় বিষয়টি বড় আকার ধারণ করল। এই রাগকে আমরা কীভাবে দেখি? ‘রাগ’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক চিন্তা চলে আসে। আমরা ভাবি, রাগ হচ্ছে খারাপ একটা কিছু। কিন্তু অন্য সব আবেগের মতো রাগও একটি আবেগ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চলার পথে একজন আরেকজনের প্রতি রাগ-অভিমান হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে ক্ষেত্রে রাগ প্রকাশ চলেও আসবে। কীভাবে রাগ প্রকাশ করছি, তা একটি বিবেচনার বিষয়।
এই রাগের সূত্রপাত কোথায়? আমাদের আবেগের সূত্রপাত আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেই আছে। চারপাশ থেকে দেখে শিখে থাকি এবং নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে বড় হই। মা-বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল বা একজন আরেকজনের সঙ্গে আবেগের প্রকাশ কেমন ছিল, তার ওপরও নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে।
অতিরিক্ত রাগ আরেকজন সঙ্গীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর দাগ অনেক দিন পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, রাগের মাত্রা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে, যার পরিণতি দুজনের জন্যই খারাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা এবং অনেক সময় অন্যের গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত গড়ায়। আবার দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রী একজনের সঙ্গে আরেকজনের রাগ সন্তানদের কাছে প্রকাশ করছেন, যা সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আরেকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি যে কষ্ট বা রাগ জমা হয়েছে, তা আশপাশের সবাইকে বলছেন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। অনেক সময় দেখা যায়, দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও চারপাশের মানুষের কথা শুনে আরেকজনের মধ্যে তা নিয়ে ক্ষোভ থাকতে পারে, যা অনেক সময় বিষয়টা সমাধানে বাধা দেয়।
আমাদের রাগ-কষ্ট-অভিমান সবচেয়ে বেশি হয় কাছের মানুষের কোনো ব্যবহারে। তাদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা বেশি থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তেমন। কিন্তু অনেক সময় এই কষ্ট, চাওয়া-পাওয়ার বেদনা অনেক দিন পর্যন্ত ধরে রাখি এবং প্রতি মুহূর্তে তা প্রকাশ করতে থাকি। অনেক সময় দেখা যায়, বিয়ের ১০-১৫ বছর আগের কথা চলে আসছে ঝগড়ার সময়, যার কারণে ঘটনাটির কোনো সমাধান না হয়ে বরং সম্পর্কটি আরও তিক্ততার রূপ দেয়।
রাগের সময় যুক্তিবোধ কাজ করে না। তাই যখন খুব রেগে যাবেন, একটু থেমে যেতে পারেন। পরে আফসোস করার থেকে আগে একটু ভেবে নিন কী করবেন বা কী বলবেন। যদি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অসুবিধা হয়, তবে স্থান বদলে ফেলুন। যখন আপনি মনে করবেন আপনি কথা বলার জন্য প্রস্তুত, তখন সঙ্গীকে আপনার অসুবিধার কথা বলতে পারেন। যদি মনে হয় বাইরের কারও সাহায্য প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত কাউকে বলুন, যিনি আপনাদের দুজনের কথাই শুনবেন এবং আপনাদের কথা গোপন রাখবেন। একজন সঙ্গী রেগে গেলে আরেকজন তখনই তাঁকে কিছু না বলে পরে বলতে পারেন।
সম্পর্ক আরও সুন্দর করে তুলতে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে নিজেদের মতো কিছু সময় কাটানো যেতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততার অজুহাতে একসময় একজন আরেকজনের অনেক দূরে চলে যাই, যা আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না। একটা সমাধান হতে পারে দিনে বা রাতে দুজন মিলে প্রতিদিনের জন্য একটা সময় ঠিক করা, যখন অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে আপনারা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। পরস্পরের সারা দিনের ভালো লাগা ও খারাপ লাগার কথা শেয়ার করতে পারবেন। কিছু বিষয় হয়তো থাকতে পারে, যার মনঃকষ্ট আপনি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। খাবারের টেবিলের ঝগড়া হয়তো কোনোভাবে আপনার সেই পুরোনো কষ্ট বা রাগের কারণ হয়ে যাচ্ছে, যা আপনাদের সম্পর্কের অন্তরায়। খুঁজে বের করতে পারেন পুরোনো কিছু, যা আপনাকে এখনো আঘাত দেয়। এমন কিছু যদি থাকে, সঙ্গীর সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ক্ষমা করে দিয়ে নতুনভাবে শুরু করতে পারেন। আবার এমন যদি কিছু থাকতে পারে যে রাগ করে আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, যার জন্য আপনার কখনো সরি বলা হয়নি। সেটা অপরজনের জন্য অপেক্ষা না করে থেকে সরি আপনিই বলতে পারেন। সঙ্গীর কাছে সরি বললেই আপনি ছোট হয়ে যাবেন না, বরং এটা আপনাদের সম্পর্ক আরও ভালো করে তুলবে।
আমরা একজন আরেকজনের প্রশংসা করতে পারি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও আনন্দিত করে তুলতে পারে। এটা হতে পারে আরেকজনকে প্রশংসাসূচক কথা বলে, ফুল অথবা ভালো লাগার ছোট কিছু উপহার দিয়ে। এতে সঙ্গীর একজন আরেকজনের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করবে এবং একজন আরেকজনের প্রতি রাগ কমাতেও সহায়ক হবে।
আমাদের একেকজনের রাগের ধরন একেক রকম এবং তার সমাধানও একেক রকম। রাগের মাত্রা বেশি হয়ে থাকলে এবং আপনি তা থেকে যদি বের হতে না পারেন, তবে বিশেষজ্ঞ কারও পরামর্শ নিতে পারেন, যিনি আপনাকে রাগের কারণ ও এর প্রতিকার বের করে দিতে সাহায্য করবে। ইতিবাচকভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।
লেখক: কাউন্সেলর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়