বিসিএস পরীক্ষার জন্য কীভাবে পড়বেন, এটি যারা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, তাদের জন্য এই পোস্ট!
১. প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য যত সহজ চিন্তা করবেন, প্রস্তুতিও তত সহজ হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য যত বেশী জটিল চিন্তা করবেন , প্রস্তুতি নেওয়াও তত কঠিন হবে। পরিকল্পনা করে পড়ুন; নিজে নিজেই সাজেশন তৈরি করুন।
২. প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে MCQ প্রশ্ন পড়ার জন্য চেষ্টা করবেন না। এতে আপনি সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। কারণ যতক্ষণ আপনি ফেসবুকে থাকবেন ততক্ষণ যদি বই থেকে পড়েন তাহলে ৫০টি প্রশ্ন বেশি শিখতে পারবেন। আবার কোনো ধরণের সফটওয়্যার কিনে কম্পিউটার থেকে পড়ার চেষ্টা করবেন না। এ পদ্ধতিও আপনার সময় নষ্ট করবে।
৩. পরীক্ষার হলে পাশের পরীক্ষার্থীর সাথে ভাব করবেন না। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যা সঠিক উত্তর পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশী ভুল উত্তর পাওয়া যায় পাশের জনের কাছ থেকে যা ফেল করার জন্য যথেষ্ট ! ৩৩তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় আমার সামনে এক পরীক্ষার্থী বসেছিলেন, যথারীতি আমার সাথে খাতির ও করেছেন, আমি বিষয়টা বুঝতে পারলাম কেন খাতির করছেন। তাঁকে প্রশ্ন করলাম আপনি কোন বিষয় থেকে পাশ করেছেন? তার উত্তর বাংলা বিষয় থেকে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি কথা বলা শুরু করে দিলেন। আমিও তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য বাংলার কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম ! তিনি সব উত্তরই ভুল বলেছিলেন! একটা বিষয় মনে রাখবেন, আপনি অনেক পরিশ্রম করে একটি প্রশ্ন কমন পেলেন, দেখা গেল ওই প্রশ্নটি কমন পাওয়ার জন্য আপনি ঠিক দুই সপ্তাহ পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু পরীক্ষার হলে আপনার পাতানো বন্ধুর দুটি ভুল উত্তর দেওয়ার জন্য আপনি নেগেটিভ মার্ক হিসেবে এক মার্ক কম পেলেন। সবশেষে ধুরুন কাট মার্ক থেকে আপনি এক মার্ক কম পাওয়ার কারণে আপনি প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করলেন না!
৪.পরীক্ষায় কোনো অজানা উত্তর দিবেন না। প্রিলিমিনারিতে মনে রাখতে হবে যা পারি না তা পূরণ করব না। কারণ লোভে ভুল, ভুলে ফেল। একবার আন্দাজে পূরণ করা শুরু করলে সব পূরণ করার লোভ সামলানো যায় না।
৫. আমার অনেক বন্ধুকে দেখি তাঁরা বিসিএস এর প্রস্তুতির জন্য সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকে, কিন্তু পরিকল্পনা করে পড়া বা প্রস্তুতি নেয় না। যার ফলে প্রস্তুতিও শেষ হয় না। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষ করার একটি উপায় হচ্ছে একটি বিষয় কয়েক দিন ধরে পড়া, অর্থাৎ প্রথমে একটি কাগজে নোট করবেন কি কি আপনি পারেন না। সেগুলো ১ ২ ৩ ৪ …… করে সিরিয়াল করে লিখে টেবিলের সামনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিবেন। তারপর পড়া শুরু করে দিবেন। যে অধ্যায় আপনি শেষ করে ফেলবেন সেই অধ্যায় ক্রস করে দিবেন। দেখবেন কেমন আত্মতৃপ্তি পান। আমি তো আমার রুমের দরজা থেকে শুরু করে টেবিলের সামনের দেওয়াল সব খানে আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে রাখতাম। এখনো তার কয়েকটি ঝুলে আছে ।
প্রশ্নের মান বণ্টন:
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য- ৩৫
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য- ৩৫
বাংলাদেশ বিষয়াবলি- ৩০
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি- ২০
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব)
পরিবেশ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা- ১০
সাধারণ বিজ্ঞান-১৫
কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি- ১৫
গাণিতিক যুক্তি- ১৫
মানসিক দক্ষতা- ১৫
নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন- ১০
মোট=২০০ নম্বর ।
কিভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন?
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য সহজ চিন্তা করুন, প্রস্তুতিও তত সহজ হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য যত বেশী জটিল চিন্তা করবেন , প্রস্তুতি নেওয়াও তত কঠিন হবে। পরিকল্পনা করে পড়ুন, নিজস্ব সাজেশন করুন প্রিলিমিনারি পাস নিশ্চিত। আপনাকে পাস করার জন্য ১২০ থেকে ১৩০ নম্বর পেতে হবে। অনেকেই মনে করছেন এত কম নম্বর? এই নম্বর তো সবাই পাবে! না ১২০ থেকে ১৩০ কোনো সহজ নম্বর নয়। এই রেঞ্জের মার্ক ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার জন পাবে। অর্থাৎ অনেকেই ১৩০ পর্যন্ত নম্বর পাবে কিন্তু তারা নেগেটিভ নম্বরের কারণে ১০০ মার্কের নিচে চলে যাবে।
হাতে আর বেশি সময় নেই। তাই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আপনাকে পরিকল্পনা করে পড়তে হবে এবং সব থেকে কম সময়ে বেশি বিষয় আত্মস্থ করতে হবে। আর যে বিষয়গুলো চেনা জানা সেই বিষয়গুলো আগে শেষ করতে হবে। আমার দৃষ্টিকোন থেকে কোন কোন বিষয় আগে প্রস্তুতি নিবেন তা নিন্মে সিরিয়াল অনুযায়ী উল্লেখ করলাম।
১) সাধারণ বিজ্ঞান-১৫
২) কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি- ১৫
৩) বাংলাদেশ বিষয়াবলি- ৩০
৪) আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি- ২০
৫) গণিতিক যুক্তি- ১৫, মানসিক দক্ষতা- ১৫
৬) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য- ৩৫
৭) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য- ৩৫
৮) ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা- ১০
৯) নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন- ১০
সাধারণ বিজ্ঞান: আমার মতে আপনি বিজ্ঞান বিষয় প্রথমে পড়া শুরু করবেন। এই বিষয় থেকে আপনি ১৫ মার্ক কমন পাবেন। আর এই বিষয়ের প্রশ্ন হুবহু কমন আসে। বিজ্ঞান বিষয় পড়ার জন্য বোকার মতো সব শ্রেণির বই মুখস্ত করার দরকার নেই, যেখানে রেডিমেট প্রশ্ন ও উত্তর পাওয়া যায় সেখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি: কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি এই বিষয়ের নামটা দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই বিষয়টা অত্যন্ত সহজ ও মজার। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ওপর যেসব প্রশ্ন এসেছে শুধু সেসব প্রশ্নই পড়বেন, এর বাইরে পড়ার প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি: বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এতে ৪৫ মার্ক পর্যন্ত কমন পাওয়া সম্ভব। এ জন্য আপনাকে একটু পরিকল্পনা করে পড়তে হবে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর জন্য ‘আজকের বিশ্ব’ বা ‘নতুন বিশ্ব’ এই জাতীয় বই না পড়ে বরং জব সল্যুশন থেকে সব নোট করে পড়তে পারেন। কারণ আজকের বিশ্ব বা নতুন বিশ্ব এই সব বইয়ের মধ্যে যত তথ্য আছে তা আপনি মুখস্ত করে ধরে রাখতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা জব সল্যুশন থেকে নোট করে পড়েছেন তাঁরা সবচেয়ে বেশী সঠিক উত্তর দিয়েছেন। কারণ আপনি যখন জব সল্যুশন পড়বেন তখন আপনি নিজেই আবিষ্কার করে ফেলবেন কিভাবে প্রশ্ন করে আর কোন ধরনের প্রশ্ন পরীক্ষায় বারবার আসে। আপনি জব সল্যুশন যখন পড়বেন তখন নোট করুন আর উত্তরটা খাতার একদম ডান পাসে লিখে স্কেল দিয়ে ঢাকনা দিয়ে রিভিশন দিন।
জব সল্যুশন থেকে কীভাবে নোট করবেন? জব সলুশন পড়ার সময় বিষয় অনুযায়ী নোট করুন। যেমন যখন বিজ্ঞান পড়বেন তখন প্রথম থেকেই জব সল্যুশন এর শুধু বিজ্ঞানের প্রত্যেকটা প্রশ্ন উত্তর এক লাইনে লিখবেন। আবার যখন ওই প্রশ্নটা রিপিট পাবেন তা আর লিখতে হবে না। এভাবে পুরো বিজ্ঞানটা একটা খাতায় ক্রমিক নং অনুযায়ী ১,২,৩,৪…… করে নোট করে নিন। এরপর জব সলুশন না খুলে শুধু ওই খাতাটা পড়বেন। এতে করে বারবার জব সলুশন এর পৃষ্ঠা উল্টানো লাগবে না। আর খুব সহজেই কয়েক দিনের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারবেন। এভাবে সব বিষয় নোট করবেন, এতে করে আপনি নিজেই নিজের জন্য প্রিলিমিনারি ডাইজেস্ট তৈরি করে নিতে পারেন। সাধারণ জ্ঞান এর জন্য দেখুন: জব সলুশন, ১০ম থেকে ৩৪ বিসিএস এর প্রশ্ন এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স। (পুনশ্চ: জব সল্যুশন থেকে পড়তে হবে ১৯৯৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সকল ক্যাডার ও নন ক্যাডার প্রশ্ন। অর্থাৎ শুধু বিসিএস নয়, সকল পরীক্ষার প্রশ্ন দেখতে হবে।)
গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা: এই বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আপনি গণিত বই চ্যাপ্টার অনুযায়ী সমাধান করবেন। তাহলে আপনি গণিতের প্রশ্নের ধরণটা খুব সহজেই আবিষ্কার করতে পারবেন, বুঝতে পারবেন গণিত প্রশ্ন কীভাবে হয়। গণিতে ভালো করার জন্য ক্যালকুলেটরের ব্যাবহার ভালো করে অনুশীলন করে রাখুন। ১০ ডিজিটের সাধারণ ক্যালকুলেটর। কারণ অনেকেই Scientific ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করতে করতে সাধারণ ক্যালকুলেটরে ভুল করেন। গাণিতিক যুক্তি বিষয়ের জন্য দেখুন অ্যাসিওরেন্স এর গণিত ও মানসিক দক্ষতা। আরেকটি বই কিনতে পারেন শর্টকাট ফরমুলা শেখার জন্য। তা হলো এক্সক্লুসিভ ম্যাথ, মধুমতি প্রকাশনীর।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য: এই বিষয়ের জন্য একটু কষ্ট করতে হবে, কারণ এই বিষয়ে ভুল করার বা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেশী। এই দুই মাসে ভালো প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সহজ পন্থা হচ্ছে জব সল্যুশন থেকে নোট করে পড়তে হবে ১৯৯৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সকল ক্যাডার ও নন ক্যাডার প্রশ্ন। অর্থাৎ শুধু বিসিএস নয় সকল পরীক্ষার প্রশ্ন দেখতে হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য অনেকেই বাংলার উপন্যাস, কবিতা, ইত্যাদি জন্য সৌমিত্র শেখরের সাহিত্য জিজ্ঞাসা পড়েন এটি আমি সমর্থন করি না। কারণ এক সময় সৌমিত্র শেখরের সাহিত্য জিজ্ঞাসা আমি পুরো মুখস্ত করেছিলাম এতে করে পরীক্ষার সময় মাথা কাজ করে না কারণ মাথায় তখন অনেক উত্তর ঘুর ঘুর করে, যেমন উত্তর কি এইটা না ওইটা! সৌমিত্র শেখরের সাহিত্য জিজ্ঞাসা হচ্ছে একধরনের ডিকশনারী। এতে প্রত্যেক লেখকের প্রায় সব সাহিত্যকর্মের নাম ও সাল দেওয়া আছে। যা আপনার গবেষণা বা লেখালেখিতে সহায়তা করবে, কিন্তু প্রিলিমিনারি পরীক্ষা কারো পাণ্ডিত্য দেখানোর জায়গা নয়। আপনার দরকার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস, আর পাস করার জন্য দরকার সবচেয়ে বেশী প্রশ্ন কমন পাওয়া ও সঠিক উত্তর দেওয়া। আর আপনি প্রশ্ন কমন পেলেন কিন্তু বিভ্রান্ত হয়ে ভুল উত্তর দিলেন বা দিতে পারলেন না তা হলে সৌমিত্র শেখরের সাহিত্য জিজ্ঞাসা পড়ে কি লাভ?
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য: ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের জন্য একমাত্র পরামর্শ হচ্ছে English for competitive exam।এই বই থেকে প্রায় সব কমন পাবেন। বিশেষ করে রিয়েল প্রশ্ন একটিও বাদ দিবেন না। বাকি থাকল ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন। এখানে মোট মার্ক হচ্ছে ২০। এই বিষয় দুইটা যেহেতু নতুন সেহেতু এগুলো আপনার কমন সেন্সের ওপর ছেড়ে দিন। আর এই ২০ মার্ক এ কি আসবে বা কি আসবে না তা নিয়ে চিন্তা না করে বাকি ১৮০ মার্ক নিয়ে চিন্তা করুন। বোকার মত ২০ মার্কের জন্য ২ মাস অনিশ্চিত পড়ালেখা করার কোনো মানে হয় না। সবার প্রস্তুতি সফল হোক।
Courtesy:এনামুল হাছান-আল-নোমান, সহকারী কর কমিশনার, ৩৩তম বিসিএস।