আমাদের ঘরে বাইরে সকল কর্মকাণ্ডে মিশে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। আমাদের আজকের এই ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলো বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য গবেষকদের অক্লান্ত গবেষণায় ফসল। যেগুলো আমরা নিত্যদিনের ভিন্ন ভিন্ন কর্মকাণ্ডগুলো সম্পাদন করাকে আরো সহজ করে তুলছে। তবে আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এইসব প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে সত্যিকারের অর্থে কোনগুলো মানব সভ্যতার বিপ্লব ঘটাতে পারে? চলুন জেনে নেয়া যাক, এমন কিছু প্রযুক্তির কথা।
১. ব্রেইন ইমপ্ল্যান্ট
পেটেন্টের পূর্ণ নাম : থ্রি ডাইমেনশনাল ইলেকট্রোড ডিভাইস
১৮০০ সনের দিকে সর্বপ্রথম চিকিৎসকরা অনুধাবন করেন, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিমুলেশনের মাধ্যমে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া ঘটিয়ে থাকে। তারও প্রায় এক শতাব্দী পর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আবিষ্কৃত হয়, মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক সিমুলেশনের মাধ্যমে রোগীর মন মেজাজ আর আচরণের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।
এই বিষয়ে ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ উতাহতে একটি পেটেন্ট জমা দেওয়া হয়। যেখানে তারা এর নাম করন করে ‘উ-তাহ এরে’ নামে। এই পেটেন্টে দেখানো হয় মস্তিষ্কে ধাতব ইলেকট্রোড ইমপ্ল্যান্ট বসানো সম্ভব। যা কিনা মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল আদান প্রদান করতে সক্ষম হবে।
তবে সেই পেটেন্ট হতে বর্তমানে টেকনোলজির আরও উন্নয়ন ঘটেছে। ব্রেইন ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে ব্যবহারকারী রোবটিক্স নিয়ন্ত্রণ, কম্পিউটারের টেক্সট টাইপ করতে পারছে। ধারণা করা হচ্ছে, অতি নিকট ভবিষ্যতে নিউরাল লেস ব্যবহার করে মস্তিষ্কের উচ্চ সংখ্যাক নিউরনের সাথে কম্পিউটারের সংযোগ ঘটানো সম্ভব হবে। ফলে আমরা কোনরূপ বাহ্যিক স্পর্শ ছাড়াই পুরোপুরি মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনার সাহায্যে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।
২. গ্রাফিন
পেটেন্টের পূর্ণ নাম : ন্যানো স্কেলড গ্রাফিন প্লেটস
গ্রাফিনের নাম আমরা সবাই কমবেশি শুনেছি। গ্রাফিন হচ্ছে এক ধরনের যৌগিক ধাতু উপাদান। যেটা কিনা কার্বনের একক লেয়ারের হানিকম্ব স্ট্রাকচারের উপর গঠিত হয়ে থাকে। এই উপাদান স্টিল থেকে ২০০ গুণ শক্তিশালি আর ভরে অত্যন্ত হালকা। এর সাথে রয়েছে অত্যধিক পরিমাণে তাপ সহনীয়তা এবং বৈদ্যুতিক পরিবহনের ক্ষমতা। গ্রাফিনের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি কম্পিউটার চিপ, উড়োজাহাজের ডানাসহ অসংখ্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
গ্রাফিন মূলত গ্রাফাইটের আকরিক থেকে তৈরি। যার সাথে পেন্সিলের শিষের বেশ মিল রয়েছে। তবে গ্রাফাইটের একটি কার্বন পরমাণুর লেয়ারকে আলাদা করা সহজ বিষয় নয়। ২০১৪ সালে আন্ড্রে জিম এবং কন্সটাটিন নোভোলোভ ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারে আঠা জাতীয় টেপের সাহায্যে এক লেয়ারের ক্রিস্টালের মত স্বচ্ছ গ্রাফিন আলাদা করতে সক্ষম হন। যে পদ্ধতির নামকরণ করা হয় ‘স্কচ টেপ মেথড’ নামে।
দ্বিমাত্রিক গ্রাফিন ধাতু আলাদা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য ২০১০ সালে তারা ফিজিক্সের উপর নোবেল প্রাইজ অর্জন করেন। তবে এই পদ্ধতি ছাড়াও ২০০৬ সালে আরেকটি পেটেন্টে এক্সফ্লোটিং পদ্ধতিতে গ্রাফিন আলাদা করার সম্ভব হয়েছিলো।
৩. ভার্চুয়াল রিয়েলিটি
