বিশ্বকাপ শুরু করার নেপথ্যে ছিল ১৯৩০-এর তৎকালীন সভাপতি জুলে রিমে। ১৯২৮ থেকে ফুটবলে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে চায় ফিফা। আর বিশ্বকাপ হলে ট্রফি থাকবেনা? হ্যা ট্রফি বানানো হল। ট্রফির নকশা ও তৈরি করার দায়িত্ব পরে ইতালিয়ান ভাস্কর ও স্থপতি অ্যাবেল লাফলারের উপর। জুলে রিমে লাফলারকে এই দায়িত্ব দেয় ১৯৩০ উরুগুয়ে বিশ্বকাপের জন্য…… ৩.৭৮ কিলোগ্রাম ভরের এবং ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার অনন্য ট্রফিটিতে পুরো খাটি সোনা ছাড়াও বেশ কিছু ধাতু ছিল, দৃঢ়তার জন্য। ট্রফিতিতে ছিল বিজয়ের প্রতীক গ্রিক দেবী ‘নাইকি’র মূর্তি। ট্রফিটিকে বিশ্বকাপজয়ী দলের কাছে চার বছরের জন্য রাখতে দেয়া হত। আবার, ট্রফি তৈরির সময় এই মর্মে ঘোষণা দেয়া হয় – তিনবার বিশ্বকাপজয়ী দলকে এই ট্রফিটি আজীবনের তরে দিয়ে দেয়া হবে।
ট্রফিটি প্রথম জিতে নেয় ‘৩০ এর স্বাগতিক উরুগুয়ে। ১৯৩৮ সালে ইতালি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য ইতালিকে বিশ্বকাপ রাখার জন্য দেয়া হয়.কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৩৮ থেকে ১২ বছরের জন্য বন্ধ রাখা হয় বিশ্বকাপ। কিন্তু ইতালির কাছে ট্রফি রেখে শান্তিতে ছিল ফিফা কারণ নাৎসি বাহিনী! নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে ট্রফি রক্ষার জন্য এফআইজিসির সভাপতি ও ফিফার সহসভাপতি অত্তোরিনো বারেসসি ব্যাংকের লকারে প্রথমে ট্রফি রাখেন। এরপর ব্যাংকের লকার থেকে ট্রফি তুলে নিয়ে সোজা রাজধানী রোমে চলে যান বারেসসি। তারপর ট্রফিটির ঠিকানা হয় জুতার বাক্সে, বারেসসির বিছানার নিচে। এভাবেই নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায় জুলে রিমে বা ভিক্টোরি! ১৯৪৬ এর শেষে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বিশ্বকাপ আয়োজনের হোতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের নামে ট্রফিটিকে “জুলে রিমে ট্রফি”র নাম দেয়া হয়। এর আগে এটাকে “ভিক্টোরি” বলে ডাকা হত….. যদিও সাধারণ মানুষ চিনত “কোউপ ডু মোন্ড” বা বিশ্বকাপ নামে।
এরপরই শুরু হয় জুলে রিমে রহস্য…. ঘটে ট্রফি চুরির ঘটনা। ১৯৬৬ সালে স্বাগতিক ইংল্যান্ড থেকে চুরি যায় ট্রফি কিন্তু কুকুর ‘পিকলস” এর কারণে ট্রফি পাওয়া যায়। আর ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপ অর্থাৎ তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য অঙ্গীকার অনুযায়ী ট্রফিটি ব্রাজিলের শোকেসে পাঠানো হয়। সেই ব্রাজিলের ট্রফিকেস থেকেও চুরি হয় জুলে রিমে :-/ :-/! কিন্তু এবার চোর পাওয়া গেলেও ট্রফি পাওয়া যায়নি। আর এই জুলে রিমে চুরির সাথে ব্রাজিলের কেস থেকে চুরি যায় আরো দুটি অর্থাৎ তিনটি ট্রফি। কিন্তু শোকেসে তিনটি ট্রফিই আছি…. রেপ্লিকা!!!!
জুলে রিমে রহস্য শুরু
১৯৬৬ বিশ্বকাপ। আয়োজক ইংল্যান্ড! প্রথমবারের মত ফুটবলের সবচেয়ে সম্মানজনক ও বড় আসরের দায়িত্ব ইংল্যান্ডের কাঁধে….. ইংল্যান্ড জুড়ে আনন্দ জোয়ার। আর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জো মেয়ার্স যেন বেশি খুশি। জানুয়ারি মাসে স্বাগতিক হিসেবে ইংল্যান্ডের কাছে ট্রফি রাখতে পাঠায় ফিফা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ভেতর ট্রফি রাখা হয়। কিন্তু সমস্যা বাজে যখন স্ট্যানলি গিবসনের কোম্পানি স্ট্যাম্প কোম্পানি ট্রফিটি করাতে চায়, অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল। অনুমতির সাথে শর্ত ছিল নিরাপত্তা তো কঠোর হতে হবে, সাথে সাথে ৩০ হাজার পাউন্ড ইন্সুরেন্স জমা দিতে হবে। [ট্রফিটির ভ্যালু ছিল ৩ হাজার পাউন্ড??]। ১৯ মার্চ থেকে ট্রফিটির প্রদর্শনীর শুরু হয়, ওয়েস্টমিনার হলে….. বিশ্বকাপ দেখার জন্য ফ্যানদের ভিড়, ফাঁকে মেয়ার্সও সুরক্ষাব্যবস্থা দেখে এলেন। ট্রফির পাশে চারজন গার্ড, দুজন সাদা পোশাকে আর দুজন কালো পোশাকে ট্রফিকে যেন নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলছে। আর চারদিকে অন্যান্য গার্ডের নিরাপত্তার বলয়। কিন্তু মূল সমস্যা হয় ২০শে মার্চ…. গার্ডদের অদলবদল হয় ১২টার দিকে। ১২ টা ১০ মিনিটের দিকে একজন লক্ষ্য করল ট্রফি কেস খোলা, ট্রফি উধাও, হলের পিছনের দরজা খোলা। ততক্ষণে সাড়া পরে গেছে। খবর পেয়ে মেয়ার্স এলেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এল। আর সেদেশের মিডিয়াও কম যায়না! পত্রিকা ও রেডিওর মাধ্যমে সারা বিশ্ব খবর পেল ট্রফি উধাও! সকল গার্ডদের জিজ্ঞাসাবাদ হল, বাট কোন অগ্রগতি নেই। কেউ কোন কিছু না দেখলেও একজন জানাল, সে এক আগন্তুককে টেলিফোন বুথের সামনে দেখছে। আর গির্জায় যাওয়া মিস. কোম্বও এক সন্দেহভাজন দেখেছে…. কিন্তু দুজনের বর্ণনা একে অন্যের সাথে মিলছে না। বাধ্য হয়ে দুজনকে খোজা শুরু করে পুলিশ…. একদিন হয়ে গেল কিন্তু কোন সমাধান হচ্ছেনা।
২১ মার্চ…. জো মেয়ার্স যেন চিন্তায় মারা যাচ্ছেন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। এমন সময় এক ফোনকলে অপর পাশ থেকে এক অচেনা কণ্ঠ ভেসে উঠল। পরিচয়কে গুলি মেরে সরাসরি বলে উঠল, সে যেন পরেরদিন চেলসি ফুটবল ক্লাবের সামনে যায় এবং একটি পার্সেন গ্রহণ করবে। পরেরদিন পার্সেল এল…..পার্সেলে ছিল ট্রফির উপরের কিছু অংশ ও চিরকুট “ট্রফি ভালমত পেতে হলে ১৫ হাজার পাউন্ড দিতে হবে যা হবে ১ ও ৫ পাউন্ডের নোট। পুলিশকে জানানো যাবেনা…… রাজি থাকলে ইভনিং নিউজ পত্রিকায় সংকেত দিতে হবে।”এরকম অবস্থায় মেয়ার্স কবে পরেছে কে জানে? একটু পর পর ঘামছে। পরক্ষণেই ফোন এসে বলল নোটগুলা হবে ৫ ও ১০ পাউন্ডের।এবার নিজের পরিচয় দিল জ্যাকসন নামে…. (আসলে জ্যাকসন ছিল চোর ও মেয়ার্সের মাঝের এক মধ্যস্থতাকারী।তার আসল নাম হল এডওয়ার্ড বিচলে…মিসেস কোম্ব একে শনাক্ত করে। পোল নামে এক ব্যক্তি তাকে এ কাজের জন্য নাকি ৫০০ পাউন্ড দেয়)।এবার বিষয়টি আরো শক্তভাবে নিল মেয়ার্স…. গোয়েন্দা চার্লস ব্যাগি এবং পুলিশকে পুরো ব্যাপার জানানো হল। পুলিশ ইভনিং পত্রিকায় শর্তানুসারে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিল। এবং স্থানীয় ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নকল টাকা বানানো হল…. এবার বান্ডিলের উপরে আর নিচে থাকবে আসল টাকা, মাঝখানে নকল টাকা। এবং জো মেয়ার্সের সাথে যাবে তার সহকারী ম্যাকফি (গোয়েন্দা ব্যাগি)।কিন্তু সমস্যা বাঁধল যখন মেয়ার্সের অ্যাজমা অ্যাটাক হয়!তাই বাধ্য হয়ে জ্যাকসন, গোয়েন্দা ব্যাগি অর্থাৎ ম্যাকফির সাথে ডিল ফাইনাল করে….ব্যাটার্সি পার্কে ডিল সম্পন্ন হবে। আপাতভাবে দেখলে ব্যাগি একলাই যাচ্ছে কিন্তু তার পিছনে দূরে পুলিশ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ব্যাটার্সি পার্কে ব্যাগি ও জ্যাকসনের দেখা হল। ব্যাগি তাকে ব্রিফকেসের টাকা দেখাল কিন্তু জ্যাকসন নকল টাকা ধরতেই পারল না। ব্যাগি ট্রফি পাওয়ার আগে টাকা দিতে নারাজ। তাই ব্যাগির গাড়িতে উঠল জ্যাকসন, তাদের গাড়ির পিছনে পুলিশের গাড়ি। এবার জ্যাকসন পিছনে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তাদের চাল ধরে ফেলল এবং সে ট্রফি আনবে বলে এক ট্রাফিক সিগনালে নেমে পরে। পরক্ষণেই সে উধাও – যেন সে অ্যালিয়েন ছিল! এরপর বহু খোঁজাখুঁজির পর চলন্ত গাড়িতে করে পালাবার সময় তাকে পুলিশ ধরে ফেলে। সোজা তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ট্রফি চুরির কেস দেয়া হয় তার নামে। এরপর সে নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বর্ণনা করে এবং পোল নামক এক ব্যক্তির কথা বলে। কোম্বের শনাক্তকারী ব্যক্তি জ্যাকসন সাজা পেল কিন্তু ট্রফির সন্ধান নেই। প্রচুর খোঁজাখুঁজি চলল বাট অগ্রগতি জিরো।
মার্চের ২৭ তারিখ হয়ে গেল, ট্রফি চুরি হয়েছে আজ ৭ দিন! তাহলে বিশ্বকাপের কি হবে? তো ঐদিন বিউলা হিল স্ট্রিটসের ডেভিট কর্ভেট তার কুকুর “পিকলস”কে নিয়ে ঘুরতে বের হল। কর্ভেটের বাসার পাশে আসতেই কুকুরটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল এবং আচমকা দৌড় দিল…. বাসার নিচ থেকে পুরানো নিউজপেপারে মোড়ানো একটা জিনিস বের করল। কর্ভেট নিউজপেপার খুলেই দেখে জুলে রিমে ট্রফি! ট্রফির উপর বিশ্বকাপজয়ী দলের নাম খোদাই করা। আর কি! সোজা পুলিশ স্টেশন! প্রথমে পুলিশ তাকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, শক্ত প্রমাণ থাকায় বেঁচে যায় কর্ভেট ও পিকলস। এফএ থেকে শনাক্ত করা হল জুলে রিমে ট্রফি এবং জুলাইয়ে হওয়া বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। পিকলস সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করে এবং কর্ভেট পুরষ্কার পায় ৬ হাজার পাউন্ড!!! বিশ্বকাপ না খেলে যদি বিশ্বকাপের মূল্যের দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যায়, তাহলে প্রতিনিয়ত ট্রফি চুরি হওয়া ভাল!! আরেকটি সুযোগ পায় কর্ভেট – বিশ্বকাপজয়ী সদস্যদের সাথে ডিনার করতে পারে কর্ভেট। এভাবেই সম্পন্ন হয় জুলে রিমের একটি রহস্য। আর পিকলস নিয়ে মুভি বানানো হয়!
ব্রাজিলে জুলে রিমে চুরি
সত্তরে তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জয়ের পর জুলে রিমে একদম নিজের করে নেয় ব্রাজিল। রিও ডে জেনিরোর কনফেডারেশনে ট্রফি রাখা হয়। ১৯৮৩ সালে এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ী, এক সাবেক পুলিশ অফিসার ও এক ব্যাংকার সার্জিও পেরাল্টা জুলে রিমে চুরির নকশা করেন। পরিকল্পনামাফিক তারা রাতে নিরাপত্তারক্ষী দের পরাস্ত করে ভিতরে ঢুকে জুলেরিমে সহ আরো দুটি ট্রফি চুরি করে পালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ট্রগি গলিয়ে সোনার বার তৈরি করা! তবে বেশিদিন পেরাল্টা ও সঙ্গীরা লুকিয়ে থাকতে পারেনি। পুলিশ তাদের ধরলে পেরাল্টা জানায়, তারা জুয়ান কার্লোস ফার্নান্দেজ নামক এক আর্জেন্টাইন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ট্রফি গলিয়ে ফেলে কিন্তু কার্লোসের কারখানায় ট্রফির কোন নাম-নিশান পায়নি কেউ…. আর ট্রফি গলানো খুব কঠিন ছিল। তবুও কার্লোস ও সঙ্গীদের সাজা দেয়ার জন্য নেয়া হলে পালিয়ে যায় তারা। যদিও তারা ধরা পরে পরবর্তীতে এবং একজনের মৃত্যু হয়ে যায়। তবুও আসল জুলে রিমে আর উদ্ধার হলনা। এখন ব্রাজিকের ট্রফি কেসে রেপ্লিকা সাজানো আছে!!
আজ সেই জুলে রিমে হয়ত কারোর সোনারবারে কিংবা ঐতিহাসিক সংগ্রহে পরে আছে সেই অনন্য জুলে রিমে……!!
Written By
Mohammad Ali