বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা

0

“বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা”

ছোট বেলা থেকে খেলাধূলার প্রতি বেশি আগ্রহ ছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার। তাদের বাড়ির পাশেই ছিল স্কুল মাঠ। গ্রামের বড় ছেলেরা সে মাঠে ক্রিকেট খেলত। স্কুল মাঠে বড়দের ক্রিকেট খেলা দেখে দেখে মাশরাফির ক্রিকেট এর প্রতি আকষর্ণ তৈরি হয়। উইকেট কিপারের পাশে মাশরাফি দাড়িয়ে থাকত। কিন্তু আহত হবে ভেবে বড়রা তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিত। বড়রা সেখান থেকে সরিয়ে দিলে ছোট মাশরাফির মন খুব খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু যার ক্রিকেট নিয়ে এত আগ্রহ তাকে কেউ আটকে রাখতে পারে না, মাশরাফিকেও পারেনি।

মাশরাফির বাবার নাম গোলাম মর্তুজা। তিনি বর্তমানে একজন ব্যবসায়ী। আর মায়ের নাম হামিদ মর্তুজা। তিনি গৃহিণী। মাশরাফিকে তার বাবা মা আদর করে কৌশিক বলে ডাকে। এই নামে পরিবার এর সবার কাছে পরিচিত তিনি।

নব্বইয়ের দশকে নড়াইলের ক্রিকেটার সংগঠক শরীফ মোহাম্মদ হোসেন উঠতি তরুণদের যত্ন নিতেন। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে মাশরাফিকে তার ক্লাব নড়াইল ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দেন। এই সময় থেকে মাশরাফির পেস বলের গতি সবার চোখে পড়া শুরু করে। ১৯৯১ এর দিকে মাগুরায় বিকেএসপির প্রতিভা অণ্বেষন ক্যাম্পের বিকেএসপির কোচ বাপ্পির সান্নিধ্যে এসে বোলিংয়ের অনেক মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। পরের বছর জাতীয় কোচ ওসমান খান নড়াইলে এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করছিলেন। ওই সময় মাশরাফির আমন্ত্রণ আসে খুলনায় খেলার জন্য। খুলনায় তার বলে গতি দেখে সবার চোখ কপালে উঠে যায়। সেই সূত্রে খুলনা বিভাগীয় অনূর্ধ্ব ১৭ দলে খেলার সুযোগ পান ও ঢাকায় আসেন।

পরবর্তীতে সুযোগ পান জাতীয় অণূর্ধ্ব ১৯ দলে। সে সময় তার বোলিং কোচ অ্যান্ডি রবার্টসের পরিচর্যায় পাল্টে যান মাশরাফি। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে মাশরাফির দারুণ পারফরমেন্সের কারণে জিম্বাবুয়ে এ দলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পান। এনিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। কারণ মাশরাফি ঢাকার কোন সিনিয়র ডিভিশন লীগেও খেলেননি। তবে সমালোচকদের মোক্কম জবাব বোলিংয়ের মাধ্যমে দিয়েছিলেন মাশরাফি। এই সিরিজে এক ম্যাচে মাশরাফি চার উইকেট নিয়েছিলেন। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে তার নাম হয়ে যায় “নড়াইল এক্সপ্রেস”। এরপর ইনজুরি ছাড়া আর কেউ মাশরাফি বিন মর্তুজাকে আটকাতে পারেনি।


পড়ালেখায় ও ভালো ছিলেন মাশরাফি। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় নড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নড়াইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে 2001 সালে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে 2003 সালে। এরপর দর্শন শাস্ত্রে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ক্রিকেটের ব্যস্ততার কারণে তার একাডেমি পড়াশুনা শেষ করা হয় নি।

বারবার দল থেকে বাদ পড়েও ফিরে আসতেন বলে ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলিকে ডাকা হত কামব্যাক কিং নামে। আর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে বারবার ইন্জুরিতে পড়েও রাজসিক প্রত্যাবর্তন করা মাশরাফিকে কি নামে ডাকবেন, সেটা না হয় আপনারা ঠিক করুন।

ক্যারবীয় দীপপুজ্ঞে গেলেন জীবনে প্রথমবারের মত দলনেতা হয়ে। প্রথমবারের মত সুযোগ পেলেন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার। সপ্নিল চোখে সাদা পোশাকের উপর ব্লেজার জড়িয়ে নামলেন ফ্লয়েড রেইকারের সঙ্গে টস করতে। টস করলেন, ব্যাট করলেন কিন্তু যেটি আসল কাজ, দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, তা আর করতে পারলেন না। বোলিং করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন। ব্যাথায় কাতর মাশরাফি মাঠ ছাড়লেন, দুজন সতীর্থের কাঁধে হাত দিয়ে। সে কী দু:সহ মূহুর্ত।

একজন ক্রিকেটারের গন্ডি ছাড়িয়ে যিনি অন্য উচ্চতায় পৌছে গেছেন। তার হার না মানা মনোবলে নিজেকে অনন্যরুপে উপস্থাপন করেছেন, করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ইনজুরি নামক বিপদটাকে সঙ্গী করে পথ চলেছেন অভিষেক এর পর থেকে। ইনজুরিতে কাতরাতে কাতরাতে কতবার মাঠের বাইরে গেলেন আর রাজসিক প্রত্যাবর্তন করলেন। তার যদি একটা তালিকা তৈরী করা হয় সেটাও নিশ্চয় মোটাসোটা বইয়ের আকার হয়ে দাড়াবে। একবার নয়, দুবার নয় বারবার গেছেন ধারালো ছুরির নিচে। জীবন নাশের হুমকি সত্ত্বেও কেবল খেলে যাচ্ছেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। কারণ এই দেশ ও দেশের মানুষ তার বেঁচে থাকার স্পন্দন।

ইনজুরিতে পড়ে বারবার ফিরে আসার মন্ত্রটা ভালোই করে জানেন তিনি। সেই মন্ত্রবলেই অবলীলায় জয় করেন,দূর্জেয় সব বাঁধা। অকপটে ঝাপিয়ে পড়েন দেশের জন্য। তাই মাশরাফি কেবলমাত্র ক্রিকেটার থাকেন না, হয়ে যান তার চেয়ে বেশি কিছু। তার একেকটি কথা, একেকটি বাক্য হয়ে যায়, অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। অনন্ত উৎসাহের ফোয়ারা হয়ে যান ব্যাক্তি মাশারফি।

তার ফিরে আসার মন্ত্রটা শুনুন একবার। এই প্রশ্নটা মাশরাফিকে করা হলে মাশরাফি বলেন, বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার প্রেরণা পাই, বীর মুক্তিযোদ্বাদের কাছ থেকে। মাশরাফি আরো বলেন, এমন ও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের কারণে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছিলাম না, দুই তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা হচ্ছে। তখন তাদের স্বরণ করেছি। নিজেকে বলেছি হাতে পায়ে গুলি লাগার পরও তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল, আমি কেন পারব না।

মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার নিপুণ পরিচলানায় একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দল গড়ে উঠেছে এক দূর্দান্ত অপারেজেয় শক্তি হিসাবে। তার দৃড়চেতা মনোভাবের সাথে সঙ্গতি রেখেই তিনি গড়ে তুলেছেন, দৃড় আত্নপ্রত্যয়ের বলীয়ান, রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াইয়ের প্রত্যাশী। অনমনীয় চিত্রের হারার আগে হার না মানা দুরন্ত এক বাংলাদেশ দল। যারা ঠিক তাঁর মতো করেই প্রবল প্রতাপশালী প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। কঠিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করার সামর্থ্য ও সাহস রাখে।

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার নেতৃত্বে টাইগাররা ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে। এবং ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে প্রথমবারের মত মাশরাফির নেতৃত্বে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। তার সাথে সাথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্তিশালী দল গুলার বিপক্ষে সিরিজ জয় লাভ করে প্রথমবারের মত। এবং তার নেতৃত্বে আইসিসি সেরা দশ দেশের তালিকায় ছয় নাম্বারে উঠে আসে টাইগাররা। সম্প্রতি বাংলার ক্রিকেট এর এই উজ্জ্বল নক্ষত্র টি টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তবে  ২০১৯ সাল এর বিশ্বকাপ পর্যন্ত ওয়ানডে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এক মাশরাফি যেন শুধু ক্রিকেটার না, যেন বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের প্রাণ। তার একটা সপ্ন দেখা মানে পুরা বাংলাদেশের সপ্ন দেখা। তাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের হাজারো তরুণ প্রজন্ম সপ্ন দেখে ও বেঁচে থাকার প্রেরণা ও সাহস পায়। পুুরা ক্রিকেট বিশ্ব মাশরাফির এই হার না মানা মানসিকতার জন্য আদর্শ হিসাবে মেনে নেয়। এই সবার মাশরাফি যেন আরো অনেক বছর আমাদের মাঝে বেঁচে থাকে সে কামনা ও প্রার্থনা রইল।

Written By 

Mohammad Ali

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *