দ্য ফিয়ারনট সেভেনঃ একঃ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ


ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ

লেখক: মেজর ডি এইচ খান

মার্চ, ১৯৭১
কারাকোরাম, পশ্চিম পাকিস্তান

পাকিস্তান-চীন সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। ভারতের সাথে টেক্কা দিতে আপাতত চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ছাড়া পাকিস্তানের আর উপায় কই? কারাকোরাম আগাগোড়াই পার্বত্য এলাকা, ভয়াবহ রকমের দুর্গম। তাই যথারীতি পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন এই কাজের তদারকি করছে।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেই কারাকোরামে বসেই ২৫ শে মার্চের কথা জানলেন। বুকের ভেতরে ফুঁসে ওঠা ক্রোধ ধামাচাপা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছেড়ে দেবার, কিন্তু তার পদত্যাগ পত্র কতদিনে গৃহীত হবে অথবা আদৌ গৃহীত হবে কিনা, সে ব্যাপারে তিনি নিজেই যথেস্ট সন্দিহান।

অতএব ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রথম সুযোগেই ক্যাম্প ছেড়ে পালালেন (০৩ জুলাই ১৯৭১), সাথে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার আর ক্যাপ্টেন আনাম। শিয়ালকোটের কাছদিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারত। জেনারেল ওসমানী স্বয়ং এলেন দেখা করতে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে চার-চারজন সুপ্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেনের মর্ম তিনি বোঝেন।

নুতন গন্তব্য ৭ নং সেক্টরের মেহেদিপুর সাব-সেক্টর। সাকুল্যে একটা ইনফ্যান্ট্রি প্লাটুন, একটা মর্টার প্লাটুন, এক কোম্পানী ইপিআর আর চার কোম্পানী গনবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা; সাথে কিছু আর্টিলারী আর অন্যান্য সার্ভিস কোরের সদস্য নিয়ে তার বাহিনী। ইতোমধ্যে আরগাবাব হাট, শাহ পুর আর কানসাটে তার বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে কিছু সাফল্য পেয়েছে। ভারতের শিলিগুড়ি করিডর তার সেক্টরের আওতায়, এই এলাকাটা জিও স্ট্রাটিজিকালি সিগ্নিফিকেন্ট, তাই এখানে একটা মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার জন্য ফোর্সেস হেড কোয়ার্টার থেকেও চাপ বাড়ছিল।

অবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের আদেশ এল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে তখন ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী আর ইপিসিএএফ এর ৭ নং উইং এর হেডকোয়ার্টার অবস্থান করছিল। ১১ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কানসাট আর শিবগঞ্জ ত্যাগ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কনসেনট্রেট করছে। গোটা ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর ইপিসিএএফ মিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছে।

লেঃ কাইউম, লেঃ রফিকুল ইসলাম আর লেঃ বজলুর রশিদ কে নিয়ে ছোট সোনা মসজিদ প্রাঙ্গনে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনার জন্য জমায়েত হলেন । চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রমন করতে হলে মহানন্দা নদী পেরিয়ে যেতে হবে। তাই পরিকল্পনা হল লেঃ রফিক আর লেঃ বজলুর রশীদ আরো পূর্ব দিকে হেটে গিয়ে মহানন্দা ক্রস করে পুর্ব দিক থেকে শত্রুকে আক্রমন করে এনগেজ করবে যেন পশ্চিমের মেইন অব্জেক্টিভের ওপর যখন লেঃ কাইয়ুমকে নিয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নিজে হামলে পড়বেন, তখন যেন পাকিস্তনীরা পুর্ব দিকে থেকে সৈন্য এনে নিজেদের রিইনফোর্স করতে না পারে।

১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুত কাভারিং আর্টিলারী ফায়ার শুরু হল যথারীতি ধুঁকতে ধুঁকতে। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দমলেন না, দমল না তার বাঘা বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারাও। যথাসময়ে মহানন্দা পাড়ি দিয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাহিনী ঠিকই হামলে পড়ল চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপকন্ঠে। পাকিরা আক্রমনের তোড়ে দ্রুত পালিয়ে শহরের ভেতরে কংক্রীটের দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিল।

ট্রেঞ্চের পর ট্রেঞ্চ দখল করে এগুচ্ছিল ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মুক্তিসেনারা। যুদ্ধ চলল পরদিন সকাল অবধি। সমস্যা শুরু হল পাকা একটা বাড়ির দোতালায় বসানো পাকি মেশিনগান নিয়ে। একেতো কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে শত্রুকে ঘায়েল করা দুঃসাধ্য, তার ওপর দোতালায় থেকে উচ্চতা সুবিধার কারনে পাকি মেশিনগানাররা মুক্তিসেনাদের আগেই দূর থেকেই দেখে ফেলছিল, আর বৃস্টির মত গুলি ছুড়ে মারছিল।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ভাল করেই জানতেন কখনো কখনো এক মেশিনগানের কারনেই যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। ওদিকে এটাকের বাম ফ্ল্যানক দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর শাজাহান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত, গুলির তোড়ে তার প্লাটুনটাও আটকে আছে, এগুবার পথ নেই।

মহিউদ্দিনের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ল। এই মেশিনগানটার জন্য এটাক থেমে গেলে এটাক মোমেন্টাম হারাবে, আর একবার মোমেন্টামটা হারিয়ে বসলে পালিয়েও পথ পাওয়া যাবে না, পাকিরা পিছু ধাওয়া করে মহানন্দার পাড়ে নিয়ে গিয়ে কচুকাটা করে মারবে। তাই তিনি মরিয়া হয়ে সেই মেশিনগানটা ধ্বংসের পথ খুঁজলেন।

প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসেবে তিনি জানেন যে মাটিতে শুয়ে উচুতে গুলি লাগানো কঠিন, তাছাড়া স্মল আর্মসের গুলিতে এই মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করা যাবেনা। আর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জানেন যে আর্টিলারি গোলা মেরেও কংক্রিটের ঐ ছাদ গুড়ানো কঠিন। তাছাড়া শত্রুর এই ক্লোজ ডিস্ট্যান্সে এসে আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট কল করলে নিজেদের গোলায় শত্রুর সাথে সাথে নিজেদেরও হতাহতের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

একমাত্র উপায় মেশিনগান বাংকারের ভেতর গ্রেনেড চার্জ করা। কিন্তু গ্রেনেড চার্জের জন্য বাংকারের দশ গজের ভেতর পৌছানো জরুরী। চেস্টা করলে হয়ত বাংকারের কাছাকাছি পৌছানো সম্ভব। কিন্তু গ্রেনেড চার্জ করে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য। কারন সুত্র অনুযায়ী এই মেশিনগানটার কাছে যেন কেউ ঘেষতে না পারে সেজন্য আশেপাশেই আরেকটা মেশিনগান থাকার কথা। সমস্যা হল সেই মেশিনগানটা এখনও স্পট করা যায়নি।

এখন প্রশ্ন হল কে যাবে এই সুইসাইডাল মিশনে, কাকে পাঠাবে মহিউদ্দিন এই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে? তাছাড়া মৃত্যুর চে গুরুত্বপুর্ন হল মরার আগে ঠিকঠাক গ্রেনেডটা ছুড়ে আসা।

অবশেষে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে নিজেই সেই মেশিনগান ধ্বংসের সুইসাইডাল সিদ্ধান্তটা নিলেন। একজন কমান্ডারের জন্য এমন ঝুঁকি হয়ত অনাবশ্যক, হয়ত পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে এসে আবার যুদ্ধ করা যেত। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আসন্ন বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছিলেন পরিস্কারভাবে। জয়ের এতোটা কাছে এসে হেরে যাবার পাত্র তিনি নন। মেশিন গানের যন্ত্রনায় সবাই যার যার কাভারের পেছনে থেকে জবাব দেবার চেস্টা করছে। থেমে থেমে বুলেট ছুটছে এদিক ওদিক।

বাম হাতে এসএমজি আর ডান হাতে পিন খোলা গ্রেনেড নিয়ে মহিউদ্দিন এগুতে লাগলেন। সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে তিনি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ক্ষিপ্রতায় ক্রলিং করে রাস্তা পেড়িয়ে বাড়িটার গোড়ায় চলে এলেন। তারপর চোখের পলকে গ্রেনেডটা ছুড়ে দিলেন মেশিনগান বাংকারের ভেতরে। প্রচণ্ড শব্দে গ্রনেডটা বিস্ফরিত হল আর সাথে সাথেই পাকি মেশিনগানারদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ আছড়ে পড়ল মাটিতে।

কাভার নিতে পারার আগেই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর দিকে ছুটে এল এক পশলা বুলেট। পাশের মসজিদের আড়ালেই’ লুকিয়ে ছিল পাকিদের আরেকটা মেশিনগান পোস্ট। লুটিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর…

ঢাকায় তখন নিয়াজি আত্মসমর্পনের টার্মস এন্ড কন্ডিশন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

পুনশ্চঃ
যথারীতি সম্ভাব্য সকল উতস স্টাডি করেই লেখাটা আমি লিখেছিলাম, কিন্তু শুধু গ্রেনেড মেরে একটা এলএমজি বাংকার উড়িয়ে দিতে গিয়ে মারা গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ? এই প্রশ্নটা আমাকে খোঁচাচ্ছিল শুরু থেকেই।

যুদ্ধে গ্রেনেড মেরে ট্রেঞ্চ আর বাংকার ক্লিয়ারিং অনেকটা রুটিন ড্রিলের মত বিষয়, আর ট্রেঞ্চ ক্লিয়ারিং এর সময় সৈন্য মৃত্যুও যুদ্ধে স্বাভাবিক ব্যাপার। অবশ্য একটা অপারেশনের কমান্ডার স্বয়ং বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে মারা যাবার ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম আর বিরল।

একটা এনিমি মেশিনগানের ইফেক্টিভ ফায়ারের কারনে এসল্ট কলাম থমকে যেতেই পারে। এমন অবস্থায় এয়ার সাপোর্ট, আর্টিলারী সাপোর্ট এমনকি একটা রকেট লাঞ্চারও হাতে না থাকলে যে কোন ক্যাপ্টেনই লাস্ট রিজোর্ট হিসেবে গ্রেনেড চার্জের আইডিয়াটা তার একটিভ কন্সিডারেশনে আনবেন। তাহলে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ হবার মত অনন্য কোথায়?

এই ব্যাপারটা বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছেন কলিন পাওয়েল। তার বই ‘মাই আমেরিকান জার্নি’তে তিনি বলেছেন যুদ্ধে প্রাণহানি একটা সহজাত ব্যাপার। কিন্তু একজন কমান্ডারের দায় হল প্রত্যেকটা মৃত্যু যেন হয় একান্ত প্রয়োজনীয় আর সার্থক।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ মহিউদ্দিনকে একটা সিদ্ধান্তের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল। তিনি জানতেন মেশিনগান পোস্টটা ধ্বংস করা জরুরী, এবং তিনি জানতেন এ কাজটা যে করতে যাবে তার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই বাস্তবতা জানার পরেও ঐ মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড ছুড়ে মারার মুক্তিযোদ্ধার নিশ্চয় অভাব হত না, যুদ্ধে এই অভাবটা কখনই হয় না।

কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই কোন কমান্ডার কখনই তার সৈন্যদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেননি, অন্তত ৫০ঃ৫০ চান্স তিনি খুঁজবেনই। কিন্তু এখানে মৃত্যু সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। দশ জনের নয়জন কমান্ডারই হয়ত এক্ষেত্রে নিরাপদ দুরত্বে ফিরে এসে ফের আক্রমনে যেতেন। কামালপুর বিওপিতে মুক্তিসেনারা ১৩বার আক্রমন করে ফিরে এসেছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তা করেননি। তিনি মোস্ট আনএক্সপেক্টেড কোর্সটা এডপ্ট করেছেন এবং এর কন্সিকোয়েন্স যেন অন্য কাউকে পোহাতে না হয়, সে জন্য একজিকিউশনটাও নিজেই করে প্রান দিয়েছেন। এখানেই তিনি অন্য নয় জনের চে ব্যাতিক্রম, এ জন্যই তিনি অনন্য আর একারনেই তিনি বীরশ্রেষ্ঠ!

Youth Carnival: