তুমি, দিন থাকিতে
দিনের সাধন কেন করলে না
সময় গেলে
সাধন হবে না
_______________ লালন শাহ
বহুদিন আগে লোকমুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। এই গল্পের মুল লেখক বা কথক কে তা জানি না, তবে সেই অজানা লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি –
এক অভাবী লোক কিছু বাকি (পরে মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতি) কেনাকাটা করার আশায় গ্রামের শেষ মাথার মুদি দোকানে গিয়ে দেখলো দোকানের সামনে একটা সাইনবোর্ডে লেখা, “আজ নগদ, কাল বাকি”। সাইনবোর্ড পড়ে লোকটা খুশি মনে বাড়ি ফিরে গেল এই ভাবনায় যে, আজ নগদ কেনাকাটা করতে হবে ঠিক, কিন্তু আগামীকাল নিশ্চয় বাকি পাওয়া যাবে! বোকা লোকটা দ্বিতীয় দিন আবার একই সাইনবোর্ড দেখলো, আজ নগদ, কাল বাকি। আগামীকালের আশায় সে আবার বাড়ি ফিরে গেল। তৃতীয় দিন, চতুর্থ দিন, একই সাইনবোর্ড, একই লেখা! লোকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল; তার আগামীকাল আর আসে না!
এই বোকা লোকটার গল্প পড়ে নিশ্চয় হাসি পাচ্ছে? পেতেই পারে, কিন্তু তার আগে চলুন নিজেদের হিসাবটা একবার মিলিয়ে নিই!
আজ থাক, আগামীকাল থেকে শুরু করব
আজ থাক, আগামীকাল থেকে শুরু করব বা আগামীকাল থেকে সব ঠিকঠাক করব। সারাদিন একটা রুটিন মাঠিক চলব, নিয়ম মেনে পড়ব, সব কাজ সময়মত করব। আগামীকাল থেকে আমার জীবন হবে শুধু সাফল্য যাত্রার।
থামেন জনাব, আগামীকাল কেন? আজকের দিনটা কী দোষ করেছে? আজ যাকে আগামীকাল বলছেন, ওই মুদি দোকানের সাইনবোর্ডের মত আগামীকাল তো তা আজ হয়ে যাবে। তখন কি আবার বলবেন, আজ থাক, আগামীকাল থেকে শুরু করব?
এমনিভাবে আজ থাক, আজ থাক, বলতে বলতে জীবন থেকে কতগুলো অমূল্য “আজ” মিছেই হারিয়ে ফেলেছেন তার হিসাব মেলানোর চেয়ে মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়ে গুনে দেখা ঢের সোজা!
আপনি জীবনে যতগুলো “আজ” হেলায় নষ্ট করেছেন, হয়তো পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ঠিক ততগুলো আজ যথার্থ ব্যবহার করে অন্য কেউ ইতিমধ্যে সাফল্যের চুড়া ছুঁয়েছে।
স্টপ কিলিং টাইম
ইংরেজিতে বলে “Stop killing time” অর্থাৎ সময় নষ্ট করা বন্ধ করো। সময় কত মূল্যবান তা বোঝা যায় যখন ১ মিনিটের জন্য কেউ ট্রেন মিস করে, কয়েক মুহুর্তের সচেতনতার অভাবে কেউ ভয়ংকর কোন দুর্ঘটনায় পড়ে অথবা খুব কাছের কেউ মারা যায়।
এই মাত্র হাসতে হাসতে যে সেকেন্ড পার করলেন, সারা জীবন ঈশ্বরের কাছে কান্নাকাটি করেও ওই সেকেন্ডটা আর ফিরে পাবেন না। সুতরাং, অযথা সময় নষ্ট করা এই মুহুর্ত থেকে বন্ধ করুন।
মহাপ্রস্তুতি
আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন এমন অনেক দিন পার করেছি যে, আগামীকাল থেকে পরীক্ষার পড়া শুরু করব বলে আজ সারাদিন পড়ার টেবিল, ঘর, কাপড় গুছিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। কেননা কাল থেকে এত বেশি পড়াশোনা করব যে, এইসব গোছানোর সময় একদমই পাব না। বাস্তবতা হল, পরদিন স্কুল শেষে এমন কিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি যার আনন্দে বা ব্যস্ততায় গতকালের পরিকল্পনার কথা একদমই ভুলে গেছি। তারপর দিন শেষে মনে হয়েছে, আজ তো আর পড়া শুরু করা হল না, কাল থেকে নিশ্চয় শুরু করব।
এখন বুঝি, আগামীকাল নিয়ে ওই মহাপ্রস্তুতি কতটা খারাপ ছিল। কেননা, দিনগুলো কেবল চলেই যেত, আর পরীক্ষার আগের রাতে আমার কান্নাকাটি লেগে যেত।
আমাদের মধ্যে আর এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা সময়ের ব্যাপারে অতি সচেতন। তারা সময় নষ্ট করতেই চায় না, তাই বারবার ভাল করে কাজ করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এভাবে সময় নষ্ট না করতে চাইতে চাইতেই পরিকল্পনা করতে গিয়ে নিজের অজান্তে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলে।
সুতরাং পরীক্ষা বা কাজ নিয়ে আগামীকালের এমন মহাপ্রস্তুতি নেওয়া বন্ধ করে আজ থেকেই কাজে লেগে যান।
দিবা স্বপ্নের কল্পিত সুখ
এক বুড়ো মাথায় করে কিছু হাঁস মুরগির ডিম নিয়ে যাচ্ছে বাজারে বিক্রি করতে। ডিমগুলো তার পোষা হাঁস মুরগিতে পেড়েছে। বুড়ো হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখছে, এই ডিমগুলো বিক্রি করে তার বেশ কিছু টাকা হবে। সেই টাকা দিয়ে আরও কিছু হাঁস মুরগি কেনা যাবে। সেই হাঁস মুরগিতে আরও বেশি বেশি ডিম দেবে। সেই ডিম বেচে তার আরও বেশি টাকা হবে। এভাবে একদিন সে এতটা ধনী হবে যে ছেলের বউ তাকে আর সমীহ না করে পারবেই না। নত মস্তকে সামনে এসে বলবে, বাবা দুপুরের খাবার খেয়ে নিন। তখন বুড়ো ধমক দিয়ে বলবে, “না, আমি খাব না।” এই “না, আমি খাব না” কথাটা বলতে গিয়ে মাথাটা এত জোরে ঝাঁকি দেয় যে মাথার ডিমের ঝুড়িটা মাটিতে পড়ে সব ডিম ভেঙে যায়। ডিমগুলোর সাথে সাথে এত সময় ধরে দেখা বুড়োর কল্পিত সুখও মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
আমাদের মধ্যে এমন অনেকই আছে যারা দিবা স্বপ্নে ভোগে; কল্পনায় গাড়ি, বাড়ি, কলকারখানার মালিক হয়ে যায় আর সুন্দরী স্ত্রী বা সুদর্শন স্বামীকে নিয়ে ভোগ বিলাশে জীবন কাটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর এই মোহ যখন ভাঙ্গে তখন দেখে, সর্বশেষ তার যে কাজটা করার কথা ছিল তার সময় ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
এমন দিবা স্বপ্ন আগামিকাল করব বলে কাজ ফেলে রাখার মতই ক্ষতিকর। ভেবে দেখুন তো, জীবনে কতবার লম্বা সময় ধরে এমন দিবা স্বপ্ন দেখেছেন? শুধু মাত্র ঐ দিবা স্বপ্ন দেখার সময়টা যদি যথাযথ ব্যবহার করতেন তাহলে হয়তো ঐ স্বপ্নটা এতদিনে বাস্তবে রুপ দিতে পারতেন।