ফিফা প্রতিটি বিশ্বকাপে দলীয় পুরষ্কারের পাশাপাশি ৩টি ব্যক্তিগত পুরষ্কারও দিয়ে থাকে। যার মধ্যে অন্যতম সম্মানজনক পুরষ্কার ‘গোল্ডেন বল’। ফিফা বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে প্রদান করা হয় এই পুরষ্কারটি। ১৯৮২ সাল থেকে ফিফা বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে গোল্ডেন বল পুরষ্কার দেওয়ার প্রচলন করেন।
সর্বপ্রথম এই বিশ্বকাপটি পান ইতালির ফুটবলার পাওলো রসি এবং সর্বশেষ পেয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার লুকা মডরিচ। তবে ফিফা এখন পর্যন্ত ১০বার এই পুরষ্কারটি প্রদান করেছেন। তবে ফিফা ১০ বারের মধ্যে ৫ বার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। চলুন দেখি কোন ৫ জন খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল প্রাপ্য ছিলো কিন্তু পেয়েছেন অন্যরা। কে পেয়েছেন এবং কার পাওয়া উচিত ছিলো সেটি জেনে নিন।
ব্রুনো কন্তির পরিবর্তে পাওলো রসি
১৯৮২ সালে স্পেনের অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। ‘৮২ বিশ্বকাপ থেকেই সর্বপ্রথম দেওয়া শুরু হয় গোল্ডেন বল পুরস্কার। সর্বপ্রথম গোল্ডেন বলের পুরস্কারটি পান ইতালিয়ান ফুটবলার পাওলো রসি। পাওলো রসি শুধু গোল্ডেন বল পুরস্কারটি পাননি সেই সাথে গোল্ডেন বুটও জেতেন।
পাওলো রসি ইতালির হয়ে ১৯৮২ বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচ খেলে ৬টি গোল করেন। ৬টি গোলের মধ্যে ব্রাজিলের বিপক্ষে অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক ছিলো। এছাড়া সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি গোল করেন এবং ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তিনি ইতালির হয়ে প্রথম গোলটি করেন। পাওলো রসি ৫ ম্যাচ থেকে ৬ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে ‘গোল্ডেন বুট’ এর পুরস্কার পান। তাকে গোল্ডেন বুটের পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলের পুরস্কারটিও দেয়া হয়।
তবে ‘৮২ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটির দাবিদার ছিলেন স্বদেশী খেলোয়ার ব্রুনো কন্তি। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে তিনি দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সেই সাথে তিনি পেরুর বিপক্ষে অসাধারণ এক গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরান। এছাড়া ব্রাজিলের বিপক্ষে দুর্দান্ত ফুটবল শৈলী প্রদর্শন করেন এবং ফাইনালের ইতালির দুইটি গোলে তার অবদান ছিল।
পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ব্রুনো কন্তি নজরকাড়া পারফরম্যান্সের প্রমাণ করে দেয় তিনি ১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য দাবিদার ছিলেন। কিন্তু ফিফার পক্ষ থেকে গোল্ডেন বল পুরস্কারটি দেয়া হয় পাওলো রসিকে।
লিলিয়ান থুরামের পরিবর্তে রোনাল্ডো
১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রোনাল্ডো এক কথায় অসাধারণ ফুটবল খেলেছেন। শুধুমাত্র ‘৯৮ সালের বিশ্বকাপে নয় তার আগের দুই মৌসুমেও তিনি বার্সেলোনা এবং ইন্টার মিলানের হয়ে দুর্দান্ত দুটি মৌসুম কাটান। এরপর বিশ্বকাপে এসে তিনি যে ফুটবল শৈলী প্রদর্শন করেন সেটার সাথে তুলনা করা হয় ‘৭০ বিশ্বকাপের পেলে এবং ‘৯০ বিশ্বকাপের ম্যারাডোনার সাথে।
বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে মরক্কোর বিপক্ষে একটি গোল করেন। কিন্তু নকআউট পর্বে এসে রোনাল্ডো তাঁর ফুটবল দক্ষতা প্রদর্শন করেন। নক-আউট পর্বে তিনি চিলির বিপক্ষে নিজে দুটি গোল করেন এবং ডেনমার্কের বিপক্ষে দুটি গোলে সহায়তা করেন। এরপর সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি গোল করেন। সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত দারুন খেললেও ফাইনালে এসে ফ্রান্সের বিপক্ষে পুরোপুরি ফ্লপ ছিল ব্রাজিল এবং রোনাল্ডো। তবে ‘৯৮ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রোনাল্ডো। কিন্তু ‘৯৮ বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার এর সবচেয়ে যোগ্য দাবিদার ছিলেন ফরাসি খেলোয়াড় লিলিয়ান থুরাম।
রক্ষণভাগের তার অসাধরণ নৈপুণ্যের কারণে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম গোল হজম করে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড করে ফ্রান্স। ‘৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্স মাত্র ২টি গোল হজম করে। সেমিফাইনালে তিনি ফ্রান্সের হয়ে জয়সূচক দুটি গোল করেন। তার দুটি গোলের কারণেই ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ফাইনালে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে ফ্রান্স। লিলিয়ান থুরামের অসামান্য ফুটবল দক্ষতা ‘৯৮ বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে মাত্র ৮.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্রোঞ্জ বল পান থুরাম। অন্যদিকে ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে গোল্ডেন বল জিতেছেন রোনালদো।
রোনাল্ডোর পরিবর্তে অলিভার কান
২০০২ সালে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোনো গোলরক্ষক সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বল’ পান। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পুরষ্কারের সবচেয়ে বড় দাবিদার ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রোনাল্ডো। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালের পূর্ব পর্যন্ত জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কান মাত্র একটি গোল হজম করেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে ভেঙে পড়ে অলিভার কানের দুর্গ। রোনাল্ডোর জোড়া গোলে পঞ্চম বারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল।
ফাইনালের আগের দিন ফিফার পক্ষ থেকে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে ফাইনালের আগের দিন ভোট নেওয়া হয়। সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে অল্পকিছু সাংবাদিককে ভোট দেয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়। সেই ভোটে ২৫ শতাংশ ভোট পান অলিভার কান এবং ২১ শতাংশ ভোট পান রোনালদো। তবে শেষ পর্যন্ত রোনাল্ডো ব্যক্তিগত পুরস্কারটি না পেলেও দেশকে পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেন।
ফ্যাবিও ক্যানাভারোর পরিবর্তে জিনেদিন জিদান
২০০২ বিশ্বকাপ থেকে শিক্ষা না নিয়ে চার বছর পর আবারও ফিফা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফাইনালের আগের দিন ভোটের মাধ্যমে বিশ্বকাপের সেরা খেলা নির্বাচন করে এবং আবারো ভুল মানুষের হাতেই গোল্ডেন বলের পুরস্কারটি যায়। খেলোয়াড় হিসেবে জিনেদিন জিদান ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়ার। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদানের পারফর্ম সেরা খেলোয়াড় হওয়ার মতো ছিল না।
গ্রুপ পর্বে দুই ম্যাচ ড্র এবং শেষ ম্যাচে টোগোর বিপক্ষে ২-০গোলে জিতে নকআউট পর্বে ওঠে ফ্রান্স। নক-আউট পর্ব থেকে ঘুরে দাঁড়ায় ফ্রান্স এবং জিদান। নকআউট পর্বে স্পেন এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে অসাধারণ খেলেন জিনেদিন জিদান এবং সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে একমাত্র গোলটি করেন। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদান কুখ্যািত অর্জন করেছেন ফাইনালে মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুশ মেরে। যদিও ২০০৬ বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে ফাইনালে তুলতে জিনেদিন জিদানের সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য এটা যথেষ্ট ছিল না। অন্যদিকে ইতালির জিয়ানলুইজি বুফন, অধিনায়ক ফ্যাবিও ক্যানাভারো গোল্ডেন বলের যোগ্য দাবিদার ছিলেন। বার্লিন ওয়াল খ্যাত ফ্যাবিও ক্যানাভারো অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের শিরোপা যায় ইতালির ঘরে।
কিন্তু দারুণ খেলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হতে পারেননি অধিনায়ক ফ্যাবিও ক্যানাভারো।
আরিয়েন রোবেনের পরিবর্তে লিওনেল মেসি
২০১৪ বিশ্বকাপে শিরোপার খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে লিওনেল মেসিকে। তবে দলকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিতে না পারলেও তিনি ব্রাজিল বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। তবে তার এই পুরস্কারের সম্পর্কে তার স্বদেশী মহাতারকা দিয়েগো ম্যারাডোনা বলেন,
আমি লিওকে একই সাথে স্বর্গ এবং পৃথিবী দিতে পারি কিন্তু যখন মার্কেটিংয়ের মানুষেরা চান তিনি কিছু জিতুক যেটার যোগ্য তিনি নন, তখন সেটা অন্যায়।
২০১৪ বিশ্বকাপে লিওনেল মেসিকে গোল্ডেন বল পুরস্কার দেয়ার বিষয়টি নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেকেই বলেছেন বাণিজ্যিক কারণে লিওনেল মেসিকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসির পারফর্মেন্স খুব আহামরি কিছু ছিল না।
বরং গোল্ডেন বল জয়ের মতো পারফর্মেন্স ছিল তার স্বদেশী খেলোয়ার হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানোর। ২০১৪ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জয়ের যোগ্য খেলোয়ারদের মধ্যে ছিলেন কেইলর, ম্যানুয়েল ন্যূয়ার, টনি ক্রুস, হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো এবং আরিয়েন রোবেন। তবে সবচেয়ে বড় দাবিদার ছিলেন আরিয়েন রোবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি ওঠে লিওনেল মেসির হাতে।
Featured Image: fifa.com