বিশ্বকাপ শিরোপার দিকে চোখ রেখেই দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। শেষ পর্যন্ত বিজয়ের হাসি হাসল ফ্রান্স, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনাল ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মত ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর জয় করল তারা। ম্যাচ শেষে নামা অঝোর বৃষ্টি যেন ৪২ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ ক্রোয়েশিয়ার দুঃখের সঙ্গী হলো। আর ফ্রান্সের সমর্থকদের সাথে খেলোয়াড়, কোচ ও স্টাফরা মিলে মেতে উঠলেন বিশ্বজয়ের আনন্দে। তবে নানা অঘটনের জন্ম দেয়া এ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচেও ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেফারির দেয়া একটি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ফ্রান্স বনাম ক্রোয়েশিয়া
ম্যাচের শুরু থেকেই দুই দল সমানে পাল্লা দিয়ে খেলে যাচ্ছিল। আর বিশ্বকাপের ফাইনাল বলে কথা, আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের ভিড়ে কোনো দলই সহসা গোল পাবে বলে মনে হচ্ছিল না। কিন্তু নিয়তির কী খেলা, এমন একটি টানটান ফাইনাল ম্যাচেও গোলবন্যাই হয়ে গেল!
ম্যাচের ১৮ মিনিটের মাথায় আঁতোয়ান গ্রিজমান ডিবক্সের কাছে ফাউলের শিকার হলে ফ্রি কিক পায় ফ্রান্স। গ্রিজমানেরই নেয়া ফ্রি কিকটি মানজুকিচের মাথায় লেগে জায়গা করে নেয় ক্রোয়েশিয়ার জালে। এর ফলে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে আত্মঘাতী গোল করার দুর্ভাগ্য হয় ৩২ বছর বয়সী ক্রোয়েশিয়ান এই স্ট্রাইকারের, ফ্রান্স এগিয়ে যায় ১-০ গোলে।
গত ম্যাচেও প্রথমে গোল খেয়ে ফিরে এসেছিল, এ বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচেও অতিরিক্ত সময়ে খেলে জয় ছিনিয়ে এনেছে দলটি। তাই লড়াকু ক্রোয়েশিয়া নিজেদের মধ্যে পাস চালাচালি করে গোল শোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। মিনিট দশেক পর সফলও হয় তারা। ডিবক্সের বাইরে পেরেসিচ ফাউলের শিকার হলে ফ্রি কিক পায় ক্রোয়েশিয়া। লুকা মদরিচের নেয়া ফ্রি কিক থেকে বল পায়ে পান পেরেসিচ। তার দুর্দান্ত শট প্রতিপক্ষের জালে জড়ালে ম্যাচে সমতায় ফেরে ক্রোয়েশিয়া।
কিন্তু প্রথমার্ধ শেষের সাত মিনিট আগেই যেন ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ৩৫তম মিনিটে ফ্রান্সের কর্নার আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে ডিবক্সে দাঁড়ানো পেরেসিচের হাতে বল লাগে। এ ঘটনা প্রথমে রেফারি নেস্তর পিতানার চোখ এড়িয়ে গেলেও পরে ফ্রান্সের আবেদনে ভিআর প্রযুক্তির শরণাপন্ন হন তিনি।
বেশ খানিকটা সময় নিয়েও আপাতদৃষ্টিতে অনিচ্ছাকৃত মনে হওয়া এই হ্যান্ডবলকে ইচ্ছাকৃত বলে রায় দেন রেফারি। ফলে ফ্রান্সের পক্ষে পেনাল্টি যায়, অভিজ্ঞ ক্রোয়েশিয়ান গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচ এবার গতিপথ চিনতে ভুল করে উল্টো দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন, আর গ্রিজমানের করা এই পেনাল্টি গোল থেকেই ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মত এগিয়ে যায় ফ্রান্স।
দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচে ফেরার জন্য মরিয়া ক্রোয়েশিয়া যখন অতি আক্রমণে উঠে আসে। কিন্তু তাদের রক্ষণের দুর্বলতা থেকেই ৫৯তম মিনিটে পল দগবা ও ৬৫তম মিনিটে কিলিয়ান এমবাপ্পে দারুণ নিশানায় দুর্দান্ত দুইটি গোল করে ফ্রান্সকে ৪-১ গোলের বড় ব্যবধানে এগিয়ে নেন। ফ্রান্সের বলিষ্ঠ রক্ষণদুর্গ ভেদ করে তিন গোলে পিছিয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়ার এরপর আর ম্যাচে ফেরার সুযোগই ছিল না বলতে গেলে।
তবে ৬৯তম মিনিটে একটি অভিনব গোল করেই ব্যবধান কমিয়েছে তারা। নিজেদের মধ্যে বল চালাচালির সময় ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিসের পা থেকে বল ছুটে যায়, আর বাজপাখির মত ওঁত পেতে থাকা মানজুকিচ ফ্রান্সের গোলে লক্ষ্যভেদ করেন। এই কৌশলী গোলটি তার আত্মঘাতী গোলের ক্ষতে সান্ত্বনার প্রলেপ হয়েই থাকল।
ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচ যখন অশ্রুসজল খেলোয়াড়দের সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম তখন দলের সাথে বিশ্বকাপ জয়ের বাঁধভাঙা উল্লাসে শরিক হয়েছেন । জয় পরাজয়ের খেলায় এমনটাই তো ভবিতব্য ছিল!
