বিসিএস ভাইভায় সাধারণত দুই ধরনের উপাদান প্রভাবিত করে থাকে। একটি হলো নির্দিষ্ট উপাদান, যাতে আপনার খুব বেশি হাত থাকে না। যেমন আপনার নাম, জেলা, বিষয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অর্জিত একাডেমিক ফলাফল ইত্যাদি। অর্থাৎ আপনি চাইলেও এই বিষয়গুলো এখন পরিবর্তন করতে পারবেন না। একটা উদাহরণ এমন, যাঁর বাড়ি গাজীপুর জেলায়, তাঁকে বোর্ড হয়তো তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে। অন্যটি হলো অনির্দিষ্ট উপাদান যেগুলোর ওপর আপনার সরাসরি হাত আছে, যা আপনি একটি ভালো প্রস্তুতি নিয়ে একটা উচ্চতর স্থানে নিয়ে যেতে পারেন। যেমন আপনার একাডেমিক জ্ঞান, নিজ জেলার তথ্য, সাধারণ জ্ঞান, কমনসেন্স, স্মার্টনেস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। এই অংশটির পরিধি অনেক বড় এবং অনেক কিছু পড়ার থাকে। আসলে ভাইভায় কোন ধরনের প্রশ্ন হবে, তার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে বোর্ডের ওপর নির্ভর করে। তবে অসাধারণ একটা প্রস্তুতি নেওয়ার পর আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ভাইভায় আমরা কী পড়ব এবং কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত ও উপস্থাপন করব, সে বিষয়ে বলা যেতে পারে।
ক) ভাইভায় সাধারণত ছয়টি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যথা (অ) নিজ জেলা (আ) নিজ পঠিত বিষয় (ই) মুক্তিযুদ্ধ (ঈ) প্রথম পছন্দ (উ) সংবিধান (ঊ) সাম্প্রতিক বিষয়াবলি। এই বিষয়গুলো জোর দিয়ে পড়বেন। খ) প্রশ্নগুলো সাধারণত ইংরেজিতে করার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক বোর্ড কিছু প্রশ্ন বাংলায় করতে পারে। তবে আপনাকে ইংরেজি বলার সক্ষমতা যতটা সম্ভব তৈরি করতে হবে।
গ) ইংরেজি বলার জন্য এখন থেকেই চেষ্টা ও অনুশীলন করতে হবে। কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। যথা (অ) প্রতিটি শব্দের ইংরেজি টার্ম পড়ার সময়ই জেনে নিতে হবে। (আ) বন্ধুদের সঙ্গে ইংরেজির চর্চা করতে হবে। (ই) মাঝে মাঝে একা একাই বলুন। (ঈ) বাংলায় পড়লেও তার ইংরেজি কী হতে পারে, তা মনে মনে সাজান। আপনার ইংরেজি শতভাগ শুদ্ধ হতে হবে এমন নয়। বোঝাতে পারলেই হবে। সুতরাং ভয়ের কারণ নেই।
ঘ) যদি ইংরেজিতে বেশি ভয় থাকে, তবে ঢোকার সময় অনুমতি বাংলায় চাইবেন। এতে কিছুটা রক্ষা হতে পারে।
ঙ) কিছু প্রশ্ন নিজের মতো করে ইংরেজিতে সাজিয়ে নেবেন। যেমন নিজ পরিচয়, পরিবার, জেলা, কেন বিসিএস দিচ্ছেন, প্রথম পছন্দ এটি কেন, নিজ বিষয় ও প্রথম পছন্দের সম্পর্ক, বর্তমানে কী করেন, শখ, শৈশব, হল জীবন ইত্যাদি। তবে বলার সময় টানা মুখস্থ বলবেন না।
চ) বোর্ড আপনার প্রতি রুক্ষ আচরণ করবে বা আপনাকে বকা দেবে, এ ধরনের চিন্তা ভুলেও মনে আনবেন না। এগুলো মোটেও সঠিক কথা নয়। নিজের আত্মবিশ্বাসকে ছোট করবেন না।
ছ) শতভাগ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে এমন নয়। তবে সাধারণ বিষয় বা যা জানা প্রয়োজন ছিল, তা না পারলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জ) উত্তর জানা না থাকলে বিনয়ের সঙ্গে সরি বা দুঃখিত বলবেন। চুপ করে থাকবেন না।
ঝ) যিনি প্রশ্ন করবেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন।
ঞ) আপনার প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ সম্পর্কে ভালো করে জেনে যাবেন। আর নিজ বিষয় চয়েস তালিকায় না থাকলেও অবশ্যই পড়বেন।
ট) নিজ বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিষয়গুলোই বেশি জিজ্ঞাসা করা হয়ে থাকে। তাই এ জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের বইগুলো একটু দেখবেন। সম্ভব হলে শিক্ষক নিবন্ধনের প্রযোজ্য গাইডটি সংগ্রহ করবেন।
ঠ) বাজার থেকে আপনার প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দের যেকোনো গাইড সংগ্রহ করে নেবেন।
ড) বিপিএসসি সম্পর্কে খুব ভালো করে জেনে যাবেন। তাদের ওয়েবসাইটে সব আছে। পারলে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্পর্কেও ভালো করে জানবেন। তাদের ছবিগুলো মাঝে মাঝে দেখবেন। এতে ভয় কিছুটা কেটে যাবে।
ঢ) ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিক ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা থাকা চাই। মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক দিকগুলোও একটু দেখবেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন কী ছিল ইত্যাদি। এ জন্য ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেনের বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১ বইটি পড়া যায়।
ণ) সংবিধান গুরুত্ব দিয়ে পড়বেন। বিশেষ করে এক থেকে সাতচল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদ ভালো করে পড়বেন। আরেকটা কথা, বলার সময় হুবহু সংবিধানের ভাষায় বলতে হবে বিষয়টি এমন নয়। আপনার ভাষায় বলবেন।
ত) কিছু অভ্যাস করতে পারেন। যথা (অ) আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে কথা বলে দেখবেন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক আছে কি না। (আ) বাংলা ও ইংরেজি শুদ্ধ উচ্চারণ করুন। (ই) ফরমাল পোশাক ট্রায়াল দিতে পারেন, যদি অভ্যাস না থাকে। (ঈ) নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ুন। থ) বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ পড়ে নেবেন। যেমন অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইত্যাদি।
দ) বর্তমান বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য জানবেন। সম্ভব হলে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিবদের নাম জানবেন।
ধ) অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ থেকে বাছাই করে বেশ কিছু তথ্য জেনে নেবেন।
ন) যেদিন ভাইভা, সেদিন পত্রিকা অবশ্যই পড়ে যাবেন। সম্ভব হলে তিনটা পড়বেন এবং ওই দিনের বাংলা, ইংরেজি ও আরবি তারিখ জেনে নেবেন।
প) কিছু টপিকস ভালো করে দেখবেন। যেমন প্রশাসনসংক্রান্ত প্রশ্ন, অর্থনীতিসংক্রান্ত প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধসম্পর্কিত কবিতা ও গান, বাংলা ও ইংরেজি বানান, স্থানীয় সরকার, কিছু আইনের প্রাথমিক তথ্য, রাজনৈতিক কিছু তথ্য ইত্যাদি।
ফ) বাংলাদেশ ও বিশ্ব মানচিত্র সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে যাবেন। বিশেষ করে যার আয়তন যত ছোট তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বুঝতেই পারছেন কেন!
ব) প্রশাসন ও পুলিশ যাদের প্রথম পছন্দ, তারা সিআরপিসি, সিপিসি, পেনাল কোড, মোবাইল কোর্ট আইন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে যাবেন।
ভ) ক্যাডার চয়েসের তালিকার ক্রম মনে রাখবেন। অনেক সময় কত নম্বরে কোন ক্যাডার চয়েস দিয়েছেন জিজ্ঞাসা করে।
ম) ভাইভা শেষ হয়ে গেলে মনে করে আপনার কাগজগুলো ফেরত নিয়ে আসবেন। উঠে হাঁটা শুরু করবেন না।
এভাবে পড়াশোনা ও নিজেকে প্রস্তুত করুন। আশা করি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আর তাতেই ভাইভা ভালো হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, ক্যাডার পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো আপনার হাতে অনেক কিছু করার আছে, যেটা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই আন্তরিকভাবে প্রস্তুতি নিন।
লেখক: শাহ মো. সজীব, প্রশাসন ক্যাডার (২য় স্থান), ৩৪তম বিসিএস