পেটেন্ট পূর্ণ নাম : ভার্চুয়াল রিয়েলিটি জেনারেশন ফর ডিসপ্লেয়িং এবসট্রাক ইনফরমেশন
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট বর্তমান সময়ে গেম খেলার জন্যই বেশি জনপ্রিয় এবং পরিচিত। তবে এই আবিষ্কার গেমের খেলার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। মূলত এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো, ব্যবহারকারীকে আর্থিক তথ্য এনালাইসিস করার কাজে সহায়তা করা। পল মার্শাল ২০১৪ সালে ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি জেনারেটর’ নামে এক পেটেন্ট জমা দিয়ে থাকেন। যেখানে দেখানো হয় বিভিন্ন কন্ট্রোল ডিভাইস যেমন, ট্রাকবল অথবা স্পেবল, ইলেকট্রনিক দস্তানা, ম্যাগনেটিক পজিশন ট্রাকার, কিবোর্ড আর জয়স্টিক অথবা স্টিয়ারিং হুইলের সাহায্যে ব্যবহারকারী কম্পিউটার জেনারেটেড ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করতে পারবে।
পেটেন্ট জমা দেওয়ার পরবর্তী কয়েক বছর পল মার্শাল ত্রিমাত্রিক জগত নির্মাণের উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে তখনো তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো, একাউন্টিং আর আর্থিক বিভিন্ন কাজে এটি ব্যবহার করা। গেমিংয়ের জন্য ২০১৬ সনে অকাল্ট রিফট তাদের হেডসেটটি বাজারে ছাড়ার পরপর ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটে।
এর খুব স্বল্প সময় পরেই এইচটিসি বাজারে নিয়ে আসে এইচটিসি ভাইব। এরপর ধীরে ধীরে দেখা মেলে বিভিন্ন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিস্টেমের। যেমন, স্যামসাং ভিআর অথবা গুগল কাপবোর্ড। যেগুলো মোবাইলের সাহায্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রদান করতে পারে। তবে বর্তমানের এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তির মধ্যে ‘মাইক্রোসফট হলো লেন্সের’ কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ধারণা করা হচ্ছে, আর্গুমেন্ট রিয়েলিটির এই ডিভাইসটি নিকট ভবিষ্যতে সিভিল কন্সট্রাকশন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাধর্মী কাজে ব্যবহার হবে।
৪. সিআরআইএসপিআর জিন এডিটিং
পেটেন্টের পূর্ণ নাম : সিআরআইএসপিআর ক্যাস সিস্টেমস এন্ড মেথড ফর অল্টারিং এক্সপ্রেশন অফ জিন প্রোডাক্টস
সিআরআইএসপিআর – ক্যাস ৯ মূলত একটি জেনেটিক পরিবর্তনকারী একটি টুলস, যা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে ডেভেলপ করা হয়েছে। শুরুতে এই টুলসটি শুধুমাত্র সিঙ্গেল সেল অর্গানিজমের উপর কাজ করতে পারতো। পরবর্তীতে ব্রড ইন্সটিটিউট, হাভার্ড আর এমআইটির সাথে মিলিতভাবে গবেষণা শুরু করে এবং একাধিক সেল বিশিষ্ট অর্গানিজম পরিবর্তন করার মতো প্রযুক্তি নির্মাণের প্রচেষ্টা চালায়।
যার হাত ধরে ২০১৪ সালে এই পেটেন্টটির দেখা মেলে। এটি বর্তমানে খাদ্য শস্যের জিনেটিক পরিবর্তন ও উৎপাদন এবং লিউকেমিয়ার রোগীদের চিকিৎসা কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সিআরআইএসপিআর – ক্যাস ৯ টুলসটি তিন স্তরে কাজ করে থাকে। প্রথমে আরএনএ অর্গানিজমের ডিএনএর নির্দিষ্ট সেকশনকে খুঁজে বের করে। এরপর ক্যাস ৯ এনজাইম ডিএনএর সেগমেন্টটিকে আলাদা করে বের করে নিয়ে আসে। তারপর পরিবর্তিত ডিএনএকে সেই খালি স্থানটিতে প্রবেশ করায়।
সিআরআইএসপিআর মাতৃভ্রূণ অথবা শরীরের ইমিউন সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এছাড়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালি মেডিসিন তৈরি করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশু জন্মের পূর্বেই ভ্রুণে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে মানবদেহের অসংখ্য সম্ভাব্য শারীরিক রোগ দূর করা সম্ভব হবে।