জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে শেষ হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম বছর।
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ভেবেছিলাম এটা। ডেঙ্গুর পর ডাক্তার বলেছে, শক্তি ফিরে পেতে প্রচুর খেতে হবে; বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট। তখনও জিমে যাওয়ার উপায় নেই। কাজেই ওজন বাড়ল। শরীর দুর্বল। সব মিলিয়ে আপনাদের বলেছিলামও যে হয়ত খেলব না। কিন্তু খেলা কাছে চলে আসলে মনকে বোঝানো কঠিন। সব সময়ই এটা হয়েছে আমার, ভেতরে কিছু একটা কাজ করে। দেশের হয়ে খেলার যে অনুভূতি, সেটার জন্য ঝুঁকিটা আমি সব সময়ই নেই; আগেও নিয়েছি।
এখনও আমার শরীর ভালো না। বিশ্রামের দরকার। কিন্তু বিপিএল শুরু হচ্ছে, বসে থাকার উপায় নেই।
কিন্তু জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলা কি সত্যি জরুরি ছিল?
মাশরাফি: দেশের হয়ে খেলা…আসলে জীবনে এত ম্যাচ মিস করেছি বাংলাদেশের, যে এখন আর একটি ম্যাচও মিস করতে ইচ্ছে করে না।
সিরিজের আগে ডাক্তারের কাছে একটা ব্যাপারই জানতে চেয়েছি যে আমি মারা যাব কিনা! সত্যি বলছি…বিসিবির ডাক্তার দেবাশিষ দা, আমিন ভাই, অ্যাপোলোর ডাক্তার রায়হান, সবার কাছে একটা কথাই জানতে চেয়েছি যে খেলতে নামলে মরে যাব কিনা। তারা বলেছিলেন, ‘মারা যাওয়ার প্রশ্ন নয়। তবে হয়ত মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারো; অথবা রক্তচাপ অনেক কমে যেতে পারে।’ আমি বলেছি, তাহলে সমস্যা নেই।
আমার পালস অনেক কম ছিল। স্পোর্টসপারসনদের অনেকের এমনিতেই পালস কম থাকে, ৬০-৭০ এর মধ্যে। আমার ৪৫-এ নেমে গিয়েছিল। এখানেই ডাক্তারদের ভয় ছিল, তারা বলেছিলেন একজন কার্ডিয়াক ডাক্তার দেখাতে। আমি সময় পাইনি। এজন্যই প্রশ্ন করেছিলাম যে ‘মারা যাব না তো? মারা না গেলে আমি খেলব।’খেলতে গিয়ে মারা গেলেও সমস্যা ছিল না কিন্তু আমার ছেলে-মেয়ে দুটি ছোট এখনও…(হাসি)।
এই শরীর নিয়ে পেস বোলিং করাটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল, কিভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন?
মাশরাফি: বোলিং করছিলাম, কিন্তু আমার মাথা ঘুরছিল। রান আপে ছুটছি, মন হচ্ছে পুরো দুনিয়া চক্কর খাচ্ছে। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। বল ডেলিভারির সময় কখনও কখনও মনে হয়েছে যে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। ফিল্ডিংয়ে হেঁটে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে উল্টো হাঁটছি। কিন্তু মাঠে নামার পর তো আসলে এ সবকে প্রশ্রয় দেওয়ার উপায় নেই।
সিরিজের আগে প্রথম যে দুই দিন অনুশীলনে বোলিং করেছি; অনেক ভয় ছিল আমার। ভাবছিলাম, পারব কিনা খেলতে। এজন্যই প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলতে চাইছিলাম। ওই ম্যাচের ৩ ওভারের পর আর পারছিলামই না। তবু নিজেকে চাপ দিয়েছি যে মূল ম্যাচ খেলতে হলে অন্তত ৪ ওভারের স্পেল আমাকে করতেই হবে। ওই ম্যাচে দুই স্পেলে ৭ ওভার করার পর আমি নিজেকে বোঝালাম যে এভাবেই মাথা ঘোরাবে, শরীর চলবে না। তবু নিজেকে পুশ করে খেলতে হবে।
চোট থেকে ফেরা আপনার জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ডেঙ্গুর ছোবলে এবার তো আরেক অভিজ্ঞতাও হলো তাহলে!
মাশরাফি: আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময়গুলোতে সব সময়ই ইনজুরিতে পড়ে গেছি। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ড এল; প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট পেলাম। পরের টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট, মাইকেল ভন, নাসের হুসেইন, গ্রাহাম থর্পদের আউট করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ ওভার বোলিং করেই ফলো থ্রুতে চোট পেলাম।আবার ২০০৮-০৯ সালে, ওই সময় জীবনের সবচেয়ে ভালো বোলিং করছিলাম। বল হাতে যা চেয়েছি, করতে পেরেছি। তখনও ইনজুরিতে পড়লাম। পরের বছর আমি অধিনায়ক, ইংল্যান্ডে জিতলাম আমরা। পরে নিউ জিল্যান্ড সিরিজে প্রথম ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়লাম। ভয়টা তাই সবসময় থাকে। গত কিছুদিন খুব ভালো যাচ্ছে। ভয়টা এজন্যই বেশি লাগে যে কখন না আবার ইনজুরিতে পড়ি!
এবারও দেখেন, বিশ্বকাপের পর খুব ভালো অবস্থায় ছিলাম। দারুণ ফিট ছিলাম। ভারত সিরিজের আগে হুট করেই সড়ক দুর্ঘটনা, দুই সপ্তাহ তখন কিছুই করতে পারিনি। একজন ক্রিকেটারের দুই সপ্তাহ কিছু না করা মানে আসলে তিন মাস পিছিয়ে যাওয়া। স্রেফ খেলার আগের দিন ফিট হয়ে মাঠে নামলাম। তারপর এবার ডেঙ্গু।
ডেঙ্গুর ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। এমন কিছুর সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। সাকিব-রিয়াদের ডেঙ্গু হয়েছিল। ওরা আমাকে বলেছিল যে দুই মাস পরও প্রভাব থাকে। আমি যেমন এখনও বুঝছি! তবে না খেললে আমার শরীর আরও খারাপ থাকত। এজন্যই খেলেছি।
একটা ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে বিশ্রাম নেওয়ার কথা মনে হয়নি?
মাশরাফি: ভেবেছিলাম, প্রথম দুই ওয়ানডে জিতে গেলে শেষটি বিশ্রাম নেব। পরে আবার টি-টোয়েন্টি খেলব। কিন্তু সহ-অধিনায়ক সাকিবকে চলে যেতে হলো। তবে আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলব না এটাকে। ওর মেয়ে হয়েছে, আমাদের সবার জন্যই এটা সৌভাগ্যের প্রতীক। সবার জন্য ভালো খবর। আমার একটা ম্যাচ বেশি পুশ করতে হয়েছে নিজেকে, এই তো!
এই বছর এত বড় বড় সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। তারপর আচমকাই সূচির বাইরে একটি সিরিজ, সেটাও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। দলকে অনুপ্রাণিত করা কঠিন ছিল নিশ্চয়ই?মাশরাফি: কিছুটা কঠিন ছিল। যদিও পেশাদার হিসেবে যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, তারপরও বাস্তবতা বলে কিছুও আছে। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে হয় না। স্রেফ সাহস জোগাতে হয়। জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে সবাই লাল বলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, হুট করেই সাদা বলে আসতে হলো। বড় তিনটি দলকে হারানোর পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলার অপেক্ষায় ছিল সবাই…সেখান থেকে হুট করেই জিম্বাবুয়ে। দলের অনেকের মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে ‘এমনিতেই জিতে যাব।’ এটাই চ্যালেঞ্জ ছিল, বড় সিরিজগুলোর মতো এই সিরিজেও দলকে একইভাবে তৈরি করা। জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে হারার অবকাশ নেই, সেটা মনে গেঁথে দেওয়া। সব মিলিয়ে কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত ভালোই হয়েছে। শেষ টি-টোয়েন্টি বাদ দিলে আমি বলব যে ‘ক্লিনিক্যাল পারফরম্যান্স’।
আগেও মাঝেমধ্যে ২-১ বছর বেশ ভালো কাটিয়েছে বাংলাদেশ। সেই তুলনায় এই বছরটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাশরাফি: ২০০৭ সালও খুব ভালো ছিল আমাদের। বছরের পর বছর অনেকে ব্যক্তিগত সাফল্য পেয়েছে অনেকবারই। আগে আমাদের ক্রিকেটে কিছু নাম ছিল বিভিন্ন সময়ে। হাবিবুল বাশার, আশরাফুল, সাকিব, তামিম, মুশফিক, রাজ্জাক…কিন্তু কখনই দল হিসেবে সেভাবে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারিনি আমরা। এবার দল হিসেবে বাংলাদেশ পেরেছে। আগে কখনই যেসব হয়নি, সেসব এই বছর হয়েছে।
এই সাফল্যের ‘রেসিপি’ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আপনার কাছেও প্রশ্ন হয়েছে। বছর শেষে ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এটা কি বলে দেওয়া যায়?
মাশরাফি: আমরা চেয়েছি, একটা দল গড়ে তুলতে। টিম স্পিরিট গড়ে তোলা। ব্যক্তিগত সাফল্যে হয়ত এক জনের প্রোফাইল ভালো হবে, কিন্তু দল না জিতলে দলের কাছে সেটার মূল্য কি? আমি মাশরাফি ৪-৫ উইকেট নিলাম, কিন্তু দল জিতল না, এটার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। আমি কিছুই না করি, দল জিতলে আমার সবই পাওয়া হয়ে গেল। দল হিসেবে উন্নতি করাই ছিল আসল। সিনিয়র ক্রিকেটাররাও সবাই একমত হয়েছে, জুনিয়রদের অনুপ্রাণিত করেছে।
মাঠের বাইরে সবাই পরস্পরের পাশে থাকতে চেয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় ৬৫ দিন এক সঙ্গে ছিলাম আমরা; কেউ হোম সিকনেস অনুভব করেনি। নিয়ম করে দিয়েছিলাম, খেতে গেলে এক সঙ্গে অন্তত ৫ জন যাবে। যেন একে অন্যের সঙ্গে থাকি। কারও খারাপ সময় যাচ্ছে, সবাই ওর পাশে থেকেছি। এই ব্যাপারগুলো আমরা করেছি। সংস্কৃতিটা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
ভাবনাটি আপনারই? নাকি কোচ-ম্যানেজারের ভূমিকা ছিল?মাশরাফি: আমার ধরনেই এটা ছিল যে সব সময় সবার সঙ্গে মিশে থাকতে চেষ্টা করি। তারপর এসব নিয়ে যখন আলোচনা হলো, কোচ-সিনিয়র ক্রিকেটার সবাই সমর্থন করেছে। আমাদের দেশে কেউ দুইটা ম্যাচ খারাপ খেললেই অনেক প্রশ্ন উঠে যায়, ‘ও আর চলে না।’ আমরা চেয়েছি, কেউ খারাপ করলে আরও বেশি করে পাশে দাঁড়াতে। বিশ্বকাপে সবাই ভালো করেনি! কিন্তু যারা খারাপ খেলেছে, তারা কিন্তু সেটা মনেও রাখেনি। এটা আমি মনে করি, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন, এই টিম স্পিরিট।
তবে সবকিছুর আগে আমি দলটাকে ডিসিপ্লিন্ড করতে চেয়েছি। ডিসিপ্লিন্ড মানে শেকল পড়ানো নয়; তবে একটা নিয়মে আনা। রাত ১২টায় আমাদের বাইরে যেতে ইচ্ছে করতেই পারে। খেলা নেই, একটু মজা করব। কোচ-ম্যানেজার আছেন, অনুমতি নিয়ে যাব এবং সবাই এক সঙ্গে যাব। ডিসিপ্লিনের ভেতর আমরা উপভোগ করতে চেয়েছি।
আমি সবসময়ই ভাবতাম এসব। এবার কোচের সঙ্গেও মিলে গেছে। তিনিও তো উপমহাদেশের, আবেগ তার মধ্যেও কাজ করে। সবাই সবারটা বুঝতে পেরেছে।
তো আপনার বা আপনাদের উদ্যোগুলো যখন ফলপ্রসু হলো, সেই সময় আপনি বা কোচ, নিশ্চয়ই আপনারা রোমিঞ্চত ছিলেন।
মাশরাফি: পরিকল্পনা কাজে লাগার পর কিন্তু রোমাঞ্চটা বেড়ে যায়। বিশ্বকাপে আমাদের ৬৫-৭০ ভাগ প্ল্যান কাজে লেগেছে। তারপর আমরা আর সেটা ছাড়তে চাইনি। বরং আরও কিভাবে ডিসিপ্লিন্ড হওয়া যায়, পরিকল্পনা আরও কাজে লাগানো যায়, সেসব ভেবেছি।
বছরটা দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। গত বছরের হারের মিছিলের পর এই বছরও যদি আমরা হারতাম, তাহলে খুব খারাপ হতো দেশের ক্রিকেটের জন্য। ভারত-পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে আমরা হারতে পারতাম। কিন্তু হারলে আর কেউ মনে রাখত না যে বড় দলের কাছে হেরেছি আমরা, তলানিতে চলে যেত আমাদের ক্রিকেট। আল্লাহর রহমতে, আমরা জিতেছি। জয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছি।
লোকে মাঠের ক্রিকেট দেখেছে। ক্রিকেট সাংবাদিকরা হয়ত অনুশীলন দেখেছেন। কিন্তু অনেক অনেক প্ল্যান সাজাতে হয়েছে আমাদের। কোচকে বড় কৃতিত্ব দিতে হবে আমাদের, সিনিয়র ক্রিকেটারদেরও। অনেক প্ল্যান করেছি আমরা। এসবের ফল মাঠে দেখা গেছে।
নির্বাচকদের কথা না বললেই নয়। তাদের কাজটা ‘থ্যাংকলেস’। সব সময়ই দল নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা হয় আমাদের এখানে। কিন্তু নির্বাচকরা বেশ কিছু ভালো ক্রিকেটার আমাদের উপহার দিয়েছেন, একটা থিতু দল গড়ার চেষ্টা করেছেন।
বোর্ডেরও অনেক সহায়তা ছিল। বিশ্বকাপের সময় অস্ট্রেলিয়ায় যা চেয়েছি, আমরা পেয়েছি। পরেও পেয়েছি। এ জন্যই বললাম, সবারই যৌথ প্রচেষ্টার ফসল এই সাফল্য।
Courtesy: আরিফুল ইসলাম রনি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম