ফুটবল বিশ্বকাপ বলতে লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের ফুটবল পরাশক্তিগুলোর মধ্যে লড়াই। সেই লড়াইয়ে লাতিন আমেরিকা থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত ইউরোপের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য টিকে ছিলো শুধুমাত্র উরুগুয়ে এবং ব্রাজিল। কিন্তু গতকাল রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ দুই প্রতিনিধিকে। এর ফলে নিশ্চিত হয়ে গেছে আরও একবার বিশ্বকাপ জিততে চলেছে ইউরোপ।
কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইয়ে প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় শক্তিশালী ফ্রান্স এবং উরুগুয়ে। একদিকে ফ্রান্সের তারুণ্য নির্ভর শক্তিশালী আক্রমণভাগ, অন্যদিকে পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে দারুণ খেলা উরুগুয়ের রক্ষণভাগ। ফলে পুরো বিশ্বের ফুটবল ভক্তরা ভেবেছিলেন দারুণ একটি ম্যাচ হবে। কিন্তু দিদিয়ের দেশমের শিষ্যদের কাছে পাত্তাই পায়নি অস্কার তাবারেজের শিষ্যরা। এডিনসন কাভানির অনুপস্থিতি ভুগিয়েছে উরুগুয়েকে।
বাংলাদেশ সময় রাত ৮ টায় নিঝনি নভরোগাদ স্টেডিয়ামে শুরু হয় উরুগুয়ে বনাম ফ্রান্সের ম্যাচটি। ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এডিনসন কাভানির অনুপস্থিতি শুরুতেই পিছিয়ে দেয় উরুগুয়েকে। শুরু থেকেই উরুগুয়েকে চেপে ধরে ফ্রান্স। একের পর এক আক্রমণ চালায় ফ্রান্স। দিয়েগো গডিন- লাক্সাতদের গড়া শক্তিশালী রক্ষণ সেটি কিছুটা সামাল দিলেও প্রতিপক্ষের রক্ষণে ভয় ধরাতে পারেনি উরুগুয়ে।
কাভানির অনুপস্থিতিতে আক্রমণভাগে দায়িত্বের বোঝা চাপে লুইস সুয়ারেজের উপর। কিন্তু সেই বোঝা ঠিক মতো সামাল দিতে পারেননি সুয়ারেজ। উল্টো তাকে মাঠে খুজে পাওয়া যায়নি। অস্কার তাবারেজের বদলে যাওয়া উরুগুয়েকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিলো অনেক। তবে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্সের সোনালি প্রজন্মের সাথে লড়াইটা কতটা কঠিন হতে পারে সেটা গতকাল ভালোভাবে টের পেয়েছে উরুগুয়ে।
ফ্রান্সের একঝাঁক প্রতিভাবান ফরোয়ার্ডকে আটকানো কতটা কঠিন সেটা সেটা দিয়েগো গডিনরা বুঝেছেন। কিলিয়ান এমবাপ্পেকে আটকাতে পারলেও আটকে রাখতে পারেননি আতোয়ান গ্রিজমান-রাফায়েল ভারানকে। ফলে শেষ পর্যন্ত উরুগুয়েকে ২-০ গোলে হারতে হয়েছে। প্রথমার্ধে ৪০ মিনিটের সময় আতোয়ান গ্রিজমানের হাওয়ায় ভাসানো দূর্দান্ত হাওয়ায় ভাসানো বল হেড করে জালে জড়ান রাফায়েল ভারান।
তবে গোল শোধ করার সুযোগ এসেছিলো উরুগুয়ের কাছে। মার্টিন কাসেরেসের হেড প্রায় পোস্টে ঢুকে গিয়েছিলো। কিন্তু সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়ে দেন ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস। পুরো ম্যাচে উরুগুয়ে একমাত্র গোলের সুযোগ পেয়েছিলো ঐ একটাই। হুগো লরিসের দূর্দান্ত আক্রমণের পর ফ্রান্স আরো আক্রমণাত্মক খেলতে শুরু করে। অন্যদিকে ভেঙে পড়ে উরুগুয়ে। সেই সুযোগে আরো চেপে ধরে ফ্রান্স। ৬১ মিনিটে উরুগুয়ের গোলরক্ষক মুসলেরা শিশুসুলভ ভুল করে বসলেন। বক্সের প্রান্ত থেকে গ্রিজমানের নেওয়া জোরালো শটটি ঠেকাতে গিয়ে উল্টো নিজেদের জালে পাঠান।
উরুগুয়ে পিছিয়ে পড়ে ২-০ গোলে। দূর্দান্ত এক গোলের পরও গ্রিজমান উদযাপন করলেন না, যেন এটা এক স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তার উদযাপন না করার পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে দীর্ঘদিন একসাথে খেলা দিয়েগো গডিন-হিমিনেজদের বিপক্ষে গোল উদযাপন করে কষ্টটা বাড়াতে চাননি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দারুণ খেলা কিলিয়ান এমবাপ্পের উপর নজর ছিলো, কিন্তু সেই এমবাপ্পেকে একেবারে বোতলবন্ধী করে রাখে উরুগুয়ে। তার মধ্যেও তিনি তার প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন কিছুটা।
ম্যাচের ১৫ মিনিটের সময় সুযোগ পান কিন্তু সেই সুযোগকে তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি শেষ হয়েছে ২-০ ব্যবধানে। ১৯৯৮ সালের পর বিশ্বকাপের নিকট থেকে মাত্র দুই ধাপ দূরে রয়েছে ফরাসিরা। এবারের বিশ্বকাপে শুরু থেকেই ফ্রান্সের উপর বাড়তি নজর ছিলো ফুটবল ভক্তদের। সেই প্রত্যাশা খুব ভালোভাবেই পূরণ করছেন এমবাপ্পে-পগবারা। বর্তমান ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান একাদশ ফ্রান্সের যারা যেকোনো দলকে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সে কারণে সেমি-ফাইনালে বেলজিয়ামকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। বেলজিয়াম বাঁধা পার হতে পারলে বিশ্বকাপটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাবে ফ্রান্সের।
অন্য দিকে গতকালের ম্যাচে উরুগুয়ের কাছেও প্রত্যাশা ছিলো অনেক বেশি। কিন্তু কাভানিবিহীন উরুগুয়ে প্রত্যাশার ছিটেফোটাও পূরণ করতে পারেনি। বরং অতিরিক্ত কাভানি নির্ভরতার মূল্য দিতে হয়েছে উরুগুয়েকে। পর্তুগালের বিপক্ষে এডিনসন কাভানি একাই দুই গোল করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেন। কিন্তু সেই ম্যাচে পায়ের গোঁড়ালিতে পাওয়া চোট থেকে সেরে উঠতে পারেননি কাভাননি। ফলে তাকে স্কোয়াডে রাখেননি কোচ অস্কার তাবারেজ।
তার বদলে খেলা ক্রিস্টিয়ান স্টুয়ানিকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। উরুগুয়ের হারের পেছনে গতকাল ডিফেন্সের বেশ কিছু ভুলও ছিলো। রাফায়েল ভারান যখন হেড করে দলকে এগিয়ে দেন তখন উরুগুয়ের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা তাকে ভালোভাবে আটকাতে পারেননি। আতোয়ান গ্রিজমান যখন বাম পায়ে ফ্রি কিক নিতে গিয়ে ডামি করেন তখন ফ্রান্সের বেশ কয়েক জন খেলোয়াড় বক্সের ভিতর দিকে ঢুকে যান কিন্তু ভারান তার জায়গায় থেকে গ্রিজমানের পরিকল্পনা মাফিক হাওয়ায় ভাসানো বলটিতে মাথা ছুঁইয়ে জালে জড়ান।
এখানে উরুগুয়ের গোলরক্ষক মুসলেরা যদি গোললাইন ছেড়ে এগিয়ে আসতেন সেক্ষেত্রে গোল নাও হতে পারতো। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের গতকাল পাসিং ছিলো খুব বাজে। বার বার ভুল পাস করে বল হারিয়েছেন। উরুগুয়ের ফরোয়ার্ডরা ডান কিংবা বাম কোনো প্রান্ত থেকেই ঠিকঠাক মতো ক্রস তুলতে পারেননি। তারা মোট ২৫ বার ক্রস তোলার চেষ্টা করে মাত্র দুইবার সফল হয়েছেন।
এর থেকেই বোঝা যায় কতটা খারাপ করেছেন তারা। ফ্রান্সের মতো দলের বিপক্ষে জিততে হলে ফ্রান্সের চেয়ে এককাঠি এগিয়ে থাকতে হবে। সেটা পুরো ম্যাচ জুড়ে কখনোই ছিলো না উরুগুয়ে। রক্ষণ এবং ফরোয়ার্ড সবখানেই ব্যর্থ হয়েছে তাবারেজের শিষ্যরা। ফলাফলা বিশ্বকাপ থেকে বিদায়। তবে উরুগুয়ের সমর্থকরা সাত্ত্বনা খুঁজে নিতে পারেন এডিনসন কাভানির অনুপস্থিতি থেকে। তাতেও যদি হারের জ্বালা কিছুটা কমে!
Featured Image: independent.co.uk
http://khela.co/