অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা সালমান খান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণ শিক্ষাবিদ তাঁর ওয়েবসাইটের (www.khanacademy.org) মাধ্যমে বিনা মূল্যে শিক্ষার উপকরণ ও উৎসভিত্তিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় চার কোটি নিবন্ধিত শিক্ষার্থী আছে এই অনলাইন স্কুলের। গত ২২ জুন বিশ্বব্যাংক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সালমান বলেছেন, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কীভাবে গড়ে উঠল খান একাডেমি।
২০০৪ সাল। বিজনেস স্কুল থেকে বের হয়ে তখন সদ্যই একটা প্রতিষ্ঠানে অ্যানালিস্টের চাকরি পেয়েছি। বিয়ে করেছি। নিউ অরল্যান্স থেকে আত্মীয়রা বাসায় বেড়াতে এসেছিল। তাদের কাছে শুনলাম, আমার ১২ বছর বয়সী কাজিন নাদিয়ার গণিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। নাদিয়াকে বললাম, তোমাকে আমি সাহায্য করতে পারি। সেও রাজি। নাদিয়া ফিরে যাওয়ার পর ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে আমরা গণিত নিয়ে আলাপ শুরু করলাম।
একসময় সে ক্লাসের অন্যদের চেয়েও ভালো করতে লাগল। এবং আমি ওর চোখে মোটামুটি ‘টাইগার কাজিন’ হয়ে উঠলাম। এটা আমার জন্য একটা ছোটখাটো আবিষ্কার ছিল। দুই হাজার মাইল দূর থেকেও কাউকে সহযোগিতা করা যায়—ব্যাপারটা খুব ভালো লাগল। আমি নাদিয়ার ছোট ভাইদেরও পড়াতে লাগলাম।
ছোট একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। এতটাই ছোট যে আমার বসের স্ত্রী যখন স্ট্যানফোর্ড ল স্কুলের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন, তাঁর সুবিধার্থে আমাদের ছোট্ট অফিসটা উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানান্তর করা হলো। প্রতিদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমি ১৪-১৫ জন কাজিন ও পারিবারিক বন্ধুকে পড়াতাম।
লক্ষ করলাম, ছাত্রছাত্রীদের খুব সাধারণ কিছু বিষয়ে দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতা কাটাতে ওদের আরও অনুশীলন দরকার। তখন ওদের জন্য আমি একটা সফটওয়্যার তৈরি করলাম, যেটা অনুশীলন করতে সাহায্য করবে। সফটওয়্যারটা ওয়েবসাইটে তুলে দিয়েছিলাম। এক রকম কৌতুক করেই সেই ওয়েবসাইটটাকে বলতাম খান একাডেমি।
তখনো এর সঙ্গে কোনো ভিডিও ছিল না। তবে আশপাশের সবাই আমার এই পাগলামির কথা জানত। বলছি ২০০৬ সালের শেষ দিকের কথা। সে সময় একদিন একটা নৈশভোজের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। আমন্ত্রণকারীর নাম জুলি। জুলি বলছিল, ‘এতজন ছাত্রছাত্রীর পড়া তুমি সাজাও কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ। শুধু নাদিয়াকে পড়ানো সহজ ছিল। কিন্তু এতজনকে সামলানো কঠিন। দেখা যায় আমাকে একই জিনিস বারবার বোঝাতে হয়।’ তখন জুলিই বলল, ‘তুমি তোমার ক্লাসগুলো ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করছ না কেন?’
রীতিমতো হেসেই উড়িয়ে দিলাম। বললাম, ইউটিউবে তো বিড়াল কীভাবে পিয়ানো বাজায়—এসব ভিডিও থাকে। জটিল গণিত শেখানোর জায়গা এটা না। তবু, কীভাবে যেন জুলির ‘হাস্যকর’ বুদ্ধিটাই কাজে লাগালাম। কাজিনদের সমস্যার সমাধানগুলো এক করে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করলাম। ওদের প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক করার মতো। কেউ কেউ এটাও বলল, সামনাসামনি আমাকে দেখার চেয়ে ইউটিউবে দেখতেই নাকি বেশি ভালো লাগে!
কারণটা আমি ধরতে পেরেছিলাম। কেউ যখন কিছু বোঝায়, তখন সে একটা প্রতিক্রিয়া আশা করে। পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলার পর জিজ্ঞেস করে, ‘বুঝতে পারছ?’ হুট করে এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, শিক্ষকের কথা শুনতে শুনতেই আপনি হয়তো মনের অজান্তে আরও জটিল কিছু ভাবতে শুরু করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা ইতস্তত করে বলে, ‘উমম…হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি।’ কিন্তু এটা তাঁদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। ভিডিও দেখায় সে ‘ঝামেলা’ নেই।
ইউটিউবে ‘ভিউ’-এর সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিছু ধন্যবাদ আর বেশ কিছু কটু কথা কমেন্ট বক্সে জমা হলো। এক মায়ের লেখা চিঠি ছিল মনে রাখার মতো। তিনি লিখেছেন, তাঁর দুই সন্তানই প্রতিবন্ধী। স্কুলের পড়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। খান একাডেমিই তাদের একমাত্র ভরসা। এই মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে প্রতি রাতে আমার এবং আমার পরিবারের জন্য প্রার্থনা করতেন। যে চাকরিটা করতাম, তাতে আর যা-ই হোক, মানুষের আশীর্বাদ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
২০০৮ সাল। চাকরিতে মনোযোগ দেওয়াই আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কী ভিডিও বানাব, আজ কে কী ‘কমেন্ট’ করল—এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে চিঠি আসত আর সেসব পড়ে আমি রোমাঞ্চিত হতাম।
একপর্যায়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম। চাকরি ছেড়ে দিয়ে খান একাডেমি নামে একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পেছনেই আমার পুরোটা সময় দেব।
যখন আপনি একটা উদ্যোগ নেবেন, দেখবেন একধরনের ভ্রান্ত আশাবাদ চেপে বসবে। আপনার মনে হবে, একটা দারুণ কিছু করছি, নিশ্চয়ই এটা পৃথিবীর বিরাট উপকারে আসবে আর অনেকেই অনুদান দিতে রাজি হবে। কিছুদিনের মধ্যেই বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। ‘আমরা আসলে এ ধরনের প্রকল্পে টাকা দিই না।’ কিংবা ‘আমাদের এ বছরের ফান্ড তো দেওয়া হয়ে গেছে।’ এসব কথা আপনাকে শুনতে হবে। কিন্তু সাত থেকে নয় মাস ধরে এগুলো শোনা সহজ না।
তত দিনে আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছে। খরচ বাড়ছে। মাঝরাতে ঘেমে-নেয়ে ঘুম ভেঙে যেত। ভাবতাম; নিজের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে এটা আমি কী করলাম? একটা ভালো ক্যারিয়ার ছেড়ে এলাম? এই প্রচণ্ড হতাশার সময়ে ১০ হাজার ডলারের একটা অনুদান পেলাম। যিনি দিয়েছিলেন, তাঁর নাম অ্যান ডোর। আমি তাঁকে ই-মেইল করলাম, ‘অ্যান তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এটাই খান একাডেমির পাওয়া সবচেয়ে বড় অনুদান। খান একাডেমি ইট-কাঠ-পাথরের স্কুল হলে তোমার নামে একটা ভবন তৈরি করা যেত!’ অ্যান আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল।
একদিন একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় আমরা বসলাম। অ্যান বলল, তুমি কী চাও?’ বললাম, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মানুষের জন্য বিনা মূল্যে উন্নত শিক্ষা। আমি তাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা চিঠিগুলো দেখালাম, সামনের দিনগুলোতে আমার পাঠক্রমের পরিকল্পনা দেখালাম। সে বলল, ‘বেশ। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন। তোমার আয়টা হবে কীভাবে?’ যতখানি গর্বের সঙ্গে বলা যায়, আমি বললাম, ‘আয়ের কথা তো ভাবছি না!’
ফেরার সময় অ্যানের কাছ থেকে একটা খুদে বার্তা পেলাম—‘যদিও আয়ের কোনো ইচ্ছে তোমার নেই। আমি তোমাকে এক লাখ ডলার উপহার দিচ্ছি।’
হুম…দিনটা দারুণ ছিল! (হাসি)
কয়েক মাস পর, আমি একটা স্কুলের বাচ্চাদের গ্রীষ্মকালীন প্রকল্পে বক্তৃতা করছিলাম। এমন সময় অ্যানের কাছ থেকে আমার মোবাইলে প্রায় পাঁচ-ছয়টা মেসেজ এল । মেসেজের সারমর্ম এই—‘আমি “অ্যাসপেন আইডিয়া ফেস্টিভ্যালে” অংশ নিতে কলরোডোতে এসেছি। মঞ্চে বিল গেটস কথা বলছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “সম্প্রতি কোন উদ্যোগ আপনাকে মুগ্ধ করেছে?” প্রশ্নের উত্তরে গত পাঁচ মিনিট ধরে সে তোমার কথা বলছে!’
জলদি কম্পিউটারে অ্যানের কথার প্রমাণ খুঁজতে শুরু করলাম। অনুষ্ঠানটার একটা ভিডিও পেলাম। দেখলাম সত্যিই তাই, বিল গেটস আমার আই কিউয়ের প্রশংসা করছেন! শুধু তা-ই নয়, তিনি বলছেন, ‘এই লোকের স্ত্রী যেদিন তাঁকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই সেটা তাঁর জন্য একটা বিশেষ দিন ছিল।’ আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বিল গেটস আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও জানেন!
মনে আছে, সে দিন রাতে খাবার টেবিলে বসে আমি আর আমার স্ত্রী বোকার মতো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, এখন আমার কী করা উচিত? আমি কি বিল গেটসকে ফোন করব? তাঁর নম্বর কি ফোন ডিরেক্টরিতে থাকে!
দুই সপ্তাহ পর যখন আমি একটা ভিডিও বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, একটা ফোন এল। ওপাশ থেকে বলা হলো, ‘হ্যালো, ল্যারি কোলেন বলছি। আমি বিল গেটসের চিফ স্টাফ। তুমি হয়তো শুনেছ, বিল তোমার একজন ভক্ত। যদি ফ্রি থাকো, একবার এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে? হয়তো আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।’ আমি ক্যালেন্ডারের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আগামী বুধবারে হতে পারে। এই ফাঁকে আমাকে নখ কাটতে হবে, কাপড় ধুতে হবে। বিল গেটসের সঙ্গে সাক্ষাৎ বলে কথা!’
হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঠিক এক বছর পর আমি গেটস ফাউন্ডেশন ও গুগলের পক্ষ থেকে চার মিলিয়ন ডলার অনুদান পেলাম। এভাবেই আমরা পরিপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠলাম। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ & প্রথম আলো
সূত্র: লাইভ ডট ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ডট ওআরজি