কোটায় বিপন্ন মেধা

0

কোটা পদ্ধতির ‘দৌরাত্ম্যে বিপন্ন হতে বসেছে বিপুলসংখ্যক মেধাবীর ভবিষ্যৎ। প্রায় সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ সরকারের বিভিন্ন চাকরিতে যোগ্যতার মানদণ্ডে ওপরের সারিতে থেকেও কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছে এসব মেধাবী। আর সেখানে স্থান করে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোটা পূরণ না হওয়ায় শূন্যই থেকে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ। এখানেও স্থান নেই সংশ্লিষ্ট মেধা তালিকার ওপরের সারিতে থাকা মেধাবীদের। এমন পরিস্থিতি আর কয়েক বছর অব্যাহত থাকলে সর্বস্তরে মেধাশূন্যতা দেখা দিতে পারে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (পিএসসি) সরকারের বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন একাধিকবার বর্তমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি এ সংস্কার ইস্যুতে রাজপথসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিগত কোনো সরকারই। বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে অদ্যাবধি কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত আলাদাভাবে কোটা পদ্ধতি যৌক্তিকীকরণ বা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে আগামীতে যেসব বিসিএস পরীক্ষা হবে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী না পেলে মেধা কোটা থেকে পূরণ করা হবে। তারপরও সরকারের শীর্ষ মহল চাইলে প্রয়োজনের তাগিদে কোটা পদ্ধতির সংস্কার হতে পারে।

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি, নারী, জেলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (উপজাতি), প্রতিবন্ধী, আনসার ও ভিডিপি, পোষ্য, খেলোয়াড়, এলাকা ও বোনসহ ২৫৭ ধরনের কোটা বিদ্যমান। এসব কোটা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) সরকারি চাকরি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে প্রয়োগ করা হয় এসব কোটা।

বিসিএসে মেধা তালিকা থেকে ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ আসে কোটা থেকে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য (ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি) ৩০, মহিলা ১০, জেলা ১০ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (উপজাতি) ৫। এছাড়া এসব কোটা পূরণ না হলে, সেখানে ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রতিবন্ধীর জন্য। আর যদি সংশ্লিষ্ট চাকরির ক্ষেত্রে এসব প্রাধিকার কোটা পূরণ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে মেধা তালিকা থেকে প্রতিবন্ধীর কোটা পূরণ করা হয়। এছাড়া নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও একই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধাতালিকা থেকে ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০ শতাংশ পূরণ করা হয় কোটা থেকে। এই কোটার মধ্যে শতাংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ৩০, মহিলা ১৫, আনসার ও ভিডিপি ১০, অনাথ ও প্রতিবন্ধী ১০ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫।

এর বাইরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্যসহ অন্যান্য কোটা রয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে রয়েছে এলাকা কোটা, পোষ্য, বোন, বিশেষ কোটাসহ নানা ধরনের কোটা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসনের ৬ শতাংশ ভর্তি হয় কোটায়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩ শতাংশ, প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মেধাবী ৩ শতাংশ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যদের কোটা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান কোটা ২ শতাংশ। ঢাকার স্কুলগুলোতে চালু হয়েছে ৪০ শতাংশ ‘এলাকা কোটা’। এ কোটায় ভর্তি হতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক, সরকারি বাসার বরাদ্দপ্রাপ্ত এবং ভাড়াটিয়া হতে হবে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অন্যান্য কোটার সঙ্গে রয়েছে বোন কোটা। কোনো শিক্ষার্থীর সহোদর বোন এ কোটায় ভর্তি হতে পারবে। এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজে রয়েছে পরিচালনা পরিষদের ১০ শতাংশ এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রয়েছে। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির কারণে

সরকারি চাকরি ও ভর্তিতে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীর কাছে হেরে যাচ্ছেন মেধাবীরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন যুগান্তরকে বলেন, চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় কোটা পদ্ধতির যৌক্তিকীকরণের জন্য বার্ষিক প্রতিবেদনে একাধিকবার সুপারিশ করেছি। এমনকি ওই সময় কোটা নিয়ে পিএসসি একটি মৌলিক গবেষণা করেছিল। ড. আকবর আলি খান ও কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার) ওই গবেষণাটি ছিল বিশ্বমানের। সেখানেও তারা মেধা কোটা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিলেন। সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও জেলাগুলো ছোট হওয়ায় আগের মতো প্রকট বৈষম্য নেই। তাই জেলা কোটা তুলে দিয়ে মেধা কোটা আরও ১০ ভাগ বাড়ানো যেতে পারে। এতে মেধাবীরা উপকৃত হবে। সেই সঙ্গে ক্যাটাগরিভিত্তিক কোটার মধ্যে জেলা কোটা ঢুকানো সমতা নীতির পরিপন্থী, তারও সুরাহা হবে। এতে কোনো মহলের আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।

বিভিন্ন দেশের কোটা পদ্ধতির উদাহরণ দিয়ে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটা আছে, তবে তা অন্যভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে কোটাধারীদের আগেই একটা নম্বর দেয়া হয়। এরপর ওপেন পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় কোটাধারীদের। আর ভারত তো কোটাকে একটা সুন্দর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সেখানে কোটা আছে, তবে তা উপার্জনের ভিত্তিতে। উচ্চ আয়ের মানুষরা কোটা পায় না। এক্ষেত্রে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকেও ছাড় দেয় না। একবার যে কোটার সুবিধা পাবে, সে আর কখনও কোটার সুবিধা পাবে না। অর্থাৎ বাবা যদি কোটা সুবিধা পায় তার সন্তানরা কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। কেউ যদি কোটা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাবে না। আর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি হয়েছে, সে কখনও চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।

কোটার কারণে প্রশাসনে হাজার হাজার পদ খালি থাকছে। ২৮ থেকে ৩২তম ৫টি বিসিএসের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যোগ্য প্রার্থী না থাকায় প্রাধিকার কোটার ৪ হাজার ২৮৭টি পদ খালি রাখতে হয়েছে। এর মধ্যে ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি, ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি, ৩০তম বিসিএসে ৭৮৪টি, ৩১তম বিসিএসে ৭৭৩টি পদ শূন্য ছিল। কোটার শূন্যপদগুলো পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি। ওই বিসিএসেও এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে তা পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ৩২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৯১২ জনই চাকরির সুযোগ পাননি। কারণ এক কোটা থেকে আরেক কোটায় নিয়োগ দেয়া যায় না। এর আগে ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮৩৩টির মধ্যে ৭৭৮টি, ২০০৫ সালে এক হাজার ৮৫৪টির মধ্যে এক হাজার ৫০৮টি, ২০০৬ সালে ৭৫৪টির মধ্যে ৫৯৮টি এবং ২০০৭ সালে ৭০৯টির মধ্যে ৬৩৭টি পদ খালি রাখতে হয়েছিল এই কোটার কারণেই।

কোটাকে বৈষম্যের হাতিয়ার উল্লেখ করে পিএসসির সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেন, কোনো একজন প্রার্থীর বাড়ি জামালপুরে। তার মেধাক্রম ১৫। কিন্তু ওই জেলা কোটায় নেয়া যাবে তিনজন। ১৫ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই যদি জামালপুরের কোটায় তিনজন পাওয়া যায়, তাহলে ১৫তম হয়েও চাকরি পাবেন না। বিপরীতে ১৫০তম হয়েও মেহেরপুরের একজন প্রার্থী কোটা খালি থাকলে চাকরি পেতে পারেন।

মেধা তালিকায় ওপরে থেকেও অনেকে কোটার কারণে পছন্দের ক্যাডার পান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য ক্যাডারের এক কর্মকর্তা জানান, তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু বর্তমানে উপসচিব। একাডেমিক পরীক্ষায় সে কখনও ভালো করেনি। বিসিএস পরীক্ষার মেধা তালিকায় ওই উপসচিব তার থেকে ৪৩৬ জনের পরে ছিল। শুধু কোটা সুবিধা পেয়ে সে প্রশাসন ক্যাডার পায়। অথচ ভালো রেজাল্ট করেও তিনি পেয়েছেন তথ্য ক্যাডার।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ১৭ জনকে পোষ্য কোটায় ভর্তি করা হয়। এদের প্রায় সবাই ভর্তি পরীক্ষায় ১০০-র মধ্যে ৪০ নম্বর পায়। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান, ভাই-বোন হওয়ায় তারা এ সুযোগ পান। অথচ তাদের চেয়ে দ্বিগুণ নম্বর পেয়েও ভর্তি হতে পারেনি মেধাবীরা।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারও মনে করেন, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকা উচিত। তাও সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি নয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বিদ্যমান কোটা কমানো প্রয়োজন। জেলা কোটা বাতিল হওয়া উচিত। শেখ হাসিনা দেশকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তার সঙ্গে বর্তমান কোটা পদ্ধতি সামঞ্জস্য নয়। যোগ্যতার ভিত্তিতে যারা এগিয়ে আছে, তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়লেও আমলাতন্ত্রে ও শিক্ষকতায় দক্ষতা কমছে। এর বড় কারণ কোটা পদ্ধতি। সময় এসেছে পুরো বিষয়টির পুনর্বিবেচনার। এর সঙ্গে অনেকে একমত হবেন না রাজনৈতিক কারণে। মুক্তিযোদ্ধা কোটারও নানারকম অপব্যবহার হচ্ছে। কোটা যদি থাকতেই হয়, তবে নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কিছু কোটা থাকতে পারে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা থাকলেও নাতি-পুতিদের জন্য নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তিতেও কোটা থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন এই ইতিহাসবিদ।

আওয়ামী লীগ আমলে (১৯৯৬-২০০১) জনপ্রশাসন সংস্কারে এটিএম শামসুল হকের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশ ছিল- প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংশোধন করে ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদগুলো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া। মেধা কোটা ১০ ভাগ বৃদ্ধি করে ৫৫ ভাগ করা। তাতে আরও বলা হয়, সরকারি চাকরিতে মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রবেশকে ব্যাহত করা ছাড়াও নিয়োগের ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলছে কোটা পদ্ধতি। পিএসসি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে মেধা নীতির অনুকূলে কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য বারবার সুপারিশ করছে। কিন্তু তাদের সুপারিশ আমলে নেয়া হয়নি। এ অবস্থায় সিভিল সার্ভিসের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিশন মনে করে- ‘শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর এখন সময় এসেছে।’

এরপর ২০০৮ সালে শামসুল হক কমিশনের অন্যতম সদস্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান ও বর্তমান সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কোটা পদ্ধতির অসঙ্গতি দূর করতে একটি সমীক্ষা চালায় পিএসসি। ‘কোটা সিস্টেম ফর সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সমীক্ষা প্রতিবেদন ওই বছরের ৬ মার্চ তৎকালীন পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইনের কাছে জমা দেয়া হয়। এই সমীক্ষা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেধা কোটা পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ এবং জেলা কোটার পরিবর্তে বিভাগীয় কোটা প্রবর্তনের সুপারিশ করে পিএসসি। ৬১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটি ২০০৮ সালের ২০ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে আকবর আলি খান কোটাব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, অধিকাংশ কোটাই অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী। কোনো কোটাই চিরদিন থাকতে পারে না। প্রত্যেক কোটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯(১) ধারায় বলা আছে-‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ ২ ধারায় বলা আছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’

কোটা পদ্ধতি যৌক্তিকীকরণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক যুগান্তরকে বলেন-প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা এই তিনটি পরীক্ষা আমরা নিয়ে থাকি। এসব পরীক্ষায় কোথাও কোটার প্রার্থীদের আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যেসব মেধাবীকে পাই তাদের মধ্য থেকে কোটার প্রার্থীদের আলাদা করা হয়। তিনি বলেন, কোটা সংবিধান ও আইন দ্বারা স্বীকৃত বিষয়। জাতিকে সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য এটি অনুসরণ করা হয়। কোটা প্রবর্তন করেছে সরকার, আমরা শুধু এটি বাস্তবায়ন করে থাকি।

এক প্রশ্নের জবাবে পিএসসির চেয়ারম্যান বলেন, এটা ঠিক যে কোটার কারণে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে। এ কারণে এটা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত। কিন্তু সার্বিকভাবে চিহ্নিত মেধাবীদের থেকে প্রার্থী বাছাই করার এই রীতি অনগ্রসর গোষ্ঠীকে তুলে আনতে প্রয়োজন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রেই কোটা পদ্ধতি চালু হয়। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ভারতীয়দের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়। পরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যও রাখা হয় কিছু কোটা। পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) দাবির মুখে কেন্দ্রীয় সুপেরিয়র সার্ভিসগুলোর কয়েকটিতে প্রদেশভিত্তিক কিছু কোটা চালু করা হয়। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) সচিব এমএম জামানের স্বাক্ষরে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ওই আদেশে সরকারি চাকরিতে মাত্র ২০ ভাগ ছিল মেধা কোটা, ৪০ ভাগ জেলা কোটা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ ভাগ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা। ১৯৭৬ সালে এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ ভাগ, জেলা কোটায় ২০ ভাগ। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আগের মতোই ৩০ ভাগ রাখা হয়। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে-সার্ভিস কমিশনের সদস্য এমএম জামান ছাড়া বাকি সবাই সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তখন কোটার পক্ষে অবস্থান নেয়া ওই সদস্য প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। ১৯৮৫ সালে এ ব্যবস্থা আবারও বদলানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ ভাগ, নারীদের জন্য ১০ ভাগ এবং প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ ভাগ পদ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়। ২০১১ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ ভাগ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়

Courtesy: jugantor

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *