বাংলাদেশ ক্রিকেটের সালতামামি ২০১৭
বছরের পর বছর ধরেই টাইগাররা ক্রিকেটে তাদের অবদানকে এগিয়ে নিচ্ছে। ২০১৭ সাল ছিলো অনেক মাইলফলকের বছর, অনেক রেকর্ড গড়ার বছর, অনেক বেদনাদায়ক স্মৃতি আর অনেক সুন্দর মুহূর্তের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ, দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশ ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলো : দেশের বাইরে রূঢ় বাস্তবতা : নিউজিল্যান্ড সফর দিয়ে বছর টা শুরু হয়েছিলো টাইগার দের। কিন্তু সেখানেও সব কয়টা টেস্ট আর ওয়ানডে হারার পর, টি টোয়েন্টিতেও ছিলো বেশ বড় ব্যবধানের হার। বেশ ভালো সুযোগ পেয়েও টেস্টে হারানো যায়নি নিউজিল্যান্ডকে। সহজ ম্যাচ ফসকে গেছে বারবার হাত থেকে। এত কিছুর পরেও সফরে সবচেয়ে অর্জন ছিলো সাকিব আল হাসানের ” ২১৭” রানের ব্যক্তিগত ইনিংস, মুশফিককে সাথে নিয়ে গড়েছেন সাড়ে তিন শো রানের ও বড় পার্টনারশিপ। সবগুলো ফরম্যাটে ব্যর্থতার ভেতর ও ঝলমল করছিলো সাকিবের এই পারফরমেন্স। দক্ষিণ আফ্রিকা তে গিয়েও সেই এওয়ে ম্যাচের রূঢ় বাস্তবতার শিকার বাংলাদেশের টাইগার রা। প্রোটিয়ার গতি, বাউন্সে দিশেহারা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান রা। একের পর এক ম্যাচ বিশাল ব্যবধানে হেরে বসতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এমনিই সাকিব আল হাসানের টেস্টে বিশ্রাম, অন্যদিকে দলের এমন পারফরমেন্স, চন্ডিকা হাতুরুসিংহে যেন উপসংহারেই চলে আসলেন সিরিজের পর। টেস্টের পর ওয়ানডে টি টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশের বোলার ব্যাটম্যানরা সবাই হতাশাই উপহার দিয়ে গেছেন।
অবশেষে সেমিফাইনাল! : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে এবার বেশ আশা ছিলো বাংলাদেশের। কিন্তু প্রচণ্ড কঠিন গ্রুপে এবার পড়তে হয়েছিলো টাইগারদের। প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সাথে স্ট্রোক ঝলমলে চমৎকার এক ইনিংস খেলেন তামিম ইকবাল, যেখানে ধৈর্য আর ব্যাটিং দক্ষতার অসাধারণ জানান দিয়েছেন দেশসেরা ওপেনার। বেশ ভালো ব্যাট করে বাংলাদেশ তিন শো এর উপরে ইংল্যান্ডকে লক্ষ্য দিলেও বোলারদের ব্যর্থতা আর ফ্ল্যাট পিচে বড় ব্যবধানেই হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা আর হতাশার মাঝেও অসাধারণ এক ইনিংস খেলে গেছেন তামিম ইকবাল, ৯৫ রানের ইনিংস এ যেমন কিছু দৃষ্টিনন্দন শট খেলেছেন, তেমনি রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস ও ছিলো অসাধারণ । এর পরেও বাংলাদেশ সক্ষম হয় দুইশো রানের নিচে টার্গেট দিতে, অস্ট্রেলিয়া ভালোই খেলছিলো, কিন্তু বৃষ্টিভাগ্য মন্দ থাকলে যা হয়, বাংলাদেশ পেয়ে গেল ১ পয়েন্টের উপহার! পরের ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল হাতছানি, জিতলেই সেমিফাইনাল খেলার বড় সম্ভাবনা। নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং এ নেমেই বড় স্কোর গড়ার সম্ভাবনা দিচ্ছিলো, কিন্তু শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের বোলাররা যেভাবে ম্যাচের লাগাম ধরে রাখলো, তাতে ২৮০ পার হলো না কিউই দের। ব্যাটিং এ নামতে না নামতে বাংলাদেশ ৩৩ রানে ৪ উইকেট হয়ে গেলো চোখের পলকে। ম্যাচে যে তখন শুধুই বাকি আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু বাংলাদেশের সুপারম্যান সাকিব আল হাসান আছেন না? অসীম বীরত্ব নিয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সাথে ২২৪ রানের পার্টনারশিপ এ এক অসম্ভব ম্যাচকেই জিতিয়ে দিলো বাংলাদেশ, তর্কসাপেক্ষে এটি বাংলাদেশের সেরা ম্যাচ হলেও হতে পারে। কার্ডিফ এর সোফিয়া গার্ডেন যেন সাক্ষী এই অসাধারণ যেমন টি অস্ট্রেলিয়াকে ২০০৫ সালে হারানোর পরে হয়েছিলো বাংলাদেশের।
পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়াতে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে! কিন্তু সেমিফাইনালে তামিম মুশফিকের অসাধারণ ব্যাটিং এর পরেও মিডল অর্ডার এর ওরকম ভেঙে পড়ায় ফাইনাল খেলার স্বপ্ন ভেঙে যায় টাইগারদের। কিন্তু গৌরবের সাথে টুর্নামেন্ট এর সেরা ৪ দলের একটি দল হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বড় মাইলফলক। দেশের ষোল কোটি মানুষ এর মন জয় করে নেওয়া ক্রিকেট উপহার দিয়েছে টাইগাররা। মাশরাফির অসাধারণ ক্যাপ্টেইনসি আর বাংলাদেশ দলের নির্ভীক ক্ষিপ্রতা মাঠে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলো। শততম টেস্ট জয় : প্রথম টেস্টে শ্রীলংকার মাটিতে ধরাশায়ী হলেও কলম্বোর পি সারা ওভালে বাংলাদেশ নিজেদের শততম টেস্ট জিতে নেয়। প্রথম ইনিংসে সাকিব মোসাদ্দেকের অসাধারণ ব্যাটিং এ লিড নেয় বাংলাদেশ। পরের ইনিংসেই মোস্তাফিজের এক ক্ষুরধার স্পেল ফিরিয়ে আনে বাংলাদেশকে। আর শেষ ইনিংসে তামিম ইকবালের বীরবিক্রমে খেলা ইনিংসই বাংলাদেশের জয়ের সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। প্রথম ইনিংসে সাকিব আল হাসান সেঞ্চুরি করেছেন, আর দ্বিতীয় ইনিংসে অল্পের জন্য সেঞ্চুরি মিস করে আউট হয়ে গিয়েছেন তামিম ইকবাল। শততম টেস্টে সবাই নিজেদের সেরা টা দিয়েছিলো। কারো ব্যক্তিগত অবদান নয়, নিজেদের ঐক্য আর সম্মিলিত ভালো খেলার ফলাফলই ছিলো শততম টেস্ট জয়। ইতিহাসের চতুর্থ দল হিসেবে নিজেদের শততম টেস্ট জেতার রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশ।
মাশরাফির অবসর : মাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলাদেশের দেড় যুগের বেশি সময় ধরে দলের আস্থার প্রতীক। ষোল কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত এই ক্রিকেটার দেশের তরুণদের জন্য এক অণুপ্রেরণা। ক্রীড়ামোদীদের আবেগের দিন ছিলো যখন মাশরাফি বিন মর্তুজা টিটোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। টিটোয়েন্টি সিরিজের আগে হুট করে মাশরাফির অবসর নাড়া দিয়েছিলো অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীকে। মাশরাফির টি টোয়েন্টিতে বিদায়ী ম্যাচে বাংলাদেশ জয় উপহার দিলো শ্রীলংকাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে। ওয়ানডে সিরিজে গৌরব: শ্রীলংকার সফরে শততম জয়ের সুখস্মৃতি তো ছিলোই। শ্রীলংকার অনুষ্ঠিত ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের চমৎকার এক সেঞ্চুরি, সাকিব আল হাসানের অর্ধ শতক আর অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের অসাধারণ নৈপুণ্যে বাংলাদেশ ৩২০ ছাড়িয়ে যায়। শেষ দিকে মোসাদ্দেক ঝড় তোলেন আর জবাবে বাংলাদেশি বোলারদের অসাধারণ বোলিং এ খুব দ্রুতই অলআউট হয়ে যায় শ্রীলংকা। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শ্রীলংকা বেশ বড় রান তোলে থারাংগা আর কুশাল পেরেরার সৌজন্যে বিশাল রান তোলে শ্রীলংকা। জবাবে টাইগার রা ব্যাটিং করতে নেমেই লংকান পেসারদের তোপের মুখে পরে। কিন্তু বৃষ্টি হানা দিলে পুরো ম্যাচ পন্ড হয়ে যায়। সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে শ্রীলংকা বেশ বড় স্কোর গড়ার পথে এগিয়ে গেলেও শেষ দিকে টাইগাররা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে স্কোর টাকে নাগালের ভেতর রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উচ্চাভিলাষী শট খেলার প্রবণতা সিরিজ জয়ের আশা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ১–১ ব্যবধানে ড্র হয় সিরিজ। তবুও বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় টাইগাররা ওয়ানডেতে বেশ শক্তিশালী, একইভাবে শ্রীলংকার মাটিতে টানা দুই ওয়ানডে সিরিজ অজেয় থাকলো বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া বধ ও এক সুপারম্যানের গল্প: বাংলাদেশের ক্রিকেটের মান এতই উন্নত হচ্ছে দিনের পর দিন তা গোটাবিশ্বের কাছে বেশ নজর কেড়েছে।
গত বছর অস্ট্রেলিয়া সিরিজ যখন বাতিল হয়ে গেল বাংলাদেশের সমর্থকরা অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা দেখার জন্য আরো বেশি উন্মুখ হয়ে উঠলো। শততম টেস্ট জিতে এমনিতেই বাংলাদেশ টগবগে। তার উপর দেশের মাটিতে সাকিব আল হাসানের নিজেদের স্পিনার দের সেরা মনে করায় প্রেস কনফারেন্সে স্টিভেন স্মিথ বলেছিলেন এটা বাড়াবাড়ি। কিন্তু টেস্ট শুরু হতেই বোঝা গেলো, ২২ গজে টাইগাররা কতদিন ধরে আগুণ ঝরানোর জন্য প্রস্তুত। লো স্কোরিং টেস্টে অসাধারণ ব্যাটিং এবং বোলিং দিয়ে টেস্টের দুই ইনিংসেই ধসিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান। প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন ম্যাচে বাংলাদেশ ২০ রানে হারায় অস্ট্রেলিয়াকে। সারা বিশ্ব সাক্ষী হয়ে রইলো বছরের অন্যতম সেরা এই টেস্ট ম্যাচের। অস্ট্রেলিয়াকে যে হারানো যায়, তাও আবার টেস্টে, এটা একসময় বাংলাদেশ কল্পনাতেই ভাবতে পেরেছিলো। যদিও দ্বিতীয় টেস্টে ডেভিড ওয়ার্নার আর হ্যান্ডস্কম্বের শক্ত জুটি আর পরের ইনিংসে বাংলাদেশের নাজুক ব্যাটিং ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় বাংলাদেশকে। বেশ হাড্ডাহাড্ডি সিরিজে ১–১ সমতা আনে অস্ট্রেলয়া।
কিন্তু পুরো সিরিজেই বাংলাদেশ লাভ অসাধারণ সম্মান সারা দুনিয়ার ক্রিকেটভক্তদের হাতুরুসিংহের পদত্যাগ: দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর হাতুরুসিংহ দেশে দলের সাথে ফিরে না আসলে শুরু হয় গুঞ্জন। গুঞ্জল ডালপালা মেলা শুরু করে যখন শ্রীলংকার ক্রিকেটবোর্ড তাকে কোচ হবার আমন্ত্রণ জানায়। মূলত দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে সমস্যা, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দলের হতাশা, এছাড়াও নানা কারণে হাতুরুসিংহের পদত্যাগ কাম্য না থাকলেও বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচের পদ থেকে সরে গেছেন।
Written by
Tahmid Khan