দ্য_ফিয়ারনট_সেভেন_(৫) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ

লেখক: মেজর ডি এইচ খান

সকাল ১১টা বেজে ২৮ মিনিট
২০ আগস্ট, ১৯৭১
মাশরুর বিমানঘাঁটি, করাচি, পাকিস্তান।

এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডিওতে হঠাৎ ভেসে এল “ব্লুবার্ড ওয়ান সিক্স সিক্স ইজ হাইজ্যাকড…”
মুহুর্তের ভেতর মাশরুর বিমানঘাঁটি সচকিত হয়ে উঠল। কর্তব্যরত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ফ্লাইট লেঃ আসেম রশীদ মেসেজটা শুনে মুহুর্তের জন্য অসার বোধ করলেন যেন। সে ধাতস্ত হয়ে উঠবার আগেই টি-৩৩ বিমানটা রানওয়ে ধরে হুস করে উড়ে বেড়িয়ে গেল, তারপর নিয়ম মত ডানে টার্ন না নিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে দূর দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে গেল; বিমানের কলসাইন ‘ব্লুবার্ড-১৬৬।’

সামরিক বিমানঘাঁটি থেকে সামরিক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা হরদম ঘটেনা। তাই শুরুতে ধাক্কা খেলেও এক মুহুর্ত পরেই রশীদ সংবিত ফিরে পেলেন। অবশ্য মার্চ মাসে ঢাকায় ক্র্যাক ডাউনের পর থেকেই বাংগালী পাইলটরা বিমান ছিনতাইয়ের চেস্টা করতে পারে ভেবে তারা সতর্ক ছিল। সেকারনেই সব বাংগালী পাইলটদের ইতোমধ্যে গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়েছে, যেন বিমানের ককপিটের ধারে কাছে কেউ ঘেষতে না পারে। কিন্তু অঘটনটা যে শেষপর্যন্ত আর ঠেকানো গেলনা তা এখন নিশ্চিত।

রশীদ প্রথমেই ব্যাপারটা সেক্টর অপারেশন্স কমান্ডারকে জানাল, কিন্তু সংবাদটা তাকেও হতচকিত করে দিল, তাই সিদ্ধান্ত দেবার বদলে তিনি একগাদা প্রশ্ন করতে থাকলেন। ধুর্ত রশীদ তার ফোনটা শেষ করেই সময় নস্ট না করে সরাসরি এয়ার ডিফেন্স এলার্ট হাটে কল দিলেন। এয়ার ডিফেন্স এলার্ট হাটে সবসময় দুটো যুদ্ধবিমান উড়বার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় থাকে, ব্যাপারটাকে এয়ারফোর্সের ভাষায় বলে ‘স্ক্র্যাম্বলিং।’

“আ টি থার্টি থৃ ইজ বিইং হাইজ্যাকড, স্ক্র্যাম্বল…”, রশীদের আদেশ পাবার পরপরই দুটো এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান আকাশে পাখা মেলল। পাশের বাদীন বিমানঘাঁটি থেকে আরও দুটো এফ-৮৬ ব্লুবার্ডকে খুঁজতে বেরুল। কিন্তু ব্লুবার্ড-১৬৬ খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বলে কোন রাডারই এর অবস্থান সনাক্ত করতে পারছিল না। এফ-৮৬ যুদ্ধবিমানের পাইলটেরা তাই অন্ধের মত আকাশে এপাশ ওপাশ উড়তে লাগল, কিন্তু রেডিওতে ব্লুবার্ড-১৬৬ কে এমনসব হম্বিতম্বি করতে লাগল যেন তারা সামনেই ব্লুবার্ডকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে আর যেকোন মুহুর্তে গুলি করে একে ভূপাতিত করতে যাচ্ছে। কিন্তু ব্লুবার্ড-১৬৬ এর রেডিও তখন সম্পুর্ন নিরব। সময়ের হিসেব বলছে এতক্ষনে ব্লুবার্ড-১৬৬ পাকিস্তানের আকশ সীমা পেরিয়ে ভারতের আকাশে পৌছে গেছে। তাই হালছেড়ে দিয়ে সবাই ব্লুবার্ডের পাকিস্তানী পাইলট মিনহাজকে ইজেক্ট করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিতে লাগল; ব্লুবার্ড-১৬৬ এর রেডিও তখনও সম্পুর্ন নিরুত্তর।

আজ সকালেই ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান দিনের ফ্লাইং শিডিউল দেখে পাইলট অফিসার মিনহাজকে টার্গেট করে রেখেছিল। কী করতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে মতিউর নিশ্চিত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আগের রাতেই তার পরিবারকে ভারতীয় দূতাবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সকালের দিকে আবহাওয়া কিছুটা খারাপ থাকায় তার পরিকল্পনাটা ভেস্তে যেতে বসেছিল প্রায়। কারন নবীন পাইলটদের সোলো ফ্লাইঙের জন্য আবহাওয়াটা বেশ খারাপই ছিল বলা চলে। কিন্তু ১১টার দিকে হঠাত আকাশটা পরিস্কার হয়ে গেল আর মতিউরের মুখেও হাসি ফুটল।

২৫শে মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের রাতে মতিউর ছুটিতে নিজ গ্রামের বাড়ি রামনগরেই ছিলেন। দেখা করলেন ২ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন নাসিম আর লেঃ হেলালের সাথে। কিন্তু একজন পাইলট হয়ে স্থলযুদ্ধে তিনি কতটা অবদান রাখতে পারবেন তা নিয়ে সবাই সন্দিহান ছিলেন। তাই আরও বড় একটা পরিকল্পনা নিয়ে তিনি পাকিস্তান ফিরলেন।

একটা যুদ্ধের অনেক আঙ্গিক থাকে, রাইফেল হাতে ছাড়াও যোদ্ধা হওয়া যায়। পাকিস্তানীরা তখন আপ্রান চেস্টা করছে মুক্তিযুদ্ধটাকে পাকিস্তানের সাময়িক আভ্যন্তরীন সংকট বলে চালিয়ে দিতে। কিন্তু বিশ্বজনমতের দৃস্টি আকর্ষন করাটা তখন ভীষন জরুরী। এমন অবস্থায় সামরিক বিমানঘাঁটি থেকে একটা সামরিক বিমান ছিনতাই এর ঘটনা সারা বিশ্বের দৃস্টি আকর্ষন করাতে বাধ্য। অগত্যা মতিউর পণ করলেন বিমান ছিনতাইয়ের।

কিন্তু ততদিনে পাকিস্তানীরা সব বাঙ্গালী পাইলটদের গ্রাউন্ডেড করে ফেলেছে। একসাথে বসে শলাপরামর্শ করাটাও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মতিউর আর তার পরিবার নিজেদেরকে পাকিস্তানীদের সন্দেহের উর্ধ্বে রাখলেন, আর মনে মনে মোক্ষম একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। ফাইটার বিমান ছিনতাই করাটা প্রায় অসম্ভব। নিরাপত্তা বেস্টনির ব্যাপারটা তো আছেই, তাছাড়া অন্যান্য গ্রাউন্ড ক্রুদের সহায়তা ছাড়া ফাইটার বিমান নিয়ে একাই আকাশে ওড়ার চেস্টা করাটা বোকামীরই নামান্তর। তাই নবীন পাইলট অফিসারদের চালানো টি-৩৩ বিমানই আদর্শ টার্গেট।

মতিউর ছিলেন পাকিস্তানি পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজের প্রশিক্ষক আর সেফটি অফিসার। তাই তার বিমান নিয়ে টেক অফ করার ঠিক আগমুহুর্তে মতিউরের ইশারা পেয়ে ইচ্ছে না থাকলেও বিমান থামালেন মিনহাজ। ট্যাক্সিংরত ক্যানোপিখোলা বিমানটা থামতেই মতিউর বিমানের পাখায় লাফিয়ে উঠে সোজা পাইলটের পেছনের দ্বিতীয় আসনটায় বসে গেলেন। তারপর মিনহাজের মুখের মাস্ক সরিয়ে ক্লোরফর্ম ভেজা রুমালটা মিনহাজের নাকে চেপে ধরলেন। ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে জ্ঞান হারাল মিনহাজ। কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে বিমান ছিনতাইয়ের মেসেজটা ঠিকই দিয়ে গেলেন কন্ট্রোলে।

সোলো ফ্লাইং এর সময় টি-৩৩ বিমানের পেছনের সিটে প্যারাসুট থাকেনা, তাই সিটটা অনেক বেশি নিচু হয়ে থাকে। এতে সুবিধা হল দূর থেকে মনে হবে পাইলট একাই আছে বিমানে, কিন্তু অসুবিধা হল ককপিটে বসা একজন পাইলটের জন্য ঠিক যতটা দৃস্টিসীমা আবশ্যক, ততটা পাওয়া যাবে না। অগত্যা প্রায় অন্ধের মতই বিপদজনকভাবে টেক অফ করলেন মতিউর, তারপর ডানে টার্ন না নিয়ে বায়ে টার্ন নিয়ে যতটা সম্ভব নিচু দিয়ে উরে চললেন যেন রাডারে তার বিমানটার অবস্থান ধরা না পড়ে। পেছনে স্ক্র্যাম্বল করে ছুটে আসা ফাইটার বিমানের হাত থেকে বাঁচতে হলে এর বিকল্প নেই।

ক্লোরফর্মের ঘোর কাটিয়ে মিনহাজের জ্ঞান ফিরতে শুরু করেছে, ওদিকে ককপিটের রেডিওতে মিনহাজকে বারবার ইজেক্ট করার নির্দেশ ভেসে আসছে। তরুন মিনহাজের জায়গায় অভিজ্ঞ মতিউর হলেও তাই করত। কারন সোলো ফ্লাইং এর সময় পেছনের সিটের বেল্ট স্ট্র‍্যাপ সব সিটের সাথে শক্ত করে বাধা থাকে যেন বিমান মেনুভারের সময় বেল্টের আঘাতে ককপিটের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয়। তার ওপর পেছনের সিটে কোন প্যারাসুটও নেই। তাই এইমুহুর্তে ইজেকশন সুইচ চাপা মানেই টি-৩৩ এর মেকানিজম অনুযায়ী প্রথমেই পেছনের সিট ইজেক্ট করবে। আর বেল্ট প্যারাসুট ছাড়া ইজেক্ট মানেই পেছনে যেই থাক তার অবধারিত মৃত্যু।

তাছাড়া মিনহাজ যদি হঠাত নিরুপায় হয়ে বিমানের ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়, তাহলেও বাচার সব আশা শেষ। অগত্যা প্রান বাঁচানোর সহজাত তাগিদেই মতিউর যে কোন উপায়ে মিনহাজকে আটকে রাখতে চেস্টা করলেন। টি-৩৩ এর অপরিসর ককপিট জুড়ে শুরু হল অপার্থিব এক দ্বৈরথ।

এরিমধ্যে আচমকা বিমানের ককপিটের ক্যানোপিটা হা করে খুলে গেল। মুহুর্তের মধ্যে খুব দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। মতিউর বা মিনহাজ কেউই টেক অফের আগে ক্যানোপি ঠিকমত লক হয়েছিল কিনা তা পরীক্ষা করার সুযোগ পাননি। তাই আকাশে এসে ক্যানোপিটা খোলা মাত্র উড়ে গিয়ে বিমানের টেইলে আঘাত করল।

মতিউর বিমানে ওঠার পর নিজের বেল্ট স্ট্রাপ কিছুই লাগানোর সুযোগ পাননি। তাই ক্যানপি উড়ে যাবার সাথে সাথে প্রচন্ড বাতাসের হ্যাচকা টানে মুহুর্তেই ককপিটের বাইরে ছিটকে গিয়ে সোজা মাটিতে আছড়ে পরলেন।

ক্যানোপির আঘাতে টেইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ায় আর মতিউর বেরিয়ে যাবার পর ওজনের তারতম্য মিলে বিমানটা যেন এক মুহুর্তের জন্য আকাশেই কড়া ব্রেক কষল, তারপর মতিউরের প্রানহীন দেহের কাছেই মাটিতে গোত্তা খেল।

পুনশ্চঃ
মতিউর রহমান তার অভীষ্ট লক্ষ্য পুরন করে গিয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রমান করে গিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য বাংগালীরা কতটা ব্যাকুল আর উদগ্রীব ছিলেন।

ট্রিভিয়াঃ
১। মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি “মোবারক লজ”-এ জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে মতিউর ৬ষ্ঠ। তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করেন এবং জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্ত করে পেশোয়ারে গিয়ে জেটপাইলট হন। ১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু’বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।

২। মাশরুর বিমানঘাঁটির ৬৪ নটিক্যাল মাইল দূরে যেখানে মতিউরের বিমানটা বিধ্বস্ত হয়, সেখান থেকে আর মাত্র তিন মিনিটের পথ দুরেই ছিল ভারত সীমান্ত। ভারতীয়রা পাকিদের কথোপকথন ইন্টারসেপ্ট করে ততক্ষনে মতিউরের কথা জেনে গিয়েছিল এবং কিছু ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ভারতের আকাশে ঢোকার পর মতিউরের বিমানকে পাকি যুদ্ধবিমান থেকে বাঁচাতে আকাশে টহলও দিচ্ছিল।

৩। পাইলট হিসেবে বাংগালীরা বরাবরই সেরা ছিল। বিশ্বের হাতে গোনা ২২ জন ‘লিভিং ঈগলস’দের একজন কিন্তু বাংগালী।
http://www.goefoundation.org/index.php/eagles/biographies/a/azam-saiful/

কন্ট্রোভার্সিঃ
অনেকের মতে মতিউর সুযোগ থাকা সত্বেও মিনহাজকে প্রানে মারতে চাননি। কারন পেছনের নিচু সিটে বসে সীমাবদ্ধ দৃস্টিসীমা নিয়ে বিমানটাকে নিরাপদে নিকটস্থ ভারতীয় বিমানঘাঁটি পর্যন্ত নিয়ে যেতে মিনহাজের সহায়তা তার দরকার ছিল। আর একারনে জ্ঞান ফেরার পর তিনি পেছন থেকে একটা পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি মিনহাজকে বাধ্য করতে চেস্টা করেছিলেন।

পুনঃপুনশ্চঃ
এই একই ঘটনায় বাংলাদেশ মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে আর পাকিস্তান মিনহাজকে নিশান-ই-হায়দার উপাধিতে ভুষিত করে। একই ঘটনায় উভয় দেশের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক প্রাপ্তির দৃস্টান্ত সত্যি বিরল

Youth Carnival: