দ্বিতীয়ার্ধে খেলার জন্য মাঠে নামার আগে সতীর্থদের উজ্জীবিত করার জন্য কথা বলতে দেখা গেলো মার্সেলোকে। সতীর্থের ঝাঁঝালো কথায়ই হোক কিংবা দলের প্রয়োজনটা সবাই বুঝেই হোক দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের আক্রমণের পরিমাণ বাড়তে থাকলো। প্রথমার্ধের চেয়ে দ্বিতীয়ার্ধে বেলজিয়ামের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে ব্রাজিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি তাদের প্রচেষ্টা। ব্রাজিলের একের পর এক আক্রমণ গিয়ে থেমেছে কখনো বেলজিয়ামের রক্ষণে, আবার কখনো থিবো কোর্তোয়ার কাছে।
শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল ইউরোপের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বেলজিয়ামের কাছে হেরে গেছে ২-১ গোলে। বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় রাশিয়ার কাজান এরিনা স্টেডিয়ামে ম্যাচটি শুরু হয়। এই সেই কুখ্যাত কাজান এরেনা যেখানে স্বপ্নের সমাধি হয়েছে বিশ্বকাপের ফেবারিটদের। কাজান এরেনা যেন ফেবারিটদের জন্য অপয়া এক মাঠ। গ্রুপ পর্বে এই মাঠে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি।
এরপর কাজান এরেনা থেকে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা। সেই মৃত্যুকূপ কাজান এরেনাতে যখন ব্রাজিলের খেলা তখন ব্রাজিলের ভক্ত-সমর্থক বিষয়টি ভেবেছিলেন কিন্তু হয়তো অপয়া কাজান এরেনা নান্দনিক ফুটবলের ধারক-বাহককে বিদায় করে দিবে সেটা হয়তো ভাবেননি।
ব্রাজিলের বিদায় কাজান এরেনার কাছে হেরে হয়নি, ব্রাজিলের বিদায় ঘন্টা বেজেছে বেলজিয়ামের শক্তিশালী রক্ষণ, মহাপ্রাচীরের মতো গোলপোস্টের নিচে দন্ডায়মান বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া এবং ভাগ্যের কাছে। ব্রাজিল একের পর এক আক্রমণ করেও গোল পায়নি। কিন্তু বেলজিয়াম আক্রমণ প্রতিহত করার পরপর প্রতি আক্রমণে গিয়ে ব্রাজিলের রক্ষণ চিরে গোল করেছে।
বেলজিয়ামের প্রশংসা করতেই হবে। তারা নিজেদের ঘর সামলিয়ে ব্রাজিলের ঘরে হানা দিয়েছে বার বার। তার মধ্যে দুইবার সফলও হয়েছে। যদিও প্রথম গোলটি হয়েছে হয়েছে আত্মঘাতি। কিন্তু কেভিন ডি ব্রুইনার দ্বিতীয় গোলটির কোনো জবাব নেই। ব্রাজিলের আক্রমণ প্রতিহত করার পর দ্রুত প্রতি আক্রমণে উঠে গিয়ে বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক শটে ব্রাজিলের জালে বল জড়ান কেভিন ডি ব্রুইনা।
তাতেই কাটা পড়েছে ব্রাজিলের ষষ্ঠ বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের মিশন। গতকালের কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের কাছে প্রত্যাশা ছিলো অনেক। বেলজিয়াম এবং ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল খেলে ফুটবল ভক্তদের প্রত্যাশার সবটুকুই পূরণ করেছেন। কি ছিল না ব্রাজিল-বেলজিয়ামের ম্যাচে! দূর্দান্ত শট থেকে গোল, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ, গোলপোস্টে লেগে বল ফিরে আসা, গোলের সুযোগ মিস, গোলরক্ষকের দূর্দান্ত সব সেভ।
সবকিছু মিলিয়ে এক ‘ধ্রুপদী’ ফুটবলের মঞ্চায়ন হয়েছে কাজানে। কিন্তু গতকালের ম্যাচে বেলজিয়ামের জয়ের সবচেয়ে বড় নায়ক থিবো কোর্তোয়া। চেলসির এই গোলরক্ষক ব্রাজিলের ফরোয়ার্ডদের সামনে ছিলেন চীনের মহাপ্রাচীরের মতো। ব্রাজিলের দুর্দান্ত সব আক্রমণ এক বার নয় মোট ৯ বার সেভ করেছেন।
যেখানে কিছু ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিটে নয়বার গোলপোস্টের দিকে আক্রমণ হয় না সেখানে কোর্তোয়া নয়বার দলকে রক্ষা করেছেন। ব্রাজিলের ‘মিশন হেক্সা’ এক কোর্তোয়ার কাছেই বাধাগ্রস্ত হয়ে সেটা ২০২২ সালে কাতারে নিয়ে গেছে। গতকালের হারের জন্য ব্রাজিলের সমর্থকরা থিবো কোর্তোয়াকে মনে রাখবেন। তবে শুধু থিবো কোর্তোয়া নয় ব্রাজিলের হারের জন্য দায়ী করা যেতে পারে ভাগ্য এবং ব্রাজিলের ফরোয়ার্ডদের নিশ্চিত কিছু গোল মিসকেও। তবে রক্ষণভাগে ক্যাসেমিরোর অভাবটা খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছে ব্রাজিল।
ক্যাসেমিরো না থাকায় ব্রাজিলকে রক্ষণ সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে গতকালের ম্যাচের শুরুতে এগিয়ে যেতে পারতে ব্রাজিল। কিন্তু ম্যাচের আট মিনিটের সময়ে ব্রাজিলের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সাইড পোস্ট। নেইমারের কর্ণার থেকে থিয়াগো সিলভা হেড করেন কিন্তু সেটি সাইডপোস্টে লেগে ফিরে আসে। তিন মিনিট পর আবারও সুযোগ পায় ব্রাজিল। কিন্তু উইলিয়ানের কর্ণার থেকে পাওলিনহোর ভলি বেলজিয়াম ডিফেন্ডাররা প্রতিহত করেন। গতকালকের দূর্ভাগ্য পীড়িত ব্রাজিলের কপালে শনির দশা লাগে ‘আনলাকি থার্টি’ বা ১৩ মিনিটে। এডেন হ্যাজার্ডের নেওয়া কর্ণার কিক ক্লিয়ার করার জন্য হেড করতে লাফিয়ে উঠেন ফার্নান্দিনহো। কিন্তু বল তার মাথায় না লেগে বাহুতে লেগে নিজেদের জালে বল জড়ায়। আত্মঘাতি গোলে পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল।
কিন্তু বেলজিয়াম এগিয়ে গিয়েও নিজেদের আক্রমণ ধার কমায়নি। কারণ তারা জানতেন এক গোল কখনোই নিরাপদ নয়। তাই বেলজিয়াম বার বার প্রতি আক্রমণে গিয়ে গোলের চেষ্টা করতে থাকে। ৩১ মিনিটে সেটার ফলও পায়। রোমেলু লুকাকু দ্রুত গতিতে বল নিয়ে উঠে যান। এরপর তিনি বল পাস করেন ম্যানসিটির ফরোয়ার্ড কেভিন ডি ব্রুইনার কাছে।
ব্রুইনা শক্তিশালী এক শটে ব্রাজিলের জালে বল জড়ান। প্রথমার্ধেই ব্রাজিল পিছিয়ে পড়ে ২-০ গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচে ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা চালায় ব্রাজিল। একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। ৭৬ মিনিটে সফল হয় টিটে শিষ্যরা। বদলি হিসেবে মাঠে নামা রেনাতো অগাস্টো ব্রাজিলের পক্ষে এক গোল পরিশোধ করেন।
কর্ণার থেকে হেড করে অবশেষে তিনি কোর্তোয়াকে পরাস্ত করেন। তখনও মনে হচ্ছিলো খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে। ব্রাজিল গোল পরিশোধ করবে এমনটাই বার বার মনে হয়েছে। ৮৪ মিনিটে সেই সুযোগও এসেছিলো ব্রাজিলের কাছে। কিন্তু ম্যাচের সবচেয়ে সহজ সুযোগটি নষ্ট করেন ফিলিপে কৌতিনহো। নেইমারের কাছে থেকে বক্সের মধ্যে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা কৌতিনহো বল পেয়েও সেটি বক্সের উপর দিয়ে মারেন।
নির্ধারিত সময় শেষে অতিরিক্ত পাঁচ মিনিট যোগ করা হয়। সেখানেও সুযোগ এসেছিলো ব্রাজিলের। কিন্তু ব্রাজিলের সামনে আবারও চীনের মহাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়ান সেই থিবো কোর্তোয়া। নেইমারের দূর্দান্ত এক শট হাত দিয়ে ঠেকিয়ে বক্সের উপর দিয়ে পাঠিয়ে দলকে রক্ষা করেন। সেই সাথে ব্রাজিলের রাশিয়া বিশ্বকাপ মিশনও শেষ হয়ে যায়। আবারও চার বছরের প্রতীক্ষা। ২০২২ সালে কাতারে আবারও ‘মিশন হেক্সা‘ নিয়ে ফিরবে ব্রাজিল। তবে মার্টিনেজের বেলজিয়াম এবারের বিশ্বকাপটা ঘরে তুলতে চাইবে। বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে বেলজিয়ামকে পার হতে হবে ফ্রান্সকে।
Featured Image: hindustantimes.com
SOURCE: http://khela.co/football/brazil-vs-belgium/