মাঠের পরিসংখ্যান
ম্যাচের পরিসংখ্যান
- ব্রাজিলের মারিও জাগালো আর জার্মানির ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে খেলোয়াড় ও কোচ উভয় রূপেই বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়লেন ফ্রান্সের সাবেক মিডফিল্ডার ও অধিনায়ক এবং বর্তমানে কোচ দিদিয়ের দেশম।
- ১৯৭০ সালের পর (যে বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিল ৪-১ গোলে ইতালিকে হারিয়েছিল) প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে রেকর্ড ৪ গোল করল ফ্রান্স।
- ১৯৭৪ সালের নেদারল্যান্ডের পর (জার্মানির কাছে যারা ২-১ গোলে পরাজিত হয়েছিল) আর কোনো দল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত ফাইনালে উঠে হারেনি। তবে এবার ২০১৮ বিশ্বকাপে সেই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হলো ক্রোয়েশিয়াকে।
- মারিও মানজুকিচ প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে নিজেদের জালে বল জড়ালেন।
- ১৯৫৮ সালের পেলের (১৭ বছর ২০৭ দিন) পর দ্বিতীয় কমবয়সী ও কিশোর খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের দেখা পেলেন ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে (১৯ বছর ২০৭ দিন) ।
- এ নিয়ে ফ্রান্সের হয়ে ফুটবলের বড় আসরগুলোতে ১০টি গোল করলেন আঁতোয়ান গ্রিজমান। লা ব্লুজদের হয়ে তার চেয়ে বেশি গোলের অধিকারী আছেন মাত্র তিনজন (মিশেল প্লাতিনি-১৪, জাস্ট ফন্টেইন-১৩, থিয়েরি হেনরি-১২)
- পেরিসিচ এ পর্যন্ত বড় টুর্নামেন্টগুলোতে ক্রোয়েশিয়ার ১১টি গোলে অবদান রাখলেন (৭টি গোল, ৪টি সহায়তা) যা ক্রোয়েশিয়ান খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ।
- ২০০৬ সালের ফাইনালে জিদানকে ঢুঁ দিয়ে খলনায়ক বনা ইতালির মাতেরাজ্জির সাথে একই ব্র্যাকেটে ঢুকে গেলে মানজুকিচ! কারণ তারা দু’জনই বিশ্বকাপ ফাইনালে নিজ দলের হয়ে গোল করলেও তাদের জন্যই আবার দলের বিপক্ষে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত গিয়েছে।
- ফ্রান্সের পল পগবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রথম খেলোয়াড় ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ইমানুয়েল পেটিটের পর প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার গৌরব অর্জন করলেন।
- ১৯৮২ সালের জার্মানির বিপক্ষে ইতালির মার্কো টারদেল্লির পর এই প্রথম কোনো খেলোয়াড় (ফ্রান্সের পগবা) বিশ্বকাপ ফাইনালে পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে গোল করলেন।
- ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের আর্নিয়ে ব্র্যান্ডটস একই ম্যাচে দলের হয়ে গোল ও আত্মঘাতী গোল দুটিই করেছিলেন। এই ম্যাচে সেই কীর্তির অংশীদার হলেন মানজুকিচ।
- হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস ও জোলতান জিবর, জার্মানির জার্ড মুলার, ফ্রান্সের জিনেদিন জিদানের পর পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার মানজুকিচ প্রিমিয়ার লিগ/চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের পর বিশ্বকাপ ফাইনালেও গোলের দেখা পেলেন।
ম্যান অফ দ্য ম্যাচ: আঁতোয়ান গ্রিজমান
দুই অর্ধ জুড়ে দুর্দান্ত খেলে ও দলের তৃতীয় গোল করে ফরাসি মিডফিল্ডার পল দগবাই অনেক দর্শক সমর্থকদের দৃষ্টিতে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়ার দাবিদার ছিলেন। তবে ফিফার বিচারে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন তার সতীর্থ গ্রিজমান। দলের প্রথম গোলটিতেও তার ফ্রি কিকের মুখ্য ভূমিকা ছিল, আর তার পেনাল্টি গোলে ফ্রান্সও চলে গেছে বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে।