বিসিএস : প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির টিপস -২

অনেকেই জানেন যে বিসিএস পরীক্ষার মূল ধাপ তিনটি: প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক। প্রথমেই পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপের প্রতিটি বিষয়ের সিলেবাস এবং প্রশ্নের ধরন জানা জরুরি। গোছানো প্রস্তুতির জন্য গাইড বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রিলিমিনারি’র জন্য কিনেছিলাম মূলত ‘ওরাকল’ এবং পাশাপাশি ‘পাঞ্জেরী’-র বই। লিখিত পরীক্ষার জন্য কিনেছিলাম প্রফেসর’স সিরিজের বই। ‘গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা’র জন্য ‘ওরাকল’-এর বইটিও সংগ্রহ করেছিলাম। তবে কোনো কোচিং সেন্টারে যাইনি। কারণ সেই সময়ই ছিল না

বাংলা ভাষার ও সাহিত্য অংশটি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। বাংলা সাহিত্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস, কবি/সাহিত্যিকদের জীবন বা তাঁদের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে এত বিশদভাবে জানার সুযোগ জীবনে হয়তো আর হবে না, এমনটি ভেবেই পড়েছি। তবে সাহিত্যের প্রতি যাদের আগ্রহ কম, তাদের কাছে বাংলা সবচেয়ে জটিল মনে হতে পারে! আর প্রবন্ধ রচনা/চিঠিপত্র/সারাংশের ক্ষেত্রে নিজস্ব কিছু ফরম্যাট করে ফেলেছিলাম। চাইলে আপনারাও করতে পারেন।

‘গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা’ এবং ‘ইংরেজি’ আমি নিয়মিত অল্প হলেও করেছি/পড়েছি। শেষের দিকে অবশ্য পুরো সিলেবাস শেষ হওয়ার পর টানা ৭ দিন শুধু গণিত অথবা টানা ৭ দিন শুধু ইংরেজি রিভিশন দিয়েছি। গণিতের ক্ষেত্রে বিগত অন্তত ১০ বছর বিসিএস পরীক্ষাতে আসা প্রশ্নের সমাধান নিজে বুঝে করতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কারণ সাধারণত গণিতের ক্ষেত্রে প্রশ্নের একটি নির্দিষ্ট ধাঁচ লক্ষ্য করা যায়। আর ইংরেজির ক্ষেত্রে Phrases & Idioms, Appropriate Prepositions, Proverbs ইত্যাদি বিষয়গুলো দুই-একদিনে পড়তে চাইলে কিছুই হয় না। এগুলোর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা! তবে স্কুলেজীবনে যারা অংক-ইংরেজিতে ভালো ছিলেন, তাদের প্রিপারেশন নিতে কোনো কষ্টই হওয়ার কথা না।

বাংলাদেশ বিষয়াবলী এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর জন্য গাইড বই লাগবেই! এছাড়াও আমি নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র পড়েছি। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একদিন অফিসের কিচেনে বসে পেপার পড়ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, এক আপু হাঁ করে আমার পেপার পড়া দেখছেন! আমি তাকাতেই তিনি বললেন, ‘ভাইয়া, আমি কখনো মানুষকে এভাবে পেপার মুখস্থ করতে দেখিনি।’ বুঝতেই পারছেন, পেপার পড়ার সময়ই গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো মাথায় ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি পড়েছি প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স। বাসায় ফিরে সেদিনের পেপারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আলাদা খাতায় তুলে রাখতাম যাতে লিখিত পরীক্ষার বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তরগুলো সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ করতে পারি। আমি বিশেষ করে এই দুইটি বিষয়ের সব প্রশ্নের উত্তরই পয়েন্ট আকারে লিখেছি। এতে পরিচ্ছন্নভাবে নিজের বক্তব্য/যুক্তি তুলে ধরা যায়। আমি বিশ্বাস করি, এতে নম্বরও বেশি পাওয়া যায়!
বাংলাদেশ বিষয়াবলী (২য় পত্র)-এর জন্য বাংলাদেশের সংবিধান মুখস্থ করতে হয়েছে! এটি বেশ কষ্টসাধ্য এবং দীর্ঘ সাধনার বিষয়।
ভাইভার জন্য সংবাদপত্রের পাশাপাশি বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার এবং বিবিসি বাংলার খবর শোনাও জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে, সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই যেন মিস না হয়! এখন অবশ্য মিস হওয়ার চান্স কম; কারণ ফেসবুক আছে না বিসিএস সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপগুলোতে যুক্ত থাকুন।

সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্ন একটি নির্দিষ্ট ধাঁচের হয়। তাই বিগত সব বছরের প্রশ্ন দেখে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নেরও একটি ধাঁচ থাকলেও প্রশ্ন পুরোপুরি মেলে না। তবে বিগত বছরগুলোর প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত জানা থাকলে ৫০-৬০% উত্তর করা সম্ভব। আরও বেশি নম্বর পেতে হলে খাটাখাটনি একটু বেশি তো করতেই হবে।

আর আমার মতো কেউ টেকনিক্যাল ক্যাডারেও পরীক্ষা দিলে তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের মহাসমুদ্র পাড়ি দিতে হবে

বিসিএস প্রস্তুতির বিশেষ টিপস

১. আন্দাজে উত্তর করা যাবে না

যে বিষয় সহজ মনে হয়, সেটি সবার আগে উত্তর করতে হবে। প্রথমে জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর করতে হবে। কঠিন কোনো প্রশ্ন নিয়ে সময় নষ্ট না করে পরের প্রশ্নে চলে যেতে হবে। আন্দাজে কোনো প্রশ্নের উত্তর করাটা হবে বোকামি। তবে ৭০টি প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত জানা থাকলে ধারণার ওপর ভিত্তি করে বড়জোর আরো ১০টি উত্তর করা যেতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই ২০টি নয়। আমার পরিচিত অনেকে প্রিলিমিনারি থেকে বাদ পড়েছে অনুমানের ওপর উত্তর করতে গিয়ে।

২. বাংলা
সাহিত্য ও ব্যাকরণ_দুটি অংশেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে

প্রথমেই বলে নিই, প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। ভালো করতে চাইলে কোনো কিছুই বাদ দেওয়া যাবে না। শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে। বর্ণমালা থেকে শুরু করে ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা অনেক বিষয়ও কাজে আসবে। পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণ এবং ভাষা ও সাহিত্য থেকে প্রশ্ন আসে। প্রশ্ন করার সময় দুটি অংশকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যাকরণ অংশে ষত্ববিধান, ণত্ববিধান, কারক ও বিভক্তি, উপসর্গ, সমাস, বাক্য ও বাক্যের অংশ, পদ, সমার্থক ও বিপরীত শব্দ, বিদেশি ভাষার শব্দ এবং বানান থেকে প্রশ্ন আসে। পরীক্ষার হলে এসব বিষয়ে ভালো ধারণা নিয়ে যেতে হবে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অংশে ভালো করতে চাইলে ভাষার উৎপত্তি বা ইতিহাস, প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সময়কাল, বিখ্যাত রচনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। প্রাচীন যুগ থেকে প্রায় প্রতিবছরই দুই-তিনটি প্রশ্ন থাকে। প্রাচীন যুগের অন্যতম নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কার, আবিষ্কারকাল, আবিষ্কারস্থান, পদ রচয়িতা এসব নানা বিষয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। মধ্যযুগের বিখ্যাত রচনা, বিভিন্ন কাব্যের চরিত্র থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের জীবনকাল ও রচনা এবং বইয়ের বিখ্যাত উক্তি বা পঙ্ক্তিও জানতে হবে।
বাজারে প্রচলিত বইয়ে অনেক ভুল থাকে। এ ক্ষেত্রে বোর্ডের বই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রণীত বই অনুসরণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, মাথায় কোনোক্রমেই ভুল তথ্য রাখা যাবে না।

৩. সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিগত বছরের প্রশ্ন থেকেও অনেক প্রশ্ন কমন পড়তে পারে

সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অংশে পদার্থ ও রসায়ন থেকেই বেশি প্রশ্ন আসে। গত তিন বছরের বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে এমনটিই দেখা গেছে। এ ছাড়া জীববিদ্যা, কৃষি, ভূগোল থেকে দু-একটি করে প্রশ্ন আসে। পদার্থ ও রসায়নে বেসিক ভালো হলেই চলে না, কারণ বেশির ভাগ প্রশ্ন আসে প্রয়োগিক বিষয়ে। এ সময়টাতে গুরুত্ব বুঝে বইয়ের প্রয়োগিক বিষয়গুলো দাগিয়ে পড়লে তা পরীক্ষায় বেশ কাজে দেবে।
নবম-দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ের পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত ভালো মানের কোনো বই সহায়ক হতে পারে। শেষ সময়টাতে বিগত বছরের বিসিএস ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আসা বিজ্ঞানের প্রশ্ন বারবার দেখতে হবে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রশ্নে মনে হতে পারে চারটি উত্তরই সঠিক। এ ক্ষেত্রে বেশিক্ষণ চিন্তা না করে পরের প্রশ্নে চলে যেতে হবে। এ ছাড়া কিছু কিছু প্রশ্ন থাকে, যা অনেক প্রার্থীরই জানাশোনার বাইরে থাকে। বিজ্ঞানের সব প্রশ্নের উত্তর করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কোনো বিষয়ে ধারণা না থাকলে সেটি বাদ দিয়ে যাওয়াই উচিত হবে।
বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় বিগত বছরগুলোতে আসা সমাধান করলে সেটি প্রিলিমিনারির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় আগের আসা প্রশ্ন অনেক ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি হয়। তাই বিগত বছরের প্রশ্নগুলোর অনুশীলন করলে সেখান থেকেও প্রশ্ন কমন পড়তে পারে।

৪. সাধারণ জ্ঞান
বিশ্বের সমকালীন রাজনৈতিক ইস্যু থেকে প্রশ্ন আসতে পারে

লিখিত পরীক্ষার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার, প্রিলিমিনারির জন্য সেভাবে প্রস্তুতি নিলে কোনো বিষয়ে ব্যাপক ধারণা তৈরি হয়। এটি সম্ভব হলে সাধারণ জ্ঞান বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। আগের মতো এখন কেবল বহুনির্বাচনী প্রশ্ন পড়লেই চলে না, বিষয়ের গভীর থেকেও অনেক প্রশ্ন করা হয়। সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে শেষ সময়ের প্রস্তুতি বলে তেমন কিছু নেই। তবে এ সময়টাতে আগের পড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বারবার চোখ রাখলে পরীক্ষায় উত্তর শনাক্ত করা সহজ হবে।
সাধারণ জ্ঞানে প্রশ্ন করা হবে বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি থেকে। এ দুটি অংশেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে বিভিন্ন শাসনামল, বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, রাজনীতি, ভূগোল_এসব নানা বিষয় থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে দেশ ও মহাদেশ, রাজধানী, মুদ্রা, দীর্ঘতম, বৃহত্তম, ক্ষুদ্রতম_এসব নানা বিষয় থেকে প্রশ্ন থাকে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ (যেমন, কিছুদিন আগে জাপানে ঘটে যাওয়া সুনামি) থেকে প্রশ্ন আসতে পারে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট এ বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, স্বাভাবিকভাবে এখান থেকে প্রশ্ন আসার একটি সম্ভাবনা আছে। বিশ্বের সমকালীন রাজনীতি বা আলোচিত ইস্যু থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার আলোচিত দেশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে হবে।

৫. গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা
কম সময়ে সমাধান করার কৌশল আয়ত্ত করতে হবে

বিগত তিন বছরের বিসিএসের প্রশ্ন দেখলে বোঝা যাবে, একেকবার একেক রকম প্রশ্ন হয়েছে। গণিতে সাধারণত ১০টি করে প্রশ্ন এলেও ৩০তম বিসিএসে এ বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০টি। গণিতে যারা দুর্বল, এক ঘণ্টায় তাদের জন্য অন্য বিষয়গুলো কভার করে গণিতের ২০টি প্রশ্নের উত্তর করা কঠিনই বটে। আর গণিত কমন পড়ার কোনো বিষয় নয়। তাই কম সময়ে গণিতের সমাধান করার কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। চর্চাটা করতে হবে বেশি বেশি।

 

সংগৃহীত

Youth Carnival: