এই দিনেই বহু বাধাবিপত্তির অতিক্রম করে পিতার মৃত্যুর পর ফারগানার শুন্য সিংহাসনে বসেন সুলতান বাবর। এসময় বাবরের বয়স মাত্র ১২! এতো অল্প বয়সে একটা রাজ্যের শাসনকার্য চালানো মোটেই সহজ ছিলো না। তার উপরে আবার এতো অল্পবয়ষ্ক শাসক দেখে আশেপাশের অন্য কোন রাজ্য থেকে আক্রমণের আশঙ্কা ছিলো প্রবল। যদিও পিতা ওমর শেখ মির্জা ছোটবেলা থেকেই বাবরকে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে তৈরি করেছিলেন। তারপরেও বাবরকে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে সহায়তা করেন বাবরের নানীজান আয়েশা দৌলত বেগমসহ অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত সভাসদবর্গ।কিশোর সুলতান বাবরের জন্য সবথেকে বেশি চিন্তার কারণ ছিলো ফারগানার প্রতিবেশি রাজ্যগুলোই। আয়তনে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে তুলনামূলক ছোট এবং সেই সাথে পিতা ওমর শেখ মির্জার সাথে পূর্বশত্রুতার জেড় ধরে এসব রাজ্যের শাসনকর্তারা প্রায়ই বাবরকে বিরক্ত করতেন। বাবরের প্রতিবেশি রাজ্যসহ মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ ভূ-খন্ডই তখন পর্যন্ত তৈমুর বংশীয় শাসকরা শাসন করতেন। তার মানে এসব শত্রুরাজ্যগুলোর শাসনকর্তারা আসলে সবাই বাবরের আত্মীয়ই ছিলো। কিন্তু তাদের নিজেদের ভেতরে ছিলো না কোন সদ্ভাব। সম্ভবত সুবুদ্ধিটুকুও। এসব শাসকদের ভেতরে আবার সবথেকে এগিয়ে ছিলেন সমরকন্দের শাসক। ফারগানার পশ্চিমে সমরকন্দের অবস্থান হওয়ায় সমরকন্দ সবসময়ই চাইতো ফারগানাকে নিজ পতাকাতলে নিয়ে আসতে। সিংহাসনে বসে বাবরকে প্রথমেই এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জনগনের আস্থা অর্জন করতে হয়। কারন চারপাশে শক্তিশালী শত্রু রেখে মাত্র ১২ বছরের কাউকে সিংহাসনে সমর্থন করাটা জনগনের জন্য আশঙ্কাজনকও বটে! তবে বাবর এসব বিপদ বেশ ভালো ভাবেই পাশ কাটান।
বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জার মনের একটি দুঃখ ছিলো তৈমুরের বিস্তীর্ন ভূখন্ড ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়াটা। তিনি চাইতেন ভূখন্ডগুলোকে এক করতে, কিন্তু সামর্থ্য ছিলো না। নিজে না পারলেও পুত্রের মনে এই স্বপ্নটি বেশ ভালো ভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ কিছুদিনের ভেতরেই বাবরের চিন্তাধারা বেশ উচ্চাকাক্ষী হয়ে যায়। তিনি তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দ দখল করতে চাইলেন!
এ সময় একটি সুযোগ তার হাতে ধরা দেয়। সমরকন্দে এসময় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছিলো। কিশোর বাবর এই সুযোগ হারাতে চাইলেন না। ১৪৯৬ সালে তিনি সমরকন্দ অবরোধ করেন। তবে শীঘ্রই তীব্র শীত চলে আসে, আর শীতের প্রস্তুতি না থাকায় বাবর অবরোধ তুলে ফারগানায় চলে আসেন। এর ঠিক পরের বছর, ১৪৯৭ সালে, ৭ মাস দীর্ঘ অবরোধের পর সমরকন্দ বাবরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। বাবর চান নি তার পূর্বপুরুষ তৈমুরের এই মহান রাজধানীর কোনো ক্ষতি হোক। তাই তিনি বিজয়ের পর শহর লুটপাটে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। বাবরের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বেশিরভাগ সৈন্যই তাঁকে পরিত্যাগ করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও তিনি সমরকন্দে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হন।
সমরকন্দ দখলের সময় বাবরের বয়স ছিলো মাত্র ১৫! আর এই শহরটি দখলের পরেই বাবর বুঝতে পারেন তাঁর উপর বিরাট বোঝা আর দায়িত্ব চেপে বসেছে। তারপরেও তৈমুরের রাজধানী নিজের নিয়ন্ত্রনে নিতে পেরে তিনি খুশি। নিজ পরিবারকে ফারগানা থেকে সমরকন্দে নিয়ে আসার পূর্বে অবরোধজনিত ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করার আগেই বাবরের কাছে দুঃসংবাদ চলে আসলো।
ফারগানার কতিপয় কুচক্রী সভাসদবর্গ বাবরের সৎভাই জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনে বসিয়েছে এবং তাঁর পরিবারকে বন্দী করেছে। এ খবর পেয়ে বাবর কোনোমতে সামান্য প্রস্তুতি নিয়েই ফারগানার অভিমুখে রওয়ানা দিয়ে দেন। এদিকে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন বাবরের চাচাতো ভাই বুখারার সুলতান আলী মির্জা। বাবর ফারগানায় বিদ্রোহের খবর পেয়ে ফারগানা অভিমুখে যাত্রা শুরুর পরেই তিনি সমরকন্দ নিজের দখলে নিয়ে নেন। মাত্র ১০০ দিন শাসন করার পর বাবর সমরকন্দের সিংহাসন হারান! এদিকে ফারগানাও বিদ্রোহীদের দখলে। বাবর এখন আর কোন রাজ্যের সুলতান নন! আসলে পুরো ব্যাপারটিই ছিলো একটি পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত। বাবর তাঁর শত্রুদের পাতা ফাঁদের সহজ শিকারে পরিণত হন মাত্র!
বাবর তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচরদের নিয়ে দুর্গম অঞ্চলে আত্মগোপন করেন। এসময় তিনি বিভিন্নভাবে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকেন। ১৫০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাবর সমরকন্দ দখল করতে সক্ষম হন। তবে বাবরের ভাগ্য এবারো খারাপ ছিলো। কারন এর কিছুদিন পরেই চেঙ্গিস খানের বংশধর উজবেক নেতা সায়বানী খানের কাছে সমরকন্দের সিংহাসন হারান, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো মধ্য এশিয়ার সবগুলো সিংহাসন থেকে তৈমুরের বংশধরদের বিতারিত করা। সায়বানী খান প্রায় সফল হয়ে যাচ্ছিলেনও। সায়বানী খানকে বাবর এরপরে আর বিরক্ত করবেন না, এর নিশ্চয়তা হিসেবে বাবরের বোন খানজাদাকে জোড় করে বিয়ে করে নিয়ে যায়। বাবরকে চুপ থেকে এসব সহ্য করতে হয়, কারন আসলে তখন বাবরের করার কিছুই ছিলো না। তবে শীঘ্রই সায়বানী খান তার কৃতকর্মের জবাব পেয়ে যাবে।
ফারগানার সিংহাসন তো আগেই গিয়েছে, দ্বিতীয়বারের মতো দখল করেও তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দ দখলে রাখতে পারেন নি বাবর। বাবর এবার সত্যিকার অর্থেই পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়েছেন। বাবরে সাথে শুধুমাত্র তাঁর বিশ্বস্ত কিছু অনুচর। বাবরের অবস্থা অনেকটা নদীতে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো হয়েছিলো। দুর্গম জঙ্গলে, অসভ্য বর্বরদের সাথে দিন কাটাতে হয়েছিলো বাবরকে। এ সময়েই বাবর নিজের জীবনের প্রকৃত শিক্ষাটা পেয়েছিলেন। সেই সাথে নিজের জীবনেও লক্ষ্যকেও চিনতে শিখেছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি হতাশ হয়ে যেতেন, এসময় তিনি সব ছেড়ে পালিয়ে চীনে চলে যাওয়ার চিন্তা করেছিলেন। আবার কিছুক্ষণ পরেই পূর্বপুরুষদের গৌরবের কথা ভেবে গর্বিত অনুভব করতেন, মনে সাহস সঞ্চয় করতেন।
বেশ কয়েক বছর ভবগুড়ের ন্যায় ঘোরার পর আল্লাহ বাবরের সহায় হন। কারন এসময় কাবুলের রাজদরবারের প্রতিনিধিরা বাবরের সাথে দেখা করেন। তারা বাবরকে এই সংবাদ জানান যে, বাবরের চাচা উলুঘ বেগ মির্জা নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কাবুলের সিংহাসন এখন শূন্য, এবং এই শূন্য সিংহাসনে তৈমুরের কোনো বংশধরকে উপবিষ্ট অবস্থায় পেলে তাঁরা খুশি হবেন। তাদের অনুরোধটা খুব সহজ ছিলো, বাবর যেনো সিংহাসন দখল করতে সসৈন্যে এগিয়ে আসেন।
বাবর যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! তিনি একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্য তো পেলেনই, সেই সাথে সেই রাজ্য দখলে যোগ্য সেনাবাহিনী গঠনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থসাহায্যও পেলেন। বাবর দ্রুত তাঁর সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে মনোযোগ দিলেন। ইতিমধ্যে অবশ্য কাবুলের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। স্থানীয় বিদ্রোহী একটি গোষ্ঠী কাবুলের সিংহাসন দখলে নিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এটা বাবরের জন্য কোনো ব্যাপার না। তাদের না আছে সিংহাসন দখলে রাখার নৈতিক কোনো অধিকার, না আছে সেই সিংহাসন অধিকারে রাখার পর্যাপ্ত শক্তি।
সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে বাবরের তিনটি বছর কেটে যায়। এরপর কাবুলের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করে ১৫০৪ সালে ফারগানা দখলের ১০ বছরের মাথায় তিনি কাবুল অধিকার করেন। এসময় বাবরের বয়স ২২ বছর।
কাবুলে তিনি মোটামিটি স্বস্তিতেই ছিলেন। কিছু ছোটখাট বিদ্রোহ অবশ্য হচ্ছিলো। তবে সেসব বিদ্রোহ নিয়ে বাবরকে না ভাবলেও চলতো। কাবুলে থিতু হয়ে বাবর “পাদশাহ” উপাধী গ্রহণ করেন। একই সাথে নিজের জীবনের উদ্দ্যেশ্য নিয়েও ভাবার কিছুটা অবসর পান। কিন্তু সেখানে ভারতের ভূ-খন্ড ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না! ভারত আর বাবর যেনো একই সূত্রে গাঁথা!
বাবর তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুরের ভারত বিজয়ের গল্প শুনে ভারত অধিকারের ব্যাপারে সংকল্প করেন। বাবর তৈমুরের ভারত জয়ের কথা শুনেন ১৫০৩ সালে ট্রান্সঅক্সিয়ানার (আরবীতে “মা’ওয়ারা আল-নহর”, বর্তমান মধ্য এশিয়া) দিখ-কাত এ। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ১৫০৪ সালে কাবুল বিজয়ের পর তিনি তিনি একসময়ের তুর্কী অধিকৃত হিন্দুস্থানের (সিন্ধু নদের তীরে যারা থাকতো তাদেরকে হিন্দু বলা হতো। “হিন্দু” থেকে হিন্দুস্থান শব্দের উৎপত্তি। “ইংরেজিতে ইন্ডিয়া (India) কথাটি সিন্ধু নদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে। প্রাচীন গ্রিকরা ভারতীয়দের বলত ইন্দোই (Ινδοί), বা ‘ইন্দাস’ (সিন্ধু) নদী অববাহিকার অধিবাসী। ‘ইন্দাস’ নাম থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটির উতপত্তি।- উইকিপিডিয়া) ভূখন্ডগুলোকে পুনরায় দখল করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তবে বাবর যে জোরজবরদস্তি করে ভারত দখল করেছেন ব্যাপারটা এমন না। তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতের উপর তাঁর নৈতিক একটা অধিকার পূর্ব থেকেই ছিলো। আর একারণেই বাবর নিজেকে লোদী রাজবংশের উত্তরাধিকারী ভাবতেন। তৈমুর ভারত জয়ের পর ভারতে এতো বেশি রক্তপাত করেন যে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন ভারত সরাসরি তিনি নিজে শাসন করতে পারবেন না। তাই তিনি খিজির খানের কাছে পাঞ্জাবের শাসনভার অর্পন করে ভারত ত্যাগ করে চলে যান। খিজির খান সৈয়দ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে দিল্লী সালতানাত শাসন করতে থাকেন। লোদী রাজবংশ আবার সৈয়দ বংশকে প্রতিস্থাপন করে দিল্লী সালতানাত দখল করে। বাবরের সময় লোদী সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন ইব্রাহীম লোদী। পাঞ্জাব ছিলো তাঁর অধীনস্ত। বাবর ইব্রাহীম লোদীর কাছে পত্র পাঠান পাঞ্জাবকে তৈমুরীয় শাসকের হাতে ফেরত দেয়ার জন্য। বাবর ভালো মতোই জানতেন ইব্রাহীম লোদী তা কখনোই করবেন না। আর তাই তিনিও লোদী সাম্রাজ্যকে আক্রমণের জন্য যথাযথ এবং নৈতিক একটি কারণ পেয়ে যাবেন! বাস্তবেও তাই ঘটেছিলো।
প্রস্তুতিমূলক আক্রমণ হিসেবে ১৫০৫ সালের জানুয়ারীতে বাবর ভারতে তাঁর প্রথম অভিযানটি পরিচালনা করেন। কোহাট আর বান্নুর মধ্য দিয়ে তিনি সরাসরি সিন্ধু নদের তীরে পৌছান। স্থানীয় আফগানরা তাঁকে বাধা দেয়। তিনি আফগানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এদিকে তাঁর নিজ সীমান্তে সায়বানী খান আবার গর্জন তুলে এগিয়ে আসে। সায়বানী খানকে পরাস্ত করতে তিনি কাবুলে ফিরে এসে হেরাতে তাঁর চাচা হোসেন মির্জার সাথে মৈত্রির সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৫০৬ সালে তিনি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে হেরাতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তবে পথিমধ্যেই জানতে পারেন তাঁর চাচা ইন্তিকাল করেছেন। চাচার সিংহাসনে হোসেন মির্জার দুইপুত্র যৌথভাবে আরোহণ করেন। হোসেন মির্জার এই দুই পুত্র প্রকৃতপক্ষে ছিলো অযোগ্য আর ভোগবিলাসী। বাবর যখন সায়বানী খানকে নিয়ে চিন্তিত তখন তারা আকন্ঠ মদ্যপান আর নাচ-গান নিয়ে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছিলো। বাবর তাদের সতর্ক করলেও কোন লাভ হয় নি। হেরাতে দুইমাস অবস্থান করে বাবর কাবুল ফিরে আসেন।
বাবর কাবুলে এসেই সায়বানী খানের কাছে হেরাতের পতন সংবাদ শুনতে পান। তৈমুর বংশের অবশিষ্ট মির্জারা পঙ্গপালের মতো কাবুলে এসে বাবরের আশ্রয়প্রার্থী হন। এদিকে হঠাৎ বাবর লক্ষ্য করেন, তিনি নিজে বাদে তৈমুর বংশের অন্য কোন শাসক কোনো সিংহাসন অধিকারে রাখতে পারেন নি। তিনিই শেষজন! সায়বানী খান তার কথা রাখতে বাবরের দিকে এগিয়ে আসছে!
বাবর আর পালিয়ে না থেকে সরাসরি সায়বানী খানকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কেবলমাত্র সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।
এদিকে উদ্ধত সায়বানী একটি বিরাট ভুল করে ফেলে। পারস্যের শিয়া সাফাভি শাহ ইসমাইলের সীমান্তে সায়বানী গোলযোগ তৈরি করে এবং শাহ ইসমাইলের জন্য আনা উপহারসামগ্রীবাহী বহরে আক্রমণ করে বসে। শাহ ইসমাইল ব্যাপারাটকে ভালো চোখে দেখলেন না। তিনি সায়বানী খানকে পরাজিত করার জন্য শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেন। বাবর যখন সায়বানী খানকে আক্রমণের ছক কষছিলেন তখন তাঁর কাছে পারস্যের দূত এসে জানায় সায়বানী খান মৃত। পারস্য দূত বাবরকে এটাও জানায় যে খানজাদাকে সায়বানী খানের হাত থেকে তারা উদ্ধার করে এনেছে। সেই সাথে এই সংবাদও দেয়, তিনি চাইলেই তাঁর পূর্বের হারানো ভূ-খন্ডগুলোকে পারস্যবাহিনীর সহায়তায় উদ্ধার করতে পারেন। বিনিময়ে পারস্যের শাহকে শুধুমাত্র বাবরের অধিরাজ হিসেবে স্বীকার করে নিলেই হবে। কোন কর দিতে হবে না বা ধর্মীয় ভাবেও বাবর কোনো বাধার সম্মুখীন হবেন না (পারস্য শিয়া মতালম্বী অন্যদিকে বাবর সুন্নী মতালম্বী, যেমনটা আমরা)। অনেক ভেবেচিন্তে বাবর শাহের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভূখন্ড উদ্ধারে সহায়তাই কারণ ছিলো না, পারস্যের শাহ বাবরকে উপকারের ফাঁদে ফেলে নিজের স্বার্থ আদায় করে নিয়েছিলো। আর বাবরও চক্ষুলজ্জার কারনে মানা করতে পারেন নি। বাবর বুঝতেও পারলেন না যে তিনি খুব শীঘ্রই শিয়াদের পাতা ফাঁদে পরতে যাচ্ছেন!
পারস্যবাহিনী সহায়তায় বাবর বুখারা নিজের দখলে নেন। এরপর তাঁর স্বপ্নের সমরকন্দ দখলে মনোযোগ দেন। দখল করেও নেন। কিন্তু এবার শিয়ারা তাদের আসল খেলা শুরু করে। তারা বাবরের অধিকৃত ভূখন্ডে শিয়া মত চাপিতে দেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগে। এমনিতেই এসব ভূখন্ডে বসবাসকারীরা বাবরের পারস্যের (বর্তমান ইরান) সহায়তা নেয়াটা পছন্দ করছিলো না। তার উপর এখন আবার তারা তাদের ধর্মের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাচ্ছে। সুন্নীরা বাবরের উপর চূড়ান্তরকমের বিরক্ত হন। বাবর খুব ভালো ভাবেই টের পান, তিনি আর কখনোই তাঁর স্বপ্নের সমরকন্দ শাসন করতে পারবেন না। যা ভুল করার তিনি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন!
ইতিমধ্যেই ১৫০৮ সালের ১৭ মার্চ বাবরে বড় পুত্র হুমায়ুন জন্ম গ্রহণ করেন। কামরান মীর্জা জন্মগ্রহণ করেন ১৫০৯ সালে, আসকারী মীর্জা ১৫১৬ সালে। ১৫১৯ সালের ৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন হিন্দাল। যার নামের অর্থ হচ্ছে হিন্দুস্থান বিজয়ী। হিন্দুস্থানের স্বপ্নে বিভোর বাবর অনেকটা উত্তেজনার বশেই তাঁর ছোট পুত্রে নাম হিন্দাল রাখেন, কারন এই এই সময়ে হিন্দুস্থানের উদ্দ্যেশ্যে তাঁর দ্বিতীয় যাত্রাটি শুরু করেন। এটি অবশ্য শুধুমাত্র সীমান্ত আক্রমণ ছিলো, মূল আক্রমণ না। এর পরের বছর তিনি সিন্ধু অতিক্রম করে ভারতের মূল ভূখন্ডে প্রবেশ করেন। এসময় তিনি অনুধাবন করেন ভারত দখল করতে হলে তার আগে তাঁকে অবশ্যই কান্দাহার দখলে নিতে হবে। তিনি কান্দাহার দখল করে ফেললেন। এখানে তিনি তাঁর শক্তি বাড়াতে লাগলেন। ১৫২৪ সালে ভারত সীমান্তে চতুর্থবারের মতো আক্রমণ করেন। কিন্তু অভ্যন্তরীন বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কাবুলে ফেরত যেতে বাধ্য হন। ১৫২৬ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে তিনি পঞ্চমবারের মতো ভারত ভূখন্ডে প্রবেশ করেন। এবার আর বাবরকে হতাশ হতে হয় নি, ভারত বাবরকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নি!
আগের তিনপর্বঃ https://goo.gl/MPZK6g