” তোমরা যারা মেডিক্যালে চান্স পাওনি ”
ডা. মোঃ আবু ইমরান মিল্টন
এফসিপিএস (সার্জারি)
_____________________________
আমাদের যুগে সব বাবা-মা-ই চাইতো তার ছেলে ডাক্তারি পড়বে। মেয়েদের নিয়ে তারা বেশি আশা করতে পারতো না। মেয়ের ভালো একটা বিয়ে হবে এটা তাদের সর্বোচ্চ আশা ছিল। ছেলেরা কিন্তু স্বভাবতই ডাক্তারিতে কম আগ্রহ বোধ করতো। কারণ, তৎকালীন নায়ক যারা ছিলেন ম্যাকগাইভার, ফলগাই, নাইট রাইডার, কেউই তো ডাক্তার ছিলেন না। কতিপয় ঘরকুনো গোবেচারা পিতা-মাতার চাপে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারি পড়তে চাইলেও বন্ধুমহলে কখনো তা স্বীকার করতো না। আমি ছিলাম সেই দলের একজন। দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি আমি কোনোদিন ডাক্তার হবো। জীবনে যতোবার ‘মাই এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখেছি কখনোই ডাক্তার হতে চাই- এটা লিখিনি। সবসময় একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছি। ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। কিন্ত সে স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি। উপরওয়ালা যা চেয়েছেন, আমাকে সে পথেই আসতে হয়েছে।
সেসময় সবাই মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত। মেডিক্যালে চান্স পাওয়াটা যেনো মেধা নির্ণায়ক একটা পরীক্ষা। কেউ চান্স পেলে সমাজ তাকে মেধাবি হিসেবে মেনে নিতো। অনেকের তো সেসময় বিয়েও ঠিক হয়ে যেতো। কন্যার পিতারা ডাক্তার জামাই পেয়ে গেছেন ভেবে তড়ি ঘরি করে মেয়ে বিয়ে দিতেন। সমাজে তখন সেই মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর দামও থাকতো আকাশছোঁয়া। এরকম মেডিক্যালে চান্স পেয়েই কবুলপড়া কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু তো শ্বশুরের উপহার দেয়া নতুন শার্ট-প্যান্ট পরেই প্রথম ক্লাসে এসেছিল। তবে, আমার ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। রেজাল্টের পর বাসার টিঅ্যান্ডটি লাইনে ফোন আসতে লাগলো- কীভাবে পড়াশোনা করেছিলাম। কোথায় কোচিং করেছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কোচিং সেন্টারগুলো বাসায় এসে ছবি নিয়ে যেতে থাকলো। যেন তাদের সাথে আমার কত দিনের পরিচয়। তাদের খামারে লালিত হয়েই যেন আজ আমার এই অবিস্মরণীয় সাফল্য। বাবা-মা’র কাছেও যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেলাম। খাবার-দাবারে বিশেষ যত্ন। ঘুমানোর সময় কেউ যেন শব্দ না করে- কারও জোরে কথা বলার জন্য যেন আমার ঘুমের ডিস্টার্ব না হয় সে বিষয়ে বাবা-মাসহ বাসার সবাই একটা বিশেষ সুবিধাদি নিশ্চিত করতে থাকলেন। সবকিছু মিলিয়ে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। ঠিক একই রকম অনুভূতি হলো এফসিপিএস পাশ করার পর। আসলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই আমাদের কাঁদায় আবার হাসায়। কাছের মানুষের চোখের আনন্দই আমাদের প্রকৃত সুখ। আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ড্রোন বানাতে পারলাম কিনা তাতে কারো কিছু আসে যায় না।
আজ আমি বিভিন্ন রকম অপারেশন করি। কাটি আবার জোড়া লাগাই। ব্যথা কমাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্নাকাটি করি- আল্লাহ যা করলাম সব ঠিক-ঠাক থাকে যেনো। ইনফেকশন যেনো নাহয়। আমি পাপী বান্দা। আমার পাপের শাস্তি রোগীকে দিওনা আল্লাহ। তুমি তো ন্যায় বিচারক। আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। কিন্তু আমি তো আজন্ম নাফরমান। ফজরের নামাজ জোহরে পড়ি, আবার কান্দি। আল্লাহ মাফ করে দাও। তুমি তো পরম দয়াময়।
রাতে শুয়ে-শুয়ে ভাবি- এরকম একটা সিস্টেম বানালে কেমন হয়- মোবাইলে বিছানায় শুয়ে দেখতে পারবো বাসার লাইট-ফ্যানের সুইচ বন্ধ আছে কিনা, দরজা বন্ধ আছে কিনা, পানির ট্যাংকিতে পানি কতটুকু আছে, আইপিএস-এর ব্যাটারিতে চার্জ কতটুকু আছে। সিকিউরিটি গার্ড ঘুমোচ্ছে কিনা ইত্যাদি। ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুদের এক্ষুণি বলে রাখছি, বাড়ি যদি কখনো করি এরকম জিনিস কিন্তু আমাকে বানিয়ে দিতেই হবে। আর্কিটেক্ট বন্ধু ‘পলক’কে বলে রাখছি- এমন ম্যাটেরিয়াল ও ডিজাইন চাই ভাদ্রমাসেও যেনো ঘরের তাপমাত্রা 27 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট থাকে।
এবার শুনুন আমার মেডিক্যাল ছাত্রজীবনের কিছু কথা। একেতো মেডিক্যাল পড়ার ইচ্ছা কোনোকালেই ছিলনা তার উপর ইংরেজি ভাষায় মুখস্ত করা বিদ্যা আমার একেবারেই পছন্দ না। শিক্ষকদের বিমাতাসুলভ আচরণের কথা নাই-বা বললাম। তথাপি এনাটমি, ফিজিওলজি যারা পড়ান তারা নিজেরাও এইবিষয়গুলো আগ্রহবোধ করেন না। আমি জানি আমার এ লেখা আমার অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকও পড়ছেন। মনে মনে তারা বলবেন, ‘তা তুমি এসে উদ্ধার করো আমাদের’। মেডিক্যাল জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমি অন্তত এটা উপলব্ধি করছি- এনাটমি, ফিজিওলজি কোনো ছেলেখেলা নয়। টিচার নাই তাই বলে সদ্য চাকুরি পাওয়া ডাক্তারকে শহরের থাকার সুযোগ দিয়ে লেকচারার পোস্ট দেয়াটা ছাত্রদের জন্য কল্যাণকর হয় না। এনাটমির জন্য একজন সার্জন যেভাবে সুখকর লেকচার ডেলিভারি দিবেন, ফিজিওলজির ক্ষেত্রেও একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সেভাবে ছাত্রদের হৃদয় ঢুকতে পারবেন। বিষয়টা আপতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও একদিন এটাই বাস্তবায়িত হবে।
আমি বারবার মূল ঘটনা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। শিখতে শুরু করেছিলাম এক বিষয় নিয়ে, এখন চলে গেছি আরেক জায়গায়। যা বলছিলাম- আমাদের যুগের পিতা-মাতার মতো আমিও এখন চাচ্ছি আমার সন্তান একদিন মেডিক্যালে ভর্তি হোক, চান্স পাক। এখানে আমার চাওয়ার কারণটা একটু ভিন্ন। আমি তাকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবো। ফার্স্ট ইয়ার থেকে রেসিডেন্সি কমপ্লিট করা পর্যন্ত। আমাদেরকে কেউ কখনো তো সাহায্য করেইনি উল্টো বিপথে পরিচালনা করে, সে পথে ধরে রাখার জন্য মরণপণ চেষ্টাও করেছে। শিক্ষকরা, বড় বড় বইয়ের নাম বলেই খালাস। হোস্টেলে থাকবে? চলতে হবে বড়ভাইয়ের কথায়। কখন কী করবা তারাই ঠিক করে দেবে। এখনকার পরিস্থিতি জানি না। ভেবেছিলাম মেডিক্যাল ছাত্রজীবন মানে সাদা ধবধবে এপ্রোন পরে সুন্দর ক্লাস রুমে, ল্যাবরেটরিতে, লাইব্রেরিতে সারাদিন। কিন্তু বাস্তবে দেখাযায় উল্টো। সন্ধ্যায পড়তে বসেছো, বড়ভাই এসে হাজির।কী করোছ? হা…হা…হা…! পড়তাছোস নাকি? তুই তো নিশ্চিত ফেল, এখন পড়লে কিছু মনে থাকবো না। গভীর রাতে পড়বি। সবাই যখন ঘুমাইবো, দেখবি মাথাও কাম করবো, খালি পড়তেই ইচ্ছা করবো, যা পড়বি মনে থাকবো। এখন পড়লে কিছুই মনে থাকবো না। আমি ভাবলাম- তাই তো, ঠিকই তো। তুই নাকি গিটার বাজাস? দেখি বাইর কর, আমার লগে বিবাগী গানটা বাজাতো বলেই বড়ভাই জিন্সপ্যান্টের পিছনের পকেটের মধ্যে অর্ধেক ঢুকিয়ে রাখা দুইটা ড্রামস্টিক বের করে আমার বালিশ কাছে টেনে নিয়ে পজিশন বানিয়ে বালিশের উপরে বাড়ি দিতে শুরু করলেন। আমি বললাম- ভাই! বালিশ ফেটে যাবে তো। ‘আরে না ব্যাটা, আমি তো প্রেসার দিয়ে বাজাচ্ছি না। তূর্য়ভাইরে চিনোস না?’ ‘না ভাই চিনি না’। তিনি চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললেন, কস কী তুই? তুর্য়ভাইরে চিনস না! মাইলস্-এর ড্রামার’। আমি লজ্জিত দৃষ্টিতে তার দিকে না তাকিয়েই বললাম- জ্বি ভাই এখন চিনছি। চশমা্ওয়াল , নাম তুর্য় তা জানতাম না। ক্যান ভাই? তুর্য়ভাই কি বলসে বালিশের উপরে ড্রাম বাজাইতে!’ তখন তিনি কিছুটা ক্ষ্যাপে গিয়ে বললেন- ‘ওই ব্যাটা, মজা লস আমার লগে? ফাইজলামি করস?’ আমি তখন বললাম, ‘না ভাই! মাফ কইরা দেন।’ তখন তিনি কণ্ঠে কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ‘শোন! আমি যেমনে কই তেমন চলবি এখন থিক্কা..’ [চলবে]
[প্রিয় পাঠক, আমার বাসার গৃহপরিচারিকা মোবাইল কিনতে চাচ্ছে ফেইসবুক এ্যাকাউন্ট খুলবে বলে। আমার স্ত্রীকে একথা বলার পর বাসায় এখন উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করায় আজকের মতো গল্পলেখা এখানে বিরতি দিতে বাধ্য হলাম। আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আমি দুঃখিত।]