সন্দেহ নেই সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অন্যতম। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ১৯৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্তুগালে জন্মগ্রহণ করেন। ক্লাব পর্যায়ে পর্তুগিজ এই তারকা চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, তিনটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, দুটি লা লিগা শিরোপা ছাড়াও আরও বিভিন্ন শিরোপা জিতেছেন। ২০০৯ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে থেকে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে আসেন। তখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সবচেয়ে ব্যয়বহুল খেলোয়াড় ছিলেন। ৯৪ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ রোনালদোকে কিনে নেয়।
তিনি ক্লাবের সাফল্যের পেছনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তার এমন ধারাবাহিক সফলতার কারণেই তিনি তার ক্যারিয়ারে ৪টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট, ৫টি ফিফা ব্যালন ডি’অর ও ২৬টি শিরোপা জিতেছেন। এ তো গেল ক্লাব ফুটবলের কথা, পর্তুগালের জাতীয় দলের হয়েও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। যদিও একক পারফর্মেন্সে বিশ্বকাপ জয় করা যায় না, তাতে কি!
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম ইতিহাসের সেরাদের নামের পাশে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের ৪টি আসরে পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে অংশগ্রহণ করেছেন (২০০৬, ২০১০, ২০১৪, ২০১৮)। আমাদের আজকের আয়োজনে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার নিয়ে বিশদ বর্ণনা করা হলো।
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ, ২০০৬
২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে পর্তুগালের হয়ে প্রথমবারের মতো ২১ বছর বয়সে বিশ্বকাপের মূল আসরে অভিষেক ঘটে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। সেসময় পর্তুগালের জাতীয় দলে লুইস ফিগো, সিমাও, ডেকো, পাউলেতার মত তারকাদের সাথে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো খেলেছিলেন। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে পর্তুগাল জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন লুইজ ফেলিপে।
সেসময় বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচে খেলেছিলেন রোনালদো, কেননা পর্তুগাল সেমি-ফাইনাল খেলেছিলো এবং বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিল। বিশ্বকাপের ১ম রাউন্ডের ১ম ম্যাচটিতে পর্তুগাল বনাম অ্যাঙ্গোলার মধ্যকার ম্যাচে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অভিষেক হয় এবং ম্যাচটিতে পর্তুগাল ১-০ গোলে জয় পায়। টুর্নামেন্টে রোনালদোর ১ম গোলটি আসে পর্তুগাল বনাম ইরানের মধ্যকার খেলায় পেনাল্টি থেকে এবং ম্যাচটিতে পর্তুগাল ২-০ গোলে জয় পায়। ১ম রাউন্ডের অপর ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষের ম্যাচটিতে পর্তুগাল ২-১ গোলে জয় পায়।
২য় রাউন্ডে পর্তুগালকে খেলতে হয়েছিলো নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এই খেলাটি চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিলো। প্রথমার্ধেই প্রতিপক্ষের ফাউলে ব্যাথা পেয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে মাঠ ছাড়তে হয়। খেলাটি এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ হয় যে, পর্তুগালের ৫ জন খেলোয়াড় ১টি করে হলুদ কার্ড দেখে এবং ২ জন খেলোয়াড় ২টি করে হলুদ কার্ডসহ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ে। অপরদিকে নেদারল্যান্ডসের ৪ জন খেলোয়াড় ১টি করে হলুদ কার্ড দেখে এবং একজন খেলোয়াড় ২টি হলুদ কার্ডসহ ১টি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ে। ম্যাচের একমাত্র জয়সূচক গোলটি আসে পর্তুগালের ম্যানিসের পা থেকে।
টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল এবং ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয়। সেই ম্যাচটিতে পর্তুগাল ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার খেলাটি ৯০ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য ড্র থাকে, এক্সট্রা টাইম দিয়ে ১২০ মিনিট পর্যন্ত খেলা পরিচালনা করার পরও দুই দলের কেউ প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে পারেনি। যার ফলে খেলা গিয়ে গড়ায় ট্রাইবেকারে এবং ট্রাইবেকারে ৩-১ গোলে জয় পায় পর্তুগাল। ট্রাইবেকার থেকে ১টি গোল পায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেমি-ফাইনালে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ হয় ফ্রান্স, সেই ম্যাচে ১-০ গোলে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায় রোনালদোর পর্তুগাল। পেনাল্টি থেকে ম্যাচের একমাত্র জয়সূচক গোলটি করেন ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান।
২০০৬ বিশ্বকাপে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অর্জন
গোল- ১
অ্যাসিস্ট- ০
ক্যাপ- ৬
সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ, ২০১০
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ৪ বছর পর ২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে আসেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ৯৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রোনালদো স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে সাক্ষর করেছিলো এবং সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপ খলেতে আসার আগে তিনি একবার ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ছিলেন। ২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপে রোনালদো আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেননি। গ্রুপ পর্বে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ ছিলো ব্রাজিল, আইভরিকোস্ট এবং উত্তর কোরিয়া।
গ্রুপ পর্বে ব্রাজিল ও আইভরিকোস্টের বিপক্ষের ম্যাচে গোল শুন্য ড্র করে পর্তুগাল এবং উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষের ম্যাচটিতে ৭-০ গোলের বড় জয় পায় পর্তুগাল। উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষের ম্যাচটিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ১টি গোল করেন, যা গত ১৬ মাসের আন্তর্জাতিক খেলায় ছিল তার প্রথম গোল। সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপে পর্তুগাল তেমন ভালো কিছুই করতে পারেনি। ২য় রাউন্ডে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ ছিল ফেভারিট স্পেন, এই ম্যাচে স্পেনের কাছে ০-১ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় পর্তুগাল। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে একমাত্র জয়সূচক গোলটি আসে স্পেনের ডেভিড ভিয়ার পা থেকে।
২০১০ বিশ্বকাপে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অর্জন
গোল- ১
অ্যাসিস্ট- ১
ক্যাপ- ৪
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ, ২০১৪
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের মূল আসরে খেলার জন্য বলতে গেলে পর্তুগালকে একাই টেনে নিয়ে আসেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বিশ্বকাপ খেলতে আসার পূর্বে তিনি আবারও ১টি ব্যালন ডি’অর জয়ী হন এবং বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ৮ গোলসহ উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি হ্যাট্রিক করেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মূল আসরের প্রথম ম্যাচেই পর্তুগাল হোঁচট খেলো জার্মানির বিপক্ষে, এই ম্যাচে ০-৪ গোলের বড় বিপর্যয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় পর্তুগিজদের। এছাড়াও ম্যাচের মাত্র ৩৭ মিনিটেই পর্তুগিজ খেলোয়াড় পেপে লাল কার্ড দেখে বসেন। ম্যাচটি পর্তুগালের ইতিহাসে বিশ্বকাপে খেলা সবচেয়ে বড় পরাজয়।
গ্রুপ পর্বের ২য় ম্যাচে পর্তুগাল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি হয়। পর্তুগাল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই খেলাটি ২-২ গোলে ড্র হয় এবং এই ড্রয়ের মাধ্যমে পর্তুগাল বিশ্বকাপ থেকে এক প্রকার ছিটকে যায়। গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচটি পর্তুগাল খেলে ঘানার বিপক্ষে এবং এই ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে ২-১ গোলে পর্তুগাল জয় পায়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এই আসরের বিশ্বকাপে তার প্রথম গোলটি করেন ম্যাচের ৮০ মিনিটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোল পরিসংখ্যানে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় পর্তুগালকে।
২০১৪ বিশ্বকাপে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অর্জন
গোল- ১
অ্যাসিস্ট- ১
ক্যাপ- ৩
রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ, ২০১৮
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলার পূর্বে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ৫ বার ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ছিলেন। নিঃসন্দেহে রোনালদো ২০১৮ বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। রোনালদো গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত এক হ্যাট্রিক করে বসেন ফেভারিট স্পেনের বিপক্ষে, অপরদিকে স্পেনও পর্তুগালের জালে ৩টি বল জড়ায়। যার ফলে ম্যাচের ফলাফল হয় ড্র। গ্রুপ পর্বের ২য় ম্যাচে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় মরক্কোর। ম্যাচের মাত্র ৪ মিনিটেই কর্নার থেকে দুর্দান্ত এক হেডের মাধ্যমে একমাত্র জয়সূচক গোলটি করে আবারও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন রোনালদো।
বিধাতা সবসময় সহায় হন না, তাই হয়তো বা গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে পর্তুগালকে ড্র করতে হলো তুলনামূলক দুর্বল দল ইরানের সাথে। এই ম্যাচে পেনাল্টি পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি রোনালদো, হয়তো বা তার এই গোলেই জয় পেতে পারতো পর্তুগাল। গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েই রাউন্ড অব সিক্সটিনে খেলার সুযোগ করে নেয় রোনালদোর পর্তুগাল। ২য় রাউন্ডে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ হয় উরুগুয়ে। শক্তিশালী উরুগুয়ের বিপক্ষে ১-২ গোলে হেরে নকআউট পর্ব থেকেই বিদায় নেয় পর্তুগাল।ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হয়তো বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, কিন্তু ফুটবল বোদ্ধারা রোনালদোর নামটি মনে রাখবে যুগযুগান্তর ধরে।
২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অর্জন
গোল- ৪
অ্যাসিস্ট- ০
ক্যাপ- ৪