কাজী জহিরুল ইসলামের ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী কসোভোর পথে-প্রান্তরে -এক

ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাট এসে আমাদের তিনজনকেই ভিজিয়ে দিয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আকাশ তার রঙ বদলে ফেললো। সূর্য ঢাকা পড়েছে ভারী একখন্ড কালো মেঘের নিচে। মেঘের টুকরোটির চারপাশে একটি সোনালী রঙের বর্ডার তৈরী হয়েছে।
আসলে ঝড়-ঝাপ্টাকে নববর্ষ থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই, এটা অবধারিত। মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে নতুনের কেতন উড়াতে আজো নববর্ষ আসে। তবে ঢাকা শহরে এখন আর ঝড়ের পরে প্রকৃতির স্নিগ্ধরূপ দেখার কোন সুযোগ নেই। জলাবদ্ধতা, যানজট এবং জনজট মিলে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় সৃষ্টি হয়। সে কারণে তড়িঘড়ি করে খনিকটা কাকভেজা হয়েই আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছুতে হলো।
১৪ এপ্রিল ২০০০। জিয়াতে ঢুকে আমার স্ত্রী মুক্তি এবং ছোট ভাই বিটনকে হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। মনে মনে আশা করছিলাম বোখারী, মতিন অথবা রাখাল বাবু এদের কাউকে না কাউকে পাবো। কিন্তু আশে-পাশে তাকিয়ে যখন কাউকেই পেলাম না, সোজা গিয়ে এসকিউ-র কাউন্টারে হাজির হলাম। বোর্ডিং পাশ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। বেল্টে লাগেজ তুলতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো সবাই একসাথে বোর্ডিং কার্ড না নিলোতো প্লেনে গিয়ে আলাদা আলাদা বসতে হবে। ট্রলিতে ফের ব্যাগ দুটো তুলে ঠেলতে ঠেলতে ওয়েটিং কর্ণারে গিয়ে বিষণ্ন মুখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত প্রায় সোয়া দশটা সময় কর্ণেল রাখাল সপরিবারে এসে ঢুকলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন তার স্ত্রী এবং তিন পুত্রের সাথে।
কিছুক্ষণ পরেই বোখারীর আনারী হাতে বাঁধা লাল রঙের টাইটা চোখে পড়লো, পিছনে ওর স্ত্রী-কন্যা। তিনজন মিলে যখন আড্ডা জমিয়ে তুলেছি ঠিক তখন এসে ঢুকলেন মতিন সাহেব। আমারই মতো একা। অথচ কথা ছিলো তিনিই আসবেন সবার আগে।
সম্ভবত সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের আমরাই শেষ যাত্রী। লাগেজ বুক করতে লাইনে দাঁড়ালাম, এমন সময় খুরশিদ আনওয়ার ওর বিশাল তরমুজ আকৃতির ভুরিটা দোলাতে দোলাতে এসে দাঁড়ালেন।
লাগেজ তুলে দিয়ে, বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশনে ঢুকে পড়লাম। এক ফাঁকে বোখারী কায়দা করে বোর্ডিং পাশ ইস্যুকারী নাযকোচিত মুখশ্রীর যুবকটিকে বলে দিলো আমাদের দুজনের সীট যেন পাশাপাশি হয়। ততৈবচ। এরি মধ্যে যুবকটি আবার আমাকে চিনে ফেললো। আমার লেখা একটি টিভি নাটকে (আপন আলয়ে) ওর অভিনয় করার কথা ছিলো। মন্দ কপাল আমাদের সকলেই, শেষ পর্যন্ত নাটকের কাজটি আর এগোয়নি।
ইমিগ্রেশন অফিসার যখন কাগজপত্র দেখে বুঝলেন আমরা জাতিসংঘ মিশনে কাজ করতে কসোভো যাচ্ছি তখন খানিকটা আদপের সঙ্গে বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে “স্যার” সম্বোধন করে বললেন, আপনারা সরাসরি কাউন্টারে চলে যান। আরোহনপত্র (এম্বারকেশন কার্ড) জমা দিয়ে অভিবাসন কক্ষ (ইমিগ্রেশন) পেরিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এখান থেকে দেশের অভ্যন্তরে, আসলে আরো নির্দিষ্ট করে বললে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে, বিনা পয়সায় টেলিফোন করার একটি ব্যবস্থা ছিলো। এইতো সেদিন, গত জুনে আমি কোপেনহেগেন যাওয়ার পথে এখান থেকে বাসায় টেলিফোন করেছিলাম। অথচ টেলিফোন সেটটি এখন আর কোথাও দেখছি না। মুক্তিকে কথা দিয়েছিলাম এখান থেকে ফোন করবো। হলো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো প্রায় দুমাস আগে ওটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেরামতের জন্য নেওয়া হয়েছে, এখনো ফিরে আসেনি।
বোখারী খুব ঘন ঘন সিগারেট খায়। হাতে সময় নেই জেনেও ও আমাকে এক রকম টানতে টানতে নিয়ে গেলো স্মোকিং জোনে। বহুমুখী বহু ব্রান্ডের সিগারেটের ধোঁয়ায় অঞ্চলটি দুর্গন্ধের নরকে পরিনত হয়েছে। সাফোকেশন আমার একদম সহ্য হয় না, তার ওপর পরোক্ষ ধুমপানের (প্যাসিভ স্মোকিং) সমান ক্ষতি গোদের ওপর বিষফোঁড়া বৈ-তো আর কিছু না। ভদ্রতার বলি, কি আর করা যাবে, ভদ্র সাজা আসলে খুবই কঠিন কাজ। বসে বসে নিকোটিন গিলছি। এ নরক থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্যই বোধ হয় ঘুম ঘুম কণ্ঠে বিমানবন্দরের ঘোষিকা নাকী সুরে আহবান জানালেন SQ419-এর যাত্রীদের এক নম্বর গেট দিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশী সেরে নেবার। হ্যান্ডলাগেজে ট্রলি না থাকার কারণে এয়ারপোর্টের লম্বা লবি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোখারী এবং মতিন ক্লান্ত হয়ে গেলো। বিরক্তিতে দুজনেরই মুখ এখন বাংলা পাঁচ। এই মুহূর্তে আমার বিসমিল্লাহ খাঁর শানাই শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। আনন্দে ও বিষাদের মিশ্র অনুভুতিকে প্রকাশ করার জন্য শানাইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আজকের দিনটি আমার জন্য একদিকে যেমন হর্ষমুখর অন্যদিকে বিষাদক্রান্ত।ছ’মাসের জন্য স্ত্রী-সন্তান এবং আমার প্রিয়তম মৃত্তিকাকে ছেড়ে যেতে হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাও যাচ্ছি এমন এক জায়গায় যেখানকার কথা শুনলেই সকলে আঁতকে উঠছেন। অন্যদিকে এই সুযোগটি পাবার জন্য গর্বও বোধ করছি। যুদ্ধের দ্রোহে পোড়া স্বাধীনতাকামী একটি জাতির মানবিক আহবানে সাড়া দিতে পেরে নিজেকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা ভাববার এই অবকাশটুকু কি এক বিরাট প্রাপ্তি নয়? আরো একটি বিশেষ কারণে আজকের দিনটি আমার কাছে বেশ তৎপর্যপূর্ণ। এইতো মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, আজ বিকেলেই যাদুঘর মিলনায়তনে নববর্ষ উদযাপনের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান আমি কবি জসীম উদ্‌দীন পুরস্কার ১৪০৬ গ্রহণ করলাম। পুরস্কার গ্রহণোত্তর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন পুরস্কৃত ব্যক্তিত্ব সব্যসচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দকে দেখে একদিকে যেমন লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম অন্যদিকে মনে হচ্ছিলো আমার বয়সটাও যেন এক লাফে মান্নান ভাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যে কোন স্বীকৃতিই বুঝি এমনি করে মানুষের দায়িত্ববোধের বয়স বাড়িয়ে দেয়। টের পাচ্ছি কসোভো মিশনে কার করার সুযোগটিও প্রতি পদক্ষেপ আমার দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে তুলছে।
এখন আমরা বিমানের খুব কাছাকাছি। অসহিষ্ণু যাত্রীদের অস্থির অপেক্ষার সাথে বেমানান একটি ত্রিশ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভির স্ক্রিনে সাদাকালো ঝাপসা ছবি নদীর ঢেউয়ের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাড়ে এগারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। আটটা এবং দশটার কোনো খবরই দেখা হয়নি। অবশ্য অন্য অনেকের মতো বিটিভির খবরের প্রতি আমারও জোরালো অনাগ্রহ রয়েছে। দুই রমনীর ছবি বদলের নাটক আর তাদের বাহারী শাড়ী-মেকাপ প্রদর্শনী আর কতোদিন ভালো লাগে। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় দেশের চৌদ্দ কোটি মানুষ বুঝি আজ বাইশ হাত শাড়ির পেঁচে ফেঁসে গেছে। খবরের প্রতি অবশ্য আমার আজকের আগ্রহটা ব্যক্তিগত। যেহেতু আজ বিকেলে আমি পুরস্কারটি গ্রহণ করেছি ক্ষমতাসীন দলের একজন মন্ত্রী পদমর্যাদার অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে, কাজেই বিটিভি এটা প্রচার করবেই।
বিধি বাম। সাড়ে এগারটার খবর শুরু হবার আগেই ডাক এলো বিমানে চড়ার। হুড়োহুড়ি করে যে কোনো যানবাহনে চড়া আমাদের প্রায় ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা বাস, টেম্পু কিংবা বিমান যাই হোক না কেনো। সেই চিরায়ত ঐতিহ্যকে আজও উপেক্ষা করা গেলো না। দৃশ্যটা খুব হাস্যকার হলেও এই এক দঙ্গল অসহিষ্ণু বাঙালির হুড়োহুড়ি থামাতে এগিয়ে এলেন লিলিপুট আকৃতির একজন রোগা, টিঙটিঙে বন্দর কর্মকর্তা। তিনি তার সরু অথচ দৃঢ় হাতটি বাড়িয়ে বললেন ব্রিজ ভেঙে যেতে পারে। বাঙালীর সাহসে বুঝি চির ধরেছে। অমনি সবাই লেজ গুটিয়ে সুরসুর করে লাইনে দাঁড়ালেন। আসলে অনৈতিক কাজে বাঁধা পেলে ভাটা পড়বেই। আমাদের উচিৎ বাঁধা দেওয়া। নৈতিকতার পক্ষে সাহস বাড়ানো দরকার। মতিন সাহেব অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, ভীষণ আমুদে লোক। ওকে বললেন, ভাইঙ্গা যাইতে পারে এমুন জিনিস রাখছো ক্যা? মতিন সাহেবের এই “ক্যা” শব্দটি আমার কানে যেনো ক্রমাগত গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে লাগলো। আসলেইতো, এ দেশে এমন অনেক জিনিসইতো আছে যেগুলি যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটাতে পারে। মানুষের জীবনের মূল্য কত কম!
মনে পড়ছে ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ট্রাজেডির কথা। কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না যে জগন্নাথ হল তার স্বাভাবিক আয়ু অতিক্রম করেছে অনেক আগেই, যেকোনো মুহূর্তে ধ্বসে পড়ে ভয়াবহ বিপদ ঘটাতে পারে? জেনেও আমরা কাকের চক্ষুমুদে খাবার লুকোনোর মতো লুকিয়ে রাখতে চাই সবকিছু। জান-মানল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে দায় এড়াতে চাই।
প্লেনে উঠে আমি এবং বোখারী পাশাপাশি বসেছি। আঁড়চোখে রাখাল বাবু একটু দেখে নিলেন। কারণ তিনি হয়তো চেয়েছিলেন বোখারী ওর সাথে বসুক। পূর্ব তিমুরে ওরা এক সঙ্গে কাজ করেছে। সেই সুবাদে কিছুটা বন্ধুত্ব হয়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক। ভ্রমণের একঘেয়েমী কাটানোর জন্য পূর্ব পরিচিতের সঙ্গ প্রত্যাশা করাটা খুবই সঙ্গত। কিন্তু বোখারী এই অসম বয়সের সঙ্গ এড়াতে প্রথম থেকেই বদ্ধপরিকর। আমরাও পুরোনো বন্ধু এবং সহকর্মী। একটি দেশী এনজিওতে এক সঙ্গে কাজ করতাম। সেই থেকেই বোখারীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা এবং সখ্য, সমমনা বলেই হয়ত।
সিঙ্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা বিমানবালারা ক্রমাগত খাবার-দাবার এবং পানীয় বিতরণ করে যাচ্ছে। বোখারী এবং আমি পানি কিংবা ফলের রসের পরিবর্তে বিয়ার নিচ্ছি (ওর ভাষায় বিয়ার মেরে দিয়েছি)।সাড়ে তিন ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে SQ419 অবতরণ করলো। বাংলাদেশ সময় এখন রাত সাড়ে তিনটা হলেও সিঙ্গাপুরে এখন ভোর। স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা। অর্থাৎ আমরা সিঙ্গাপুরী উড়োজাহাজের ধাতব ডানায় ভর দিয়ে উড়তে উড়তে দু’ঘণ্টা ভবিষ্যতে চলে এসেছি। ভাবতেই কেমন গা শিউরে ওঠে। এভাবে উড়ে উড়ে যদি কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও আমাদের অজানা ভবিষ্যত থেকে ঘুরে আসা যেতো তাহলে কি মজাই না হতো। চাঙ্গি বিমন বন্দরের রানওয়েতে ভোরের স্নিগ্ধ আলো মায়াবী একটা লোশন মেখে দিচ্ছে। অন্ধকারের লেপটা গা থেকে ঝেরে ফেলে আঁড়মোড়া ভেঙ্গে উঠছে এশিয়ার সলাজ বধু। জন্ম নিচ্ছে একটি নতুন দিন আর আমি পা রাখতে যাচ্ছি একটি নতুন ভূ-খন্ডে।
ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আমরা চারজন ট্যাক্সি নিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বিশ মিনিটের পথ, হোটেল কপথর্ণকিং। সিঙ্গাপুর এয়ারওয়েজ একোমোডেশন এবং ট্রান্সপোর্ট দেবে, এই মর্মে একটি ভাউচার দিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ট্যাক্সি ভাড়া ৩০ ডলার হোটেল কর্তৃপক্ষই দিয়ে দিলো। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরের ভিসা নিয়ে আসেনি আমাদের অন্য ছয়জন সহকর্মী, যাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে প্লেনে ওঠার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। এ দলের দলপতি শামসুল হককে খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হচ্ছে। ছোটখাটো গড়ন। মুখ ভর্তি ছোট করে ছাটা সৌদি দাড়ি। সদা হাস্যময়। তবে ওর হাসি দেখলেই মনে হয় এই হাসিটার আঁড়ালে কিছু একটা লুকোনো আছে। বেশ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলেও শামসুল হকের নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত ইমিগ্রেশনের কঠিন দরোজা ওরাও ভিসা ছাড়াই পার হতে পেরেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে ঢাকাস্থ ইউএনডিপি অফিসের অথোরাইজেশন লেটারটিকে তুরুপের তাশ হিসাবে ব্যবহার করেছে শামসুল হক।
ওদেরকে ভিসা ছাড়াই এন্ট্রি সীল মেরে সিঙ্গাপুরে ঢুকতে দিয়েছে এ খবর শোনার পরতো আমাদের আব্দুল মতিনের মাথা ফরটি-নাইন হয়ে গেছে। তার শুধু একটিই প্রশ্ন, তাহলে আমরা দুপুর রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে গাঁটের নগদ ৬০০ টাকা খরচ করে ভিসা নিলাম কেনো? এ নিয়ে তার আক্ষেপ-আহাজারীর শেষ নেই। একটি বিদেশী ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ছয়জন বাঙালীর প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। কোথায় আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো তা না করে বরং আমাদের মতিন সাহেব উল্টো সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেশনকে ছাগল ইমিগ্রেশন বলে গালমন্দ করলেন। হায়রে বাঙালী, স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পরেও আমরা বাঙালীই রয়ে গেলাম, মানুষ হলাম না।
যেহেতু সিঙ্গেল রুম পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, বোখারী তাকালো আমার চোখের দিকে, আমি ওর। আমাদের নীরব সমঝোত হয়ে গেলো অন্যদের বুঝে উঠবার অনেক আগেই। ৫১৯ নম্বর ঘরের চাবি নিয়ে লিফটে উঠে পড়লাম। স্থানীয় হোটেল কর্মীরা আমাদের ঢাউস সাইজের স্যুটকেসগুলোকে অত্যাধুনিক ট্রলিতে চাপিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই পাঁচতলায়, আমাদের শয়নকক্ষে নিয়ে এলো।
ঝটপট গোসল সেরে নির্ঘূম স্টোমাকে দুজন দুকাপ কফি চালিয়ে দিলাম। জানালার পর্দা সরাতেই এক চিলতে স্নিগ্ধ ভোর ঘরের মধ্যে লাফ দিয়ে ঢুকে পড়লো। বাইরে সুউচ্চ দালানের সারি, গ্লোসি সভ্যতার চোখ ধাধানো রূপ। চোখ ভেঙ্গে যদিও ঘুম আসছে, ঘুমের পরী হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পড়তে চাইছে চোখের পাতায় কিন্তু ১৮ ঘন্টার যাত্রাবিরতিতে এশীয়ার বধু সিঙ্গাপুর শহরটাকে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখে নেবার লোভ সামলাতে পারছি না। বোখারীর চোখে চোখ রাখতেই সেও চোখের ভাষায় একই অনুভূতি জানালো।
অতএব সময় নষ্ট করা চলবে না। ৯০ সেকেন্ডে তৈরি হয়ে নিলাম। ঘর থেকে বেরুতে যাবো ঠিক এমন সময় চোখে পড়লো ছোট্ট সাইড টেবিলের ওপর গ্রীস্মের দুপুরে চুপচাপ শুয়ে থাকা অলস বেড়ালের মতো শুয়ে আছে একটি সাদা টেলিফোন সেট। তৃতীয় বিশ্বের অনেক বেকার যুবকের মতো আমিও কিছু বদঅভ্যেসকে আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে টেলিফোন দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছে হওয়া। অবশ্য এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একটি টেলিফোন করাকে বিলাসিতা কিংবা খেজুরে গপ্পো বলা যাবে না। মাত্র আট ঘণ্টার বিরহ হলেও মনে হচ্ছে কতোকাল ধরে, কতোমাস ধরে ওকে দেখিনি, কথা বলিনি। তিন হাজার মাইলের দূরত্ব বোধ হয় সময়ের দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। টেলিফোন সেটটির ওপরেই ছোট্ট এক টুকরা হলুদ কাগজে নির্দেশিকা লেখা রয়েছে। নির্দেশ মতো শূন্য টিপে সুকণ্ঠী রিসেপশনিস্টকে পেলাম। ওর কণ্ঠে নাকী সুরের প্রভাব নেই শুনে ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করলাম মেয়েটিকে, ইন্ডিয়ান ফিচার। হোটেল বয়গুলোর মতো ও নিশ্চয়ই একটি বিশ্রী রকমের থ্যাবড়ানো নাসিকা বহন করছে না। সুকণ্ঠি মেয়েটি ওর আবেদনময়ী বিগলিত গলায় জানালো ৬ পুশ করলেই সেটটি ইন্টারন্যাশনাল হয়ে যাবে, তারপর দুনিয়ার যেখানে খুশী কথা বলতে পারি। শুভস্য শীঘ্রম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম ঢাকায়। মাত্র দুবার রিঙ হতেই মুক্তির বিরহানন্দের মিশ্র অনুভূতি মেশানো কণ্ঠ ভেসে এলো।
হ্যালো, জহির?
হ্যাঁ, কিভাবে বুঝলে?
যেভাবে জেগে আছি সারারাত।
বুঝলাম ফোনের জন্য ও উদগ্রীব হয়ে বসেছিল। যদিও মিনিটে ১ ডলার ৯০ সেন্ট বিল খুব একটা বেশি না কিন্তু’ আমি আর কথা বাড়াতে পারলান না। আসলে বিরহটা আট ঘণ্টার না, ওর বুকের ওপর এখন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে সামনের ছয়টি মাস। সবাই এ পর্যন্ত সুস্থভাবে পৌঁছানোর খবরের পাশাপাশি ইস্তাম্বুল পৌঁছে আবার টেলিফোন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রিসিভার রেখে দিলাম। কিছু কিছু আনন্দ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। এই মুহূর্তে মুক্তির সাথে কথা বলতে পারার আনন্দ আমার দুচোখ থেকে কষ্টের ধারা হয়ে নেমে আসতে চাইছে। একান্তই আমার কষ্টানন্দের সেই অশ্রুবিন্দুকে পৃথিবীর আর সকলের কাছ থেকে আড়াল করার জন্য রুমালে মুছে জিনসের গারদে পুরে দিলাম।
ইতোমধ্যে বোখারীও ওর স্ত্রীর বড় ভাই, আলম ভাইকে ফোন করে নিলেন। আলম ভাই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। সমুদ্রের ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে এখন ডাঙ্গায় উঠেছেন। তিনি এখন শিপিং কোম্পানীরই প্রশাসন সংক্রান্ত কাজ করেন। প্রায় পঁচিশ বছর সিঙ্গাপুরে আছেন আলম ভাই। এখানকার সম্মানজনক নাগরিক ওরা তিনজনই। বোখারীর ভাষায় হেলেন ভাবী খুবই অমায়ীক মানুষ, আলম ভাইয়ের চেয়ে এক ডিগ্রী বেশী। ওদের একমাত্র সন্তান শ্রাবণী দশ ক্লাসের ছাত্রী।
আলম ভাই টেলিফোনে তাড়া দিয়ে বললেন, জলদি চলে এসো। উত্তেজনায় আমি টগবগ করছি। যদিও বোখারী এর আগে বহুবার সিঙ্গাপুরে এসেছে তথাপিও ওর মধ্যে আগ্রহের কোনো কমতি দেখছি না। কপথর্ণকিং এর পঞ্চম তলা থেকে লিফটে চড়ে নিচে নেমে এলাম। এখানে এসে মোটামুটি একটা বিপদেই পড়ে গেলাম। পাশাপাশি সোফায় বসে আছেন খুরশিদ এবং আব্দুল মতিন। এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, আমরা এলেই নগর দর্শনে বেরুবে। অথচ আমাদের মনে দুষ্টু বুদ্ধি, বেরুতে চাই ওদেরকে না নিয়ে। হোটেলে ঢুকেই রাখাল বলেছিলেন একটু ঘুমিয়ে নেবেন, সুযোগটা নিয়েছি আমরা, ওকে আর ডাকিনি। কিন্তু লবিতে যে দুই ভিলেন বসে আছে ওদেরকে পাশ কাটাই কি করে।
বোখারী চক্ষু লজ্জায় কিছু বলছে না দেখে আমিই মুখ খুললাম,
মতিন ভাই ভাগ্নির বাসায় যাচ্ছেন কখন?
অহনই যামু, ভাগ্নিরেতো ফোন করলাম, কইলো আইতাছি, আহেনা ক্যা?
খুরশিদ ভাই? আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
সিনিয়র এসিসট্যান্ট সেক্রেটারী, আবার সচিবের পি এস, খুবই জটিল প্রকৃতির মানুষ খুরশিদ আনওয়ার। সাধারণত মোটা মানুষেরা সরল প্রকৃতির হয়ে থাকে কিন্তু এই মানুষটি ব্যতিক্রম। সোজাসুজি জবাব না দিয়ে বললেন, চলেন সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাই, দুপুরে একসাথে খাবো, ভালোই মজা হবে।
গত বছর আমি যখন উত্তর মেরুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখনো দেখেছি, বিদেশে এলে মানুষ প্রথম কিছুদিন অতিমাত্রায় কৃপনতা করে। আমি নিজেও এ দলেরই লোক। মনে মনে ভাবছি এক-দেড়শ ডলার ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়ার চেয়ে যদি আলম ভাইয়ের ঘাড়ে চড়ে সিঙ্গাপুর শহরটা দেখে নেয়া যায়, মন্দ কি। এক পর্যায়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম (অবশ্য বোখারীরও এরকমই ইচ্ছে),
মতিন ভাই, আপনি খুরশিদ ভাইকে নিয়ে ভাগ্নির বাসায় যান, আমরা দুজন যাই বোখারী সাহেবের সম্মন্ধির বাসায়। দুজন দুজন করে ভাগ হলে বোরিং লাগবে না।
মতিন কিংবা খুরশিদের প্রস্তাবটা পছন্দ হলো কি হলো না সেদিকে আর না তাকিয়ে আমরা দুজন মুহূর্তের মধ্যে কেটে পড়লাম।
Youth Carnival: