চাকরিতে অস্বচ্ছতা, অস্বচ্ছতায় চাকরি – সুশান্ত পল

টাকা ছাড়া সরকারি চাকরি হয় না। কথাটি পুরোপুরি সত্য। আমিও টাকা দিয়েই চাকরি পেয়েছি। আমার খরচ হয়েছিলো ৭০০ টাকা। ফরমের দাম ২০০ টাকা আর পরীক্ষার ফি ৫০০ টাকা। এতটুকুই মনে পড়ে। এর বাইরে গাড়িভাড়া ছাড়া আর একটা পয়সাও কোথাও খরচ করিনি। সেই গাড়িভাড়া খরচ করতে পিএসসি আমাকে বাধ্য করেনি। আমার পায়ে হেঁটে যাওয়ার আপত্তি থেকেই গাড়িভাড়াটা নষ্ট হয়েছে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

সুপারিশ ছাড়া সরকারি চাকরি হয় না। এটাও পুরোপুরি সত্য। আমি ৩০তম বিসিএস প্রিলিতে কোয়ালিফাই করার পর রিটেনের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলাম, পরবর্তীতে রিটেনে পাস করার পর ভাইভার জন্য মনোনীত হয়েছিলাম। অবশেষে ৩০তম বিসিএস-এ চাকরির জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। শুধু সুপারিশ আর সুপারিশ! আমার চাকরির পরীক্ষা নিয়েছিলো পিএসসি, আমার জন্য সুপারিশও করেছিলো পিএসসি।

ওপরের ব্যাপার দুটো শুধু আমার ক্ষেত্রে না, আমার সাথে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের অন্তত শতকরা ৯০ ভাগের ক্ষেত্রেই সত্য।

একটা কথা এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি। কর্পোরেট সেক্টরে বাংলাদেশে সেরা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান হল বিএটি (ব্রিটিশ আমেরিক্যান টোব্যাকো)। সেখানে চাকরি করতে পারাটা অনেক গ্র্যাজুয়েটের কাছেই স্বপ্নের ব্যাপার। খোঁজ নিয়ে দেখুন না, ওখানেও ইদানিং চাকরি দেয়ার জন্য তদবির আসে অনেক হাইপ্রোফাইল মন্ত্রীদের কাছ থেকে! এরকম নজির আরও কয়টা চান, বলুন? শুধু সিভিল সেক্টরেই চাকরিতে ঢুকতে যত দুর্নীতি? অনেকক্ষেত্রেই কর্পোরেট চাকরি পেতে কী কী নোংরামির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেকথা আরেকদিন বলবো। অনার্সে আমার যে রেজাল্ট, সে রেজাল্ট নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করারই কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে অ্যাপ্লাই করতে লাগে অন্তত ৩.০০, আর আমার ছিল ২.৭৪। অনার্সের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট দিয়ে সিভিল সার্ভিসে জয়েন করার চাইতে বেশিকিছু করার যোগ্যতা আমার ছিল না। ওতে অবশ্য একটা সুবিধাও হয়েছিলো। আমি যখন বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন আমার অনেক বন্ধুই বলাবলি করছিলো, “সুশান্ত বিসিএস দেবে না তো আর কী করবে? ও তো কর্পোরেটে যেতেই পারবে না! ওর যে রেজাল্ট, তাতে তো ও আর কোথাও অ্যাপ্লাইই করতে পারবে না! বিসিএস লেস কোয়ালিফাইড লোকজনের চাকরি। কিন্তু এছাড়া তো ওর আর কোনো উপায় নেই।” এসব শুনেটুনে তখনই ঠিক করে ফেললাম, “ঠিক আছে, কর্পোরেট সেক্টরে ঢোকার জন্য বাংলাদেশে বেস্ট যে গেটওয়ে, আমি সেখানেই যাবো, সেখান থেকে এমবিএ করবো, কিন্তু সে ডিগ্রিটাকে চাকরি পেতে ব্যবহার করবো না। আমি সবাইকে এটা দেখিয়ে দেবো যে, আমি চাইলেই কর্পোরেটে যেতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করে যাইনি।” আর কিছু নয়, স্রেফ সেই জেদ থেকে আমার আইবিএ থেকে মাস্টার্সকরা।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

এখনও, শতকরা ৬৫ ভাগ সরকারি চাকরি হয় টাকা কিংবা সুপারিশ/ তদবির ছাড়াই। বাকি ৩৫ ভাগ চাকরি পাওয়ার অবৈধ যে কালচার, সেটা যে শুধু এ দেশেই আছে, তা নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আছে, বরং ওখানে দুর্নীতি একটু বেশিই আছে। আপনারা জানেন, ভারতে সরকারি চাকরির বিভিন্ন সুযোগসুবিধা আমাদের চাইতে অনেক অনেক বেশি। যদি পরীক্ষাপদ্ধতি এবং ভ্যাক্যান্ট পোস্টের সংখ্যার সাথে ক্যান্ডিডেটের সংখ্যার অনুপাত হিসেব করেন, তবে দেখবেন, একজন আইসিএস অফিসার হওয়াটা একজন বিসিএস অফিসার হওয়ার চাইতে অনেকবেশি কঠিন। সেই কঠিন কাজটি যে ভারতীয় পরীক্ষার্থীরা একেবারে ফেয়ার রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে করে ফেলতে পারেন, সেটি কিছুতেই বলা যাবে না। টি এন শেষনের বই ‘ভারতের অধঃপতন’ পড়ে দেখুন। শেষন সাহেব দুটো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছিলেন। একটিতে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস)-এ ১ম এবং অন্যটিতে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস)-এ ১ম হয়েছিলেন। ওরকম রেজাল্ট করা সাধারণ চিন্তাভাবনার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই আমি বিশ্বাস করি। উনার বই পড়লে দেখবেন, ভারতে দুর্নীতির পরিমাণ আমাদের চাইতে কোনো অংশেই কম নয়। দুর্নীতির যে চিত্র আমার আপনার মাথায় আছে, সে চিত্র ভারতেও কমবেশি একইরকমের কিংবা আরও ভয়াবহ। তাই, আমরা খুব uneven কিংবা unfair কম্পিটিশনের মধ্য দিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিই, আর এই বাংলাদেশ ছাড়া সর্বত্রই সবকিছু একেবারেই স্বচ্ছ, এমনটা কিছুতেই নয়। আমরা সবাই ভাবতে পছন্দ করি, আমিই পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষ। আমার পাশের মানুষটি আমার সামনে কখনো কাঁদল না বলে আমি কোনোদিনই জানতে পারলাম না, কী অসীম বেদনা বুকে নিয়ে সে হাসিমুখে কথা বলে! আইয়ুব বাচ্চুর গানের কথাটিই সত্য: আসলে কেউ সুখী নয়……….

এখন কথা হল, আপনি নিজে সেই শতকরা ৩৫ ভাগ চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে নিজেকে রাখতে চান কিনা? এটা নির্ভর করে আপনার আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থানের উপর। তার চাইতে বড় কথা, সেই অবস্থানটাকে ব্যবহার করার (অ)সদিচ্ছার উপর। যদি আপনার টাকার এবং লবিংয়ের জোর থাকে, আপনি সেটা ব্যবহার করুন। কোনো সমস্যা নেই। আমি মন্ত্রীর ছেলে হলে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য বিশাল একটা গাধামি ছাড়া আর কিছুই হতো না। ক্ষমতাবান পিতার সন্তান কেন সে ক্ষমতাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করবে না, যদি সে সন্তানের নিজের ক্ষমতাকে বিকশিত করার অনিচ্ছার বিষয়ে পিতার কোনো আপত্তি না থাকে? ক্ষমতার একধরণের সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ক্ষমতার অপব্যবহার না করে। ক্ষমতার কুৎসিত ব্যবহার ক্ষমতাধরকে কুৎসিত করে তোলে। শিল্পপতির সন্তান জন্মসূত্রেই আপনার আমার চাইতে একশোগুণ বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন। আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় এক উচ্চবিত্তসম্পন্ন ভদ্রলোকের নিম্নবুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেকে উচ্চবেতনে বাসায় গিয়ে পড়াতাম। সে ছেলে কখনো কখনো পিতামাতার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাস করতো। বেশিরভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্রেফ পাস করলেই ওদের গার্ডিয়ানরা মহাখুশি! ইংলিশ মিডিয়াম স্টুডেন্টদের বেশিরভাগেরই ব্রেইন থাকে মাথায় নয়, ঠোঁটের ডগায়। বাবার টাকার জোরে মাথা চলুক আর না চলুক, মুখ খুব চলে! ওরা পাস করলেই গ্র্যান্ডপার্টি! একটা ক্লাস টেস্টে স্রেফ পাস করলেও এতোটাই সেলিব্রেট করে যে, আপনার আমার পুরো শিক্ষাজীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সেলিব্রেশনের খরচ সেটির দশভাগের এক ভাগও নয়। ব্যাপারটাতে আমি নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত ছিলাম। আমার প্রায়ই মনে হতো, শুধু টাকার জন্যই ওকে আমি পড়াচ্ছি আর আমার নিজের সাথে নিজেই প্রতারণা করছি। আমি অনেক করে চেষ্টা করেও ওকে কিছুতেই ভাল রেজাল্ট করাতে পারছিলাম না। নিজের উপরেই রাগ হতো। আমার এই অক্লান্ত ব্যর্থ পরিশ্রম দেখে একদিন সে আমাকে বলল, “স্যার, আমাকে না মারলে একটা কথা বলতাম।” “আচ্ছা, মারবো না। বল।” “স্যার, আমি যদি খুব ভাল করে পড়াশোনা করি, তবে আমি কি আপনার মতো হবো?” (আমি ভাবলাম, আমার বোকা স্টুডেন্টটা সরলমনে আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছে।) “কী যে বল না তুমি! তুমি ঠিকমতো পড়াশোনা করলে, তুমি আরও অনেক বড় হতে পারবে।” “অনেক বড় মানে কী, স্যার?” “মানে, তুমি আরও ভাল জায়গায় পড়াশোনা করতে পারবে।” “ভাল জায়গা মানে এই ধরেন, বুয়েট!” “ওরকম, কিংবা আরও ভালকিছু।” “বুয়েটেই পড়লাম নাহয়। আচ্ছা স্যার, বুয়েটে পড়লে কী হবে? ভাল চাকরি পাবো?” “নিশ্চয়ই! অনেক ভাল একটা ক্যারিয়ার হবে তোমার।” “ওয়েল স্যার, ভাল ক্যারিয়ার। মানে, ভাল বেতনের চাকরি, ভাল লাইফস্টাইল।” “অবশ্যই!” “স্যার, চুয়েটের সিএসই থেকে পাস করে আপনিও তো অনেক টাকা বেতনের চাকরি পাবেন। ৫০-৬০ হাজার টাকা পার মান্থ ইনিশিয়ালি?” “অতো না হলেও কাছাকাছি তো হবেই।” “ধরে নিলাম, অতোই পাবেন। আর আমি যদি বুয়েটে পড়াশোনা করি, তবে আমি পাবো মাসে ১ লাখ।” “তুমি আরও ভালকিছু করতে পারবে, আমি দোয়া করি।” “ওকে স্যার, আপনার দোয়ায় আর আমার পরিশ্রমে আমি নাহয় আরও ১ লাখ বাড়িয়েই পেলাম ইনিশিয়ালি, মানে মাসে ২ লাখ। কিন্তু স্যার, আমার নামে আমার বাবা ব্যাংকে রেখেছেন ৬০০ কোটি টাকা। আমি যদি জীবনে কিছু করতে নাও পারি, তবে আমি বাসায় বসে বসেই ব্যাংক ইন্টারেস্ট পাবো মাসে মাসে অন্তত ৬ কোটি টাকা। বুয়েটে এক ব্যাচের সব স্টুডেন্ট মিলেও তো এই টাকা ইনিশিয়াল স্টেজে ইনকাম করতে পারবে না। টাকা লাইফস্টাইল, সবই আমার আছে। আপনিই বলেন স্যার, আমি কেন পড়াশোনা করবো?” সেই প্রশ্নটি ছিল আমার জীবনে শোনা সবচাইতে কঠিন প্রশ্নগুলির একটি। জীবনের এই সহজ সত্য হিসেব শুনে আমি সেইদিন ওকে আর কিছুই বলতে পারিনি। প্রচণ্ড অপমানে আর অভিমানে সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিনই ওর বাসায় পড়াতে যাইনি। সেদিন ছিল মাসের ২৭ তারিখ। আন্টির অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ওকে আর পড়াইনি, সে মাসের বেতনটা নিইনি। ধনীঘরের সন্তান হয়ে জন্মানোটাও অনেক বড় একটা ‘প্রাপ্তি’। আর ধনীঘরের পিতা হয়ে মৃত্যুটা অনেক বড় একটা ‘অর্জন’। আমার কাছে আর্থিক প্রাপ্তি আর অর্জনের হিসেবটা মোটামুটি এরকম।

আর্থিক আর সামাজিক জোর যদি না থাকে, তবে নিজেকে চাকরির জন্য প্রস্তুত করুন। আপনি যতক্ষণ কোনো একটা সিস্টেমের বাইরে আছেন, ততক্ষণ সে সিস্টেম সম্পর্কে বিষেদাগার আপনাকে একধরণের বোকা বোকা আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই দেবে না। যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, তারা জানেন, শতকরা ১০ ভাগ দুর্নীতি প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্রেই থাকে। ওটা ছাড়া টোটাল সিস্টেমটাই ভেঙে পড়বে। এই দুনিয়াটা ফেয়ার কোনো দুনিয়া নয়, এবং এটা হুট করেই আপনার আমার জন্য আনফেয়ার হয়ে যায়নি। এখন যেমন আনফেয়ার, আগেও ঠিক তেমনিই আনফেয়ারই ছিল, সামনেও এরকমই থাকবে। এ দুনিয়ার সিস্টেমগুলিও দুনিয়ার মতোই আনফেয়ার। আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই আনফেয়ার সিস্টেম নিয়ে অভিযোগ কাদের বেশি? যারা এর মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না, তাদের। এইতো? একটু ভাবুনতো, আমরা কেন নিজেদেরকে পৃথিবীর সেরা মানুষ ভাবছি? আমাদের চাইতে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ এই আনফেয়ার সিস্টেমেই আমাদের চাইতে অনেক ভাল ভাল কাজ করে গেছেন। নাকি, যাননি? কথা হল, আমার আগে কেউ যদি ফেয়ার ওয়েতেই একটা আনফেয়ার সিস্টেমের অংশ হয়ে যেতে পারেন, আর আমি সেই একই কাজটি করতে না পারি, তবে সে ব্যর্থতা সম্পূর্ণই আমার, সিস্টেমের নয়। মজার ব্যাপার হল, সিস্টেমের অংশ হয়ে যাওয়ার পর আপনি নিজেই সেই আনফেয়ার সিস্টেমের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবেন; আপনি নিজে আনফেয়ার হোন, বা না হোন, সে আনফেয়ার কাজটিই করবেন আপনি, কিংবা সরবে হোক, নীরবে হোক, সহযোগিতা করবেন। এর মানে কী দাঁড়াল? আনফেয়ার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আপনার কোনো আপত্তিই নেই। তবে এখন কীসের আপত্তি? নিজে ফেয়ার থেকে একটি আনফেয়ার সিস্টেমে যেমন নিজের মতো করে কাজ করা যায়, তেমনি নিজে ফেয়ার থেকে সেই আনফেয়ার সিস্টেমের অংশও হয়ে যাওয়া যায়। যদি না পারেন, তবে সেটি আপনার সমস্যা, সিস্টেমের নয়। নিজের সমস্যাটিকে খুঁজে বের করুন, সমাধান করার চেষ্টা করুন।

আমার এক ব্যবসায়ী ফেসবুক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। উনার কয়েকটি স্টিলমিল আছে। ভদ্রলোক ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ২য় হয়েছিলেন। উনাকে বছরখানেক আগে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি চাকরিতে না গিয়ে ব্যবসায়ে এলেন কেন?” উনি বলেছিলেন, “আমি ঘুষ খেতে পছন্দ করি না, কিন্তু দিতে পছন্দ করি, তাই ব্যবসায়ে আসা।” এর মানে কী? ব্যবসায়ীরা সাধারণত সৎ কর্মকর্তা পছন্দ করেন না। আপনি আমাকে এমন একজন বিজনেস ম্যাগনেটও দেখাতে পারবেন না যিনি জীবনে বিন্দুমাত্রও দুর্নীতি না করে ব্যবসা করে বড় হয়েছেন। উনি কেন দুর্নীতি করেন? আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। কোনো ব্যবসায়ীই চান না যথাযথ ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করতে। এর কারণ তিনটি: এক। বেশি মুনাফা করা। দুই। উনার কম্পিটিটরদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ার হাত থেকে বাঁচা (কারণ, কেউ না কেউ তো কম ট্যাক্সে ব্যবসা করছে, উনার পণ্য কিংবা সেবার দামও কম)। তিন। কম ট্যাক্স দিতে দিতে অভ্যেস হয়ে গেছে, তাই। এর মানে, আপনি নিজে দুর্নীতি করেন, কিংবা না করেন, একটা দুর্নীতিকে ঘটতে সহযোগিতা করতে আপনি বাধ্য। অর্থাৎ, চাকরিই করুন, আর ব্যবসাই করুন, আপনি নিজেই বৃহৎ একটা করাপ্টেড সিস্টেমের অংশ। আপনি যে সিস্টেম থেকে কোনো সুবিধা নিচ্ছেন, সে সিস্টেমের মধ্যে দুর্নীতি থাকলে, সে দুর্নীতির পাপের ফলটাই তো আপনি ভোগ করছেন, তাই না? মানুষমাত্রই দুর্নীতিগ্রস্ত জীব। ধরুন, আপনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আপনি একটা অডিট ফার্ম খুলেছেন। আপনার কাজ কী? আপনার অর্জিত বিদ্যা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বড় বড় কোম্পানিগুলির ট্যাক্সফাঁকিকে লিগালাইজ করা, এইতো? আচ্ছা, আপনি ফার্ম খোলেননি, কোনো একটা কোম্পানিতে মাসিক ১ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি করেন। আপনাকে একটা ট্যাক্সফাঁকির অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হল। কীরকম? যে করেই হোক, বুদ্ধি করে কোম্পানির ট্যাক্স যাতে ২০ লক্ষ টাকা কম আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে এমনভাবে, যেন ভবিষ্যতেও অডিট করলে ধরা না পড়ে। কাজটি ঠিকভাবে করতে পারলে আপনাকে বোনাস হিসেবে আপনার স্যালারির দ্বিগুণ দেয়া হবে। এখন আপনি কী করবেন? সকল কাগজপত্র সাজিয়েগুছিয়ে রেডি করে ট্যাক্স অফিসে যাবেন আর ওখানকার দায়িত্বে যিনি আছেন, উনার সামনে এমনভাবে ডকুমেন্টস্ প্রডিউস করবেন, যাতে দেখে মনে হয়, ফাঁকির পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকা। যেহেতু সেই কর্মকর্তার ফাইন্যান্সিয়াল নলেজ আপনার চাইতে কম, উনি বাকি ১৫ লক্ষ টাকার হিসেব বেশিরভাগ সময়ই ধরতে পারেন না। কথা হল, উনি কেন আপনাকে সেই ৫ লক্ষ টাকা ফাঁকি দিতে দেবেন? উনি রাজি হলেন না। এরপর উনাকে নানান প্রলোভন দেখালেন। এতেও কাজ হল না। তখন কোন মন্ত্রী, কিংবা উনারই কোনো সিনিয়র কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে উনাকে ফোন করালেন কাজটা করে দিতে। এরপর উনি চাপে পড়ে রাজি হলেন, তবে অর্থের বিনিময়ে। কী পরিমাণ? আপনি অফার করলেন, ৫০ হাজার। রাজি হলেন না। ৭৫; আবারও ‘না’। ১ লাখ? না, হবে না। এইভাবে করতে করতে দেড় লাখে উনি রাজি হয়ে গেলেন। আপনিও খুশি, উনিও খুশি, আর আপনার প্রতিষ্ঠান তো মহাখুশি! উইন উইন সিচ্যুয়েশন। ইউ আর অ্যা ভেরি গুড অফিসার! ব্রাভো! এটাই ঘটে। আমাদের স্টেকহোল্ডাররাই চান না, আমরা ফেয়ারলি কাজ করি। পৃথিবীতে কোনোকালেই কোনো ফেয়ার বিজনেস হয়নি, সামনেও হবেও না। এখানে আমার একটি কথা আছে। আপনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত সৎ মানুষ। মাইনে পান ১ লাখ। আপনার কোম্পানিকে ২০ লাখ টাকা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিলেন আপনার বেতনের দ্বিগুণ পরিমাণ টাকার জন্য। আর সেই ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ট্যাক্স কর্মকর্তার বেতন মাসে ১৫ হাজার টাকা। উনি আপনার কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিলেন উনার বেতনের দশগুণ পরিমাণ টাকার জন্য। আপনি বিক্রি হয়ে আপনার দুই মাসের বেতনের লোভে, আর উনি বিক্রি হয়ে গেলেন উনার দশ মাসের বেতনের লোভে, তাও বাধ্য হয়ে আর কিছুটা অজ্ঞতা থেকেও। উনি দরিদ্র মানুষ, বেতন পান ১৫ হাজার, আপনার চাইতে ৮৫ হাজার কম। আপনি তো আর দরিদ্র নন! আপনি কোম্পানি থেকে গাড়ি পেয়েছেন, ফ্ল্যাট পেয়েছেন, উনি তো কিছুই পাননি। এখন আপনিই বলুন, কার integrity level উপরে? আপনার? নাকি, উনার? খোলাখুলি বলছি। পারলে আপনি শতভাগ সততার সাথে ব্যবসা করুন সব দলিলপত্র ঠিকঠাক রেখে। দেখি, আপনার কাছ থেকে কে ঘুষ চায়! ওরকম কিছু করলে আপনিই কাউকেই এক পয়সাও না দিয়ে ব্যবসা করতেন। আপনার কোম্পানির মালিকই চান না, সবকিছু ফেয়ার ওয়েতে হোক। আপনার প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে চলে, একটু স্টাডি করে দেখুন, বুঝবেন। আমার কাছেই প্রতিমাসে অন্তত ১৫টি ফোন আসে, বন্ধুদের আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের, যাতে আমি অমুককে তমুককে অনুরোধ করে উনাকে ট্যাক্সইভেশনের সুযোগ করে দিই, কিংবা কোনো ইলিগ্যাল কাজ করতে হেল্প করি। আবার সেই হিপোক্রিট জেন্টলম্যানরাই বাইরে বলে বেড়ান, আমরা খুব খারাপ, এটাসেটা! সিভিল সেক্টরই বলুন, আর কর্পোরেট সেক্টরই বলুন, সিস্টেমটাই এমনভাবে সাজানো যে, আপনিই দুর্নীতি করতে হেল্প করেন, আপনিই চান দুর্নীতি হোক, সিস্টেম চায় দুর্নীতি থাক। অনেকসময়ই আমাদের সেবাগ্রহীতারা জানেন না, কোথায়, কেন কোন সেবার জন্য যেতে হবে। এই অজ্ঞতার কারণেও দুর্নীতি হয়। আপনি যদি কোনো অফিসে হয়রানির শিকার হন, তবে কেন আপনি অফিসের কর্তাব্যক্তির রুমে অভিযোগ করতে যান না? সরকারি কর্মচারী আপনাকে সেবা দিতে, আপনার কথা শুনতে ও আপনার সাথে কথা বলতে বাধ্য! উনি জনগণের চাকরি করেন, আপনার ট্যাক্সের টাকায় উনার বেতন হয়। গিয়ে দেখেছেন কখনো? আমি অনেক বন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছি, “তুই অন্যকারোর সাথে কথা না বলে সরাসরি অফিসপ্রধানের সাথে দেখা করে তোর সমস্যা নিয়ে কথা বল। আমি ফোন করে দেয়ারও প্রয়োজন নেই, তুই গিয়ে আলাপ কর।” এতে দুটো ব্যাপার দেখেছি। এক। সঠিক ব্যক্তির কাছে সঠিক সময়ে যাওয়াতে ওর কাজটি হয়ে গেছে। দুই। বেশিরভাগই যেতে রাজি হয়নি, কারণ ওর নিজেরই কিছু সমস্যা ছিল। তাই বলি, যান না কেন মশাই? নাকি, উনার রুমে গেলে থলের বেড়াল আর বেড়ালছানারা বেরিয়ে পড়তে পারে বলে ভয়ে যান না? আমি দেখেছি, যা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটি করে দিলেও অনেকেই ধরে নেন, আমি উনার অনেক বড় একটা উপকার করলাম। অধিকার আর আনুকূল্য, এক কথা নয়। প্রাপ্য সেবা পাওয়াটা আপনার অধিকার, কারোর আনুকূল্য নয়।

যে কথায় ছিলাম। সবাইই যে টাকা আর লবিংয়ের জোর ব্যবহার চাকরিতে আসতে রাজি হন, তাও কিন্তু না। যারা ওই দুটো ব্যবহার করেন, কিংবা করতে চান, তাদের হয়তো চাকরিটা খুব দরকার, কিন্তু চাকরিটা নিজের যোগ্যতায় জোটাতে পারছেন না। এমনও দেখেছি, অনেকেই আত্মসম্মানবোধের অভাবে নিজেকে টাকা দিয়ে বিক্রি করেন কিংবা অন্যের কাছে হাত পেতে দেন। এটা ঠিক নয় যে, ওরকম না করলে চাকরি হয়ই না। আগেই বলেছি, কমপক্ষে শতকরা ৬৫ ভাগ চাকরি এখনও যোগ্যতায় হয়। বাকি ৩৫ ভাগ ক্যান্ডিডেটের মাথায় এটা ঢুকেই গেছে, নিজেকে নিচে না নামালে উনি চাকরিটা পাবেন না। এতে করে আত্মসম্মানবোধ আর আত্মবিশ্বাস, দুটোই কমে যায়। সবসময়ই অজুহাত দেখানো এবং অভিযোগ করার প্রবণতা বাড়ে। নিজের ভাগ্য আর সিস্টেমকে দোষারোপ করতে করতেই জীবনটা কাটে। যে চাকরি আমি নিজের যোগ্যতায় পাচ্ছি না, সে চাকরিটা আমার জন্য নয়—এটা মেনে না নিলে অসন্তোষ বাড়তেই থাকে, নিজের মনে অশান্তিবৃদ্ধি ছাড়া আর কাজের কাজ কিছুই হয় না। আপনাকে অমুক চাকরিটা করতেই হবে কেন? সবাই কি আর সবকিছু পারে? আপনার যোগ্যতার বিচারে কী কী চাকরি আছে, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ভেবে দেখুন। একটা চাকরি পাওয়ার চিন্তা মাথায় ‘সেট’ হয়ে গেলে মানুষ অন্যান্য চাকরির সুযোগ ও সম্ভাবনার প্রতি অন্ধ হয়ে পড়ে আস্তে আস্তে। এতে করে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও সম্মানবোধ কমতে থাকে, এবং জীবনে ‘ভালথাকা’টা আর হয়ে ওঠে না। Complain আর Excuse—নিয়ে যারা বাঁচে, আমি তাদের মধ্যে দুটো আত্মঘাতী প্রবণতা দেখেছি: দাম্ভিকতা আর আত্মতুষ্টি। জীবনে অজুহাত দিয়ে কী হয়? আপনি যদি সফল হতে পারেন, তবে আপনার তো কোনো অজুহাতই দেখাতে হবে না। আর যদি ব্যর্থ হন, তবে আপনার অজুহাত তো কেউ শুনবেই না! বামহাত, ডানহাত আর অজুহাত—এই তিনহাতের মানুষ নিজেদেরকে ক্ষমা করে দেয় খুব সহজেই। যার সব অভিযোগ অন্যদের উপর, নিজের উপর কোনো অভিযোগই নেই, সে নিজেকে ক্ষমা করে দিতে অভ্যস্ত। ওরা কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে জানে না এবং নিজের অক্ষমতাকে ফাঁকা ঔদ্ধত্য দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। এমন মানুষকে আমি খুব একটা বেশিদূর যেতে দেখিনি। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষাতেও ফেল করে, অথচ কী অহংকার, কী বড় বড় কথা, এরকম বেহায়া লোককেও দেখেছি আমি। ওদেরকে আমাদের সমাজ স্রেফ করুণার চোখে দেখে। যে পণ্ডিত বটগাছতলায় বসে বসে তার পাণ্ডিত্য ধুয়ে পানি খায়, সে পণ্ডিতের চাইতে নিজের বাহুর জোরে জীবিকা নির্বাহকারী অশিক্ষিত মুচিও উত্তম।

আমাদের জাতীয় অনেক বোঝার মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা। এটা নিয়ে অনেক অসন্তোষ দেখা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, কোটাপদ্ধতির জন্যই উনি চাকরি পাচ্ছেন না। কিন্তু যারা কোটাপদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন, তাদের কথা উনার মাথায় থাকে না। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু সার্টিফিকেট নেননি বলে আমার নিজেরও কোনো প্রাধিকার কোটা ছিল না। (আগ্রহীরা আমার ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা নই’ নোটটি পড়ে দেখতে পারেন।) আমি যখন বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, তখন আমি খুব ভাল করেই জানতাম, এই কোটাপদ্ধতির কারণে আমি একটি অসম প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি। এটা নিয়ে আমার মধ্যে অসন্তোষ ছিল, কিন্তু কোনো আপত্তিই ছিল না। কারণ, পিএসসি আমার কাছে কোনোকিছুই লুকিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছে না, আমি নিজের ইচ্ছেয় নিজের প্রয়োজনে সবকিছু জেনেশুনে পরীক্ষা দিতে রাজি হয়েছি। একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের কোন একটি ট্রেনিং সেশনে কোম্পানির সিইও ক্লাস নিচ্ছিলেন। ক্লাসে ইন্ডিয়ার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে পাসকরা অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে ছিলেন। “আমাদের উচিত, অমুক অমুক সেক্টরে চেঞ্জ আনা, তাহলে আমরা আরও ভাল সার্ভিস দিতে পারতাম।” “এই পুরোনো সিস্টেমকে দিয়ে আর চলবে না, কিছু কিছু পরিবর্তন আনতেই হবে।” “এই সিস্টেমে কাজ করা খুব কঠিন।” এরকম নানান প্রস্তাব আসতে লাগল নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে। সবার সব কথা চুপচাপ শুনলেন সিইও। এরপর শীতলকণ্ঠে হাসিমুখে বললেন, “আমি মেনে নিচ্ছি, আপনাদের সবার সব কথাই ঠিক। একইসাথে এটাও ঠিক, আপনাদের বিপ্লব ঘটানোর জন্য চাকরিটা দেয়া হয়নি। What is, is the rule; not what should be. আমরা এমনই বাজে। এই বাজে সিস্টেমটা নিয়েই আমরা কাজ করছি অনেক বছর ধরে। আপনাদের এই সিস্টেমে কাজ করতে আপত্তি থাকলে আপনারা অন্য চাকরির খোঁজ করতে পারেন। We heartily welcome you to leave anytime! Thank you.” সরকারি চাকরিতেও একটাই নিয়ম: Obey, or leave!

পিএসসি কোনোকালেই কোনো মহাত্মা বাহাদুরের বাসায় চাকরির পরীক্ষার ফরম কিনতে বাধ্য করার জন্য র‍্যাব-পুলিশ পাঠায়নি, নিকট কিংবা দূর ভবিষ্যতেও পাঠাবে না। আমি জানতাম, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%, যেটার মাত্র (৬-৭)% ভাগ পূর্ণ হয়, বাকিটা খালিই থাকে। উপজাতি কোটা ৫%, যেটার ২.৫% পূর্ণ হয়। আমার চাইতে ৬% ভাগ মার্কস কম পেয়েও কোটাধারীরা চাকরি পাবে। প্রাধিকার কোটায় পোস্ট খালি আছে, কিন্তু চাকরি দেয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি বলে হয়তো সেগুলিতে কোনো কোনো অসাধু ব্যক্তি দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে আমার চাইতে কম যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেবেন। হ্যাঁ, আমি সবই জানতাম। এও জানতাম, এতে আমার কোনোই হাত নেই। এই বিষয়টি পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমার চাকরিটা খুব দরকার, তাই আমি নিজেকে সেটার জন্য প্রস্তুত করা নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কাজটি পার্লামেন্টেরিয়ানদের হাতে ন্যস্ত, সেখানে আমার বৃথা আস্ফালন শুধু নির্মল বিনোদনসৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। এ পৃথিবীতে অনেক সমস্যা আছে, যেগুলির অনেকগুলিই আমাকে মানসিকভাবে পীড়িত করে। সেগুলির মধ্যে যেগুলির কোনো সমাধান আমার হাতে নেই, সেগুলি নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। আমি চাইলেও কোনোভাবেই ওই শূন্য পদগুলিতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো না। আর ওই শূন্য পদগুলি নিয়ে যে যা-ই ইচ্ছে করুক না কেন, ওতে আমার যে হক, মানে ৪৪%, সেখানে তো কোনোই প্রভাব পড়ছে না! অযথা অহেতুক হৈচৈ করার চাইতে পড়াশোনা করাই তো বরং ভাল! আমি ৩ ধরণের জিনিস নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাই না: এক। যে জিনিসটা আমার ভাল লাগে না। দুই। যে জিনিসটা আমার দরকার নেই। তিন। যে জিনিসটাতে আমার কোনো হাত নেই। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, অন্যান্য সরকারি চাকরির চাইতে বিসিএস পরীক্ষায় দুর্নীতি এখনও অনেক কম হয়। দুর্নীতি যদি হয়ও, সে দুর্নীতিতে সাধারণ প্রার্থীদের (৪৪%) কোন ক্ষতি হয় না। যাদের লবিং আছে, টাকাপয়সা খরচ করে চাকরি পেতে চায়, তারা নিশ্চয়ই সাধারণ প্রার্থী নন। কোটা সিস্টেম নিয়ে যাদের ক্ষোভ, তাদের ৯৮% ভাগ ক্যান্ডিডেটেরই কোনো কোটা নেই। উনাদের কোটা থাকলে সেই ক্ষোভটা আর থাকত কিনা, সেটা নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। তাহলে, প্রশ্ন হল, ক্ষোভটা কোথায়? কোটাপ্রথা নিয়ে? নাকি, উনাদের কোটা নেই কেন, সেটা নিয়ে? অনেককেই বলতে দেখি, “যাদের কোটা আছে, তারা আমার চাইতে অযোগ্য।” আরে ভাই, মানছি ওরা আপনার চাইতে অযোগ্য। তা, মুখে এমন পকপক না করে কোটা ছাড়া চাকরিটা পেয়ে নিজের যোগ্যতাটা দেখিয়েই দিন না বস!

‘পরশ্রীকাতরতা’ শব্দটির কোনো যথার্থ ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায় না। কেন যায় না? কারণ, এই শব্দটি শুধুই বাংলা, এই হৃদয়ের ঐশ্বর্য শুধুই বাঙালির। পরশ্রীকাতরতা—সে আমাদের সম্পত্তি নয়, সে আমাদের সম্পদ!! সে স্তূপীকৃত সম্পদের চাপে পিষ্ট হয়ে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই রয়ে যাচ্ছি যুগের পর যুগ। অভিধানে ‘পরস্ত্রীকাতরতা’ শব্দটিও এক ফাঁকে ঢুকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আরেকজনের ঘরের বৌটি আমার ঘরের বৌয়ের চাইতে সুন্দর, সে দুঃখে আমার ঘুম হারাম, ঠিকমতো ভাতটাতও হজম হয় না। কী লাভ এতে? আরেকজনের ঘরে সুন্দরী বৌ আছে, ওকে দেখলেই আমার মনে সুখ সুখ লাগে, ওর কথা ভাবলেই আমার মনে দুঃখ দুঃখ লাগে। কিন্তু কেন? আমাকে তো এটা বুঝতে হবে, যে অন্যঘরের রূপসী আমার ঘরের সুখ হরণ করেছে, সে আমার নয়! আরেকজনের কোটা কখনোই তো আমার হবে না! কোটাকাতরতা তাই অনেকটাই পরকোটাকাতরতা, পরস্ত্রীকাতরতার মতোই। আমি অনেক ক্যান্ডিডেটকেই দেখেছি, শুদ্ধভাবে ইংরেজিতে quota (কোটা) বানান করতে করতে পারেন না, অথচ দাবি করেন, কোটা সিস্টেম আছে বলেই উনার ভাগ্যে চাকরিটা জুটছে না। অনেকেই আছেন, cadre (ক্যাডার) বানান জানেন না, ক্যাডার হতে চান। দেখে হাসিও পায়, কষ্টও লাগে। আপনারাই বলুন, এই পণ্ডিতম্মন্যদেরকেও কেন চাকরি পেতে হবে? উনাদেরকে বিনীতভাবে বলছি, ভাই, সময় থাকতে পড়াশোনা করুন, নাহলে আপনি তো আপনিই, আপনার ফুল ফ্যামিলি মিলে পরীক্ষা দিলেও কোনো সম্মানজনক চাকরি জুটবে না ভাগ্যে।

সুখের কথা, বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই টেকনিক্যাল আর প্রফেশনাল ক্যাডারে প্রাধিকার কোটার যে পোস্টগুলি যোগ্য ব্যক্তির অভাবে শূন্য থাকে প্রতি বিসিএস-এ, সেগুলিতে অপেক্ষমান তালিকা থেকে মেধাতালিকা অনুযায়ী প্রার্থীদের চাকরি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাধারণ ক্যাডারেও এই প্রক্রিয়া শুরু হোক, আরও কিছু যোগ্য ব্যক্তিকে দেশের সেবা করার সুযোগ দেয়া হোক, এটাই আমাদের চাওয়া।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

 

Courtesy: সুশান্ত পল

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *