বিশ্বকাপ ফুটবল এমন একটি আয়োজন যা পুরো বিশ্বকে একই সুতোয় বাঁধতে পারে।। ইউরোপ, আমেরিকা,আফ্রিকা, এশিয়া- সব মহাদেশের প্রতিনিধি দেশের অংশগ্রহণ থাকে বিশ্বকাপে। তাই ফুটবলবিশ্বকাপে সার্বজনীনতার ছোঁয়া রয়েছে। ফুটবল বিশ্বকাপমানে উন্মাদনা। এই উন্মাদনায় প্রায়শই গৌণ হয়ে পড়ে রাজনীতি-অর্থনীতির মত সর্বময় প্রভাব।
তবে মাঝে মাঝে এসবের প্রভাব ও.যে বিশ্বকাপ আয়োজনে চোখে পড়ে-তার উদাহরণ ও বিরল নয়। তবে এসবের প্রভাব স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয় ফুটবল খেলা একধরণের শিল্পের প্রকাশ। আর ফুটবল বিশ্বকাপ সেই শিল্পের বহি:প্রকাশের এক বিশাল আয়োজন।যা কোন কাজে লাগে না, তাই তো শিল্প। বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দলের বিজয়ের আনন্দ, পরাজয়ের দুঃখ আমাদের কোন ব্যক্তিগত লাভালাভের সাথে জড়িত নয়। আর সে কারণেই ফুটবল সম্ভোগ হলো শিল্পের সম্ভোগ। শিল্প-হলো মানুষের মহত্তম আচার, মহত্তম প্রকাশ। শিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাকি কবিতা।আর বলা হয়, শিল্পেরসঙ্গে যদি খেলাকে তুলনা করা হয় তাহলে ফুটবল হলো সেই কবিতা।
জোড় সাল, কিন্তু লিপইয়ার নয়। চার বছর অন্তর এমন একটি বছরের মধ্যবর্তী মাসটা কাছে এলেই কেমন শিহরণ জাগে। অন্তহীন রোমাঞ্চ, অসহ্য স্নায়ু-পীড়ন, রাতজাগা ঢুলুঢুলু চোখ আর অনি:শেষ ফুটবল রোমাঞ্চ। কিন্তু এই ফুটবলের শুরুটা কেমন ছিল? ফুটবল.মহোৎসবের রথ কাদেরকে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সঙ্গী করেছে? বিশ্বকাপের:..রেকর্ডগুলো কি কি? বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অবস্থান কি? মূলত আমার আলোচনায় এই প্রশ্নের উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছি।আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করাকে উদ্দেশ্য করে ১৯০৪ সালে ৭টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল”ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন” বা ফিফা নামের এই আন্তর্জাতিক সংগঠন। যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২০৯। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে শুরু হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপ ব্রাজিলে এসেছে মাঝের ১৮টি বিশ্বকাপের ইতিহাস সাথে নিয়ে।
১৯৩০
প্রথম আসরের স্বাগতিক হিসেবে উরুগুয়েকে বেছে নেওয়ায় দু’টি কারণ ছিল। উরুগুয়ের স্বাধীনতায় শতবর্ষ উদযাপন এবং অলিম্পিক ফুটবলে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এমনখরচ ও সময়-বিবেচনা করে অনেক ইউরোপীয় দল প্রতিযোগীয় অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। মোট ১৩টি দলের মধ্যে উরুগুয়েই শিরোপা জিতে নিয়েছিল।
১৯৩৪
দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ৩২টি দল খেলতে আগ্রহী হওয়ায় বাছাইপর্বের আয়োজন করা হয়। ১৬ দলের টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি আর চেকোস্লোভাকিয়া। জিত্তসেম্পে মিয়াজ্জার বানিয়ে দেওয়া বলে অতিরিক্ত সময়ে গোল করে ইতালিকে প্রথম শিরোপা এনে দেন অ্যাঞ্জেলো শিয়াভিত্ত।
১৯৩৮
বিগত শতাব্দীর তৃতীয় বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন খেতাব পায় ফ্রান্স। রানার্স আপ ইটালি। পনেরটি দেশ এই বিশ্বকাপে অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩৮ সালে ১২ বছরপর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের পরবর্তী আসর।
১৯৫০
এটিই একমাত্র বিশ্বকাপ যেটিতে কোন ফাইনাল হয়নি। পয়েন্টের ভিত্তিতে স্থান নির্বাচন হলেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ আসরটি। কারণ উরুগুয়ের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্রাজিল হেরে যাওয়ায় হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল শতাধিক ব্রাজিলিয়ানের।
১৯৫৪
১৯৫৪ সালে পঞ্চম বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে সুইজারল্যান্ড। চুড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়া ১৬টি দলের মধ্যে টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে এসেছিল পুসকাসের দল। ফাইনালের প্রথমার্ধের ২-০তে এগিয়ে থাকা হাঙ্গেরিকে শেষ পর্যন্ত ৩-২ এ হারিয়ে দেয় জার্মানী। হাঙ্গেরির বিস্ময় পুসকাস ১১টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার কতিত্ব দেখান।
১৯৫৮
ব্রাজিলের অপেক্ষার পালা ফুরায় ফুটবলের মহানয়ক ’পেলে’র আগমনের মধ্য দিয়ে, সুইডেনকে হারিয়ে ৫-২ গোলে বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল।
১৯৬৬
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপটি ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তখন পর্যন্ত একমাত্র ফাইনাল, যে ম্যাচ দেখেছিল হ্যাটট্রিক জিওফ হার্স্টের সেই হ্যাটট্রিক জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারায় ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আগে চুরি হয়ে গিয়েছিল জুলেরিমে’ কাপটি। নরওয়ের একটি বাগান বাড়ি থেকে খুঁজে বের করে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে পিকল্স নামের একটি কুকুরও।
১৯৭০
আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা মুছে ফেলে আবারও শেরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল। এই বিশ্বকাপেই প্রথম চালু হয় হলুদ ও লাল কার্ড। তিনবার শিরোপা জেতায় ’জুলে রিমে’ ট্রফিটা একেবারেই দিয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিলকে।
১৯৭৪
বিশ্বকাপে আবির্ভাব হলো ’টোটাল ফুটবলে’র পুরো দলকেই একই সঙ্গে আক্রমণ ও রক্ষণ করার দুরুহ কাজটি অনুপম দক্ষতায় সম্পন্ন করলো হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানীর অধিনায়ক বেকনবাওয়ার হল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম ফিফা কাপ জয়ের অনন্য কৃতিত্ব দেখান।
১৯৭৮
প্রায় আধা শতাব্দী আর ১০টি বিশ্বকাপের পর অপেক্ষার পালা ফুরাল আর্জেটিনার। ৬-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা যে ম্যাচটি পাতানো ছিল বলে এখনো কথা ওড়ে বাতাসে।
১৯৮২
আকার- আয়তনে আগের বিশ্বকাপের তুলনায় বেড়ে যায় দ্বাদশ বিশ্বকাপ। দলের সংখ্যা বেড়ে দাড়ায ২৪টি। এই বিশ্বকাপের নায়ক ইতালিয়ান স্ট্রাইকার পাওলো রসি। টাইব্রেকারে এসে ফ্রান্স ৩-১ গোলে হেরেছিল জার্মানির কাছে।
১৯৮৬
বিশ্বের অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনা ফুটবল বিশ্বকাপের জন্মলগ্ন থেকে প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৭৮ সালে প্রথম এবং ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ পায়। সর্বকালের সেরা ফুটবলার ডিয়াগো ম্যারাডোনার অবদানের জন্যই ১৯৮৬ সালে আবারও শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় এই ল্যাটিন আমেরিকার দেশটি, ৩-২ এ জিতে ছিল আর্জেন্টিনা।
১৯৯০
বিশ্বকাপের এই আসরটি বসে ফুটবলের আরেক পরাশক্তি ছন্দময় ফুটবলের দেশ ইটালিতে। পশ্চিম জার্মানী তৃতীয় বারের মত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ান হবার গৌরব অর্জন করে ইটালির এই আসরে। সিলাচী ব্যক্তিগত ৬টি গোল করে গোল্ডেন বুট পাওয়ার খেতাব অর্জন করে।
১৯৯৪
বেশ কিছু অঘটনের জন্ম দিয়েছে এই বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দল বাছাইপর্বের বৈতরণীই পেরোতে পারেনি। ডোপ টেষ্টে ধরা পড়ে টুর্নামেন্ট থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন ডিয়েগে ম্যারাডোনা। ইতালির বিপক্ষে ফাইনালের নাটকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে জয় হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল।
১৯৯৮
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আসরে অংশগ্রহন করে মোট ৩২টি দেশ, বিশ্বখ্যাত ফুটবলার জিনেদিন জিদান ফ্রান্সকে ভাসিয়েছিলেন সফলতার আনন্দে, করেছিলেন জোড়া গোল। এই বিশ্বকাপ থেকেই শুরু ৩২ দলের বর্তমান ফরম্যাট।
২০০২
এশিয়ার বুকে প্রথম বিশ্বকাপ। আয়োজক দেশ যৌথবাভে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান। রোনালদোর জোড়া গোলে ব্রাজিল জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে বিশ্বজয়ী হয় পঞ্চমবারের মতো।
২০০৬
জার্মানীতে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে সবাই ধরেই নিয়েছিল শক্তিশালী জার্মানীরা তুলে নিবে বিশ্বকাপ। কিন্তু তারা সেমিফাইনালেই বিদায় নেয়। ফ্রান্স ও ইটালির ফাইলাল ছিল নাটকীয়তার ভরপুর। শেষ পর্যন্ত দুই যুগ পর শিরোপা জিতেছিল ইতালি।
২০১০
২০১০ সাল ছিল বিশ্বকাপের বছর, অনেক দিক থেকেই ’প্রথম’ এর জন্ম দেওয়া এই বিশ্বকাপ পেল নতুন চ্যাম্পিয়ন। দেশটি ছিল স্পেন। বিশ্ব ফুটবলে ধাঁধা হয়ে ছিল স্পেন আর হল্যান্ডের বিশ্বকাপে না জেতা। এই দুটি দলই মুখোমুখি হয়েছিল ফাইনালে। বিশ্বকাপে প্রথম কোন ইউরোপীয় দলের হাতে শিরোপা ওঠার জন্য স্মরণীয় এই বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের রেকর্ড
সবচেয়ে বেশি গোল করেছে ব্রাজিল
এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোল জাঁ ফন্টেইনের (১৯৫৮)-১৩টি
তিনবার বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র ফুটবলার -পেলে (১৯৫৮,১৯৬২ও ১৯৭০)
বেঞ্চে থেকেও লাল কার্ড দেখা ফুটবলার -ক্লদিও ক্যানিজিয়া (আর্জেন্টিনা-সুইডেন,২০০২)
চুড়ান্ত পর্বে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি- ব্রাজিল (২০)।
সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয়-ব্রাজিল(৫)
সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলা দল-ব্রাজিল ও জার্মানি (৭ বার করে)
সবচেয়ে বেশিবার টুর্নামেন্ট খেলে দ্বিতীয় রাইন্ডে উঠতে না পারা দল-স্কটল্যান্ড(৮)
সবচেয়ে বেশি টানা শিরোপা -২: ইতালি (১৯৩৪,১৯৩৮), ব্রাজিল (১৯৫৮,১৯৬২)
সবচেয়ে বেশি টানা ফাইনাল-৩: (জার্মানি ১৯৮২-১৯৯০)
ব্রাজিল (১৯৯৪-২০০২)
সবচেয়ে বেশি টানা জয়-১১, ব্রাজিল (২০০২-২০০৬)
সবচেয়ে বেশিবার অংশগ্রহণ -৫ বার; আন্তোনিও কারবাজাল (মেক্সিকো, ১৯৫০-১৯৬৬) ও লোথার ম্যাথাউস (জার্মানি, ১৯৮২-১৯৯৮)। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ফুটবলার – লোথার ম্যাথাউস (জার্মানি,২৫ ম্যাচ)। এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি গোল -৫, ওলেগ সালেঙ্কো (রাশিয়া-ক্যামেরুন,১৯৯৪)। সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক ২টি -স্যান্ডর ককসিস (হাঙ্গেরি,১৯৫৪), জাঁ ফন্টেইন (ফ্রান্স, ১৯৫৮), জার্ড মুলার (জার্মানি,১৯৭০) ও গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা (আর্জেন্টিনা-১৯৯৪-১৯৯৮। সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা-পেলে (ব্রাজিল,১৭ বছর ২৩৯ দিন) সবচেয়ে কম বয়সে হ্রাটট্রিক-পেলে (১৭বছর ২৪৪ দিন, ব্রাজিল-ফ্রান্স,১৯৫৮) দ্রুততম গোল -১১ সেকেন্ড; হাকান সুকুর (তুরস্ক-কোরিয়া, ২০০২)। সবচেয়ে বেশি গোলের ম্যাচ – অষ্ট্রিয়া ৭-৫ সুইজাল্যান্ড,১৯৫৪। সবচেয়ে বেশি সময় গোল না খাওয়া গোলরক্ষক-ওয়াল্টার জেঙ্গা, ৫১৭ মিনিট (ইতালি, ১৯৯০)। সবচেয়ে বেশি বয়সী কোচ-অটো রেহেগাল (৭১ বছর ৩১৭ দিন, গ্রিস(২০১০)। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে টুর্নামেন্ট জয়- মারিও জাগালো ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। দ্রুততম লালকার্ড -৫৬ সেকেন্ড, হোসে বাতিস্তা (উরুগুয়ে-স্কটল্যান্ড)
বিশ্বকাপের বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বকাপের সাথে পরিচয় হয় ১৯৮২ সালে। যদিও এর আনন্দ উম্মাদনা শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। বাংলাদেশ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৪ তম। ’বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন’ এর কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফুটবলের চুড়ান্ত পর্বে খেলার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ ভিশন ২০২২। কাতারে খেলবে বাংলাদেশ সে স্বপ্নেই রইলাম।
Written By
Mohammad Ali