ব্রাজিল-বেলজিয়াম ফাইনালের আগে ফাইনাল ম্যাচ: এক রোমাঞ্চকর অপেক্ষা
বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ এর কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ডে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ব্রাজিল ও বেলজিয়াম। দুর্দান্ত ফর্মে আছে দুই দলই। একদিকে সাম্বা ফুটবলের শৈল্পিক সৌন্দর্য তো অন্যদিকে বেলজিয়ামের ধ্রুপদী আক্রমণাত্মক ফুটবল। এক দিকে রয়েছেন নেইমার, কৌতিনহো, উইলিয়ান, গ্যাব্রিয়েল জেসুস। অন্যদিকে আছেন এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইন, লুকাকু, মার্টিন্সরা। কোচ টিটে ফিরিয়ে এনেছেন ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবলকে। অন্যদিকে রবার্তো মার্টিন্সের অধীনে বেলজিয়াম বর্তমানে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার সৌন্দর্য উপহার দিচ্ছে ফুটবল প্রেমীদের। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে যথাক্রমে ২ ও ৩ নং দল ব্রাজিল আর বেলজিয়ামের ম্যাচটি তাই প্রাণভরে উপভোগ করবে ফুটবল বিশ্ব।
কোয়ার্টার ফাইনালের পথে ব্রাজিল
এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দাবিদার হিসেবেই রাশিয়ায় পা রাখে সেলেসাওরা। গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিল কোস্টারিকা, সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ডকে। প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামে ব্রাজিল। ২০ মিনিটের মাথায় ফিলিপে কৌতিনহোর ডি বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া অসাধারণ এক শটে করা গোল থেকে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ২য় অর্ধে কর্ণার থেকে জুবারের গোলে সমতায় ফেরে সুইজারল্যান্ড। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলেই শেষ হয়।
পরের ম্যাচে সেইন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে কোস্টারিকার বিপক্ষে মাঠে নামে ব্রাজিল দল। ম্যাচটি ছিল মূলত ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকার গোলরক্ষক কেইলর নাভাসের মধ্যে। নাভাস একের পর এক গোল শেভ করে ব্রাজিলকে হতাশ করছিলেন। ৮টি সেভ করার পর অবশেষে বাঁধ ভাঙে ৯০ মিনিটের সময়। আবারো ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন ফিলিপে কৌতিনহো। কৌতিনহোর গোল করার পর যোগ করা সময়ের অন্তিম মূহুর্তে নেইমার গোল পান।
সার্বিয়ার বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে ব্রাজিল জয় পায় ২-০ গোলের ব্যাবধানে। পলিনহো ও থিয়াগো সিলভার গোলে ব্রাজিল ব্রাজিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়ে। ম্যাচটিতে ব্রাজিলের খেলার থেকে বেশি আলোচিত দিক হল নেইমারের ডিগবাজি। সার্বিয়ার এক খেলোয়াড় ফাউল করার পর সাইডলাইনে নেইমারের দেওয়া ৮টি ডিগবাজির জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে।
২য় রাউন্ডে মেক্সিকোকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ব্রাজিল। ইতিমধ্যে জার্মানি, পর্তুগাল, আর্জেন্টিনা, স্পেন বাদ পড়ায় সবার চোখ ছিল ম্যাচটির উপর। অঘটনের বিশ্বকাপে বাজিলের জন্যও কিছু অপেক্ষা করেছে নাকি তা দেখার জন্য।
খেলার শুরুতেই ব্রাজিল ভক্তদের মনে বাদ পড়ার ভয় ঢুকিয়ে দেয় মেক্সিকো। দুর্দান্ত সব আক্রমণ করলেও বাজে ফিনিসিং করার জন্য গোল আদায় করে নিতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ম্যাচের সময় যতই গড়াতে থাকে নিজেদের খোলস ভেঙে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে থাকে সেলেসাওরা। নেইমার, কৌতিনহোদের ছন্দময় ফুটবলের ফুটবল খেলতে থাকেলেও গোল করতে পারছিলেন না। গত বিশ্বকাপের মতোই এবারো ব্রাজিলকে সামনে পেয়ে যেন চীনের প্রাচীর হয়ে ওঠেন।
অবিশ্বাস্য সব সেভ করে মেক্সিকোর আশা বাঁচিয়ে রাখেন। শেষ পর্যন্ত ৫১ মিনিটে নেইমারের গোলে ওচোয়াকে পরাস্ত হতে হয়। গোল পাওয়ার পর আক্রমণের ধার আরও বেড়ে যায় ব্রাজিলের। আবারো ওচোয়া ব্রাজিলের বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ৮৮ মিনিটে রবার্তো ফিরমিনোর গোলে ২-০ গোলের জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে সেলেসাওরা।
বেলজিয়াম যেভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে
বেলজিয়ামকে বলা হচ্ছিলো এবারের বিশ্বকাপের ডার্ক হর্স। ডি ব্রুইন, কোর্তোয়া, এডেন হ্যাজার্ড, ভিন্সেন্ট কোম্পানি, রোমেলু লুকাকুর মতো তারকায় ঠাসা বেলজিয়ামের এই সোনালি প্রজন্ম। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই পানামার বিরোদ্ধে দুর্দান্ত সূচনা করে লুকাকুরা। ৬২ শতাংশ বল দখলে রেখে ম্যাচটি ৩-০ গোলে জিতে নেয়। লুকাকুর জোড়া গোলের সাথে ৪৭ মিনিটে মার্টিন্সের ভলিতে করা দারুণ গোলের সুবাদে সহজ জয় পায় বেলজিয়াম।
গ্রুপ পর্বের পরের ম্যাচে তিউনিসিয়ার বিপক্ষে খেলায় ৫-২ গোলের বড় ব্যাবধানে জয় পায় বেলজিয়াম। হ্যাজার্ড, লুকাকু, ডি ব্রুইনরা এদিন অসাধারণ খেলেন। ৬ মিনিটের সময় পেনাল্টি বক্সে হ্যাজার্ডকে ফাউল করায় পেনাল্টি পায় বেলজিয়াম। ঠাণ্ডা মাথার পেনাল্টি নিয়ে দলকে এগিয়ে দেন হ্যাজার্ড। এর পর থেকে গোল বন্যা বইতে থাকে। হ্যাজার্ড ও লুকাকু প্রত্যেকে দলের হয়ে জোড়া গোল করেন। ম্যাচ শেষে ৫-২ গোলের বড় ব্যবধানে জয় পায় বেলজিয়াম।
২য় রাউন্ড নিশ্চিত হওয়ায় ইংল্যান্ড ও বেলজিয়ামের পরের ম্যাচে দুই দলই অনেক পরিবর্তন আনে। ৫১ মিনিটে করা আদনান জানুজাইয়ের ডি বক্সের ডান প্রান্ত থেকে করা অসাধারণ এক গোলের সুবাদে ১-০ গোলের জয় পায় বেলজিয়াম। ম্যাচ শেষে পূর্ণ ৯ পয়েন্ট নিয়েই জি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে পরের রাউন্ডে উঠে যায় বেলজিয়াম।
২য় রাউন্ডের ম্যাচে সামুরাই খ্যাত জাপানের বিপক্ষে খেলা পড়ে বেলজিয়ামের। ম্যাচটিকে এবারের বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ বলেই অনেকে গণ্য করছেন। মার্টিন্স বেলজিয়ামকে ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে খেলান। অন্যদিকে জাপান ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলতে নামে। বেলজিয়ামের গতিশীল ফুটবল, দুর্দান্ত পাসিং আর একের পর এক আক্রমণের কাছে অসহায় লাগছিল জাপানকে। ভালভাবে রক্ষণভাগ সামাল দিয়ে ভালোই জবাব দেয় জাপান। সুযোগ পেলে প্রতি-আক্রমণে বেলজিয়ামের রক্ষণভাগকে বার বার বিপদে ফেলতে থাকে জাপান। আক্রমণে ঠাসা প্রথমার্ধ গোল শূন্য ড্র থাকে।
২য়ার্ধের ৪৮ মিনিটে প্রতি আক্রমণে হারাগুশির গোল থেকে এগিয়ে যায় জাপান। এর ৪ মিনিট পর তাকাসি ইনুয়ি ডি বক্সের বাহির থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করার পর বেলজিয়ামের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। কিন্তু পরতে পরতে নাটকীয়তায় ঘেরা এই ম্যাচ কিছুক্ষণ পরেই রূপ বদলায়। ৬৯ মিনিটে বেলজিয়াম কর্ণার পায়। ভার্তুগেন অসাধারণ হেডে গোল করেন। এর ৫ মিনিট পর বদলি হিসেবে নামা ফেলাইনি এডেন হ্যাজার্ডের দেওয়া দুর্দান্ত এক ক্রসকে কাজে লাগিয়ে দলকে ম্যাচে ফেরান।
এরপর দুই দলই গোল করার জন্য একের পর আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে। উত্তেজনায় ঠাসা এই ম্যাচটির একদম শেষ মিনিটে কর্ণার পায় জাপান। কর্ণার কাজে লাগাতে পারেনি জাপান। বল চলে যায় গোলরক্ষক কোর্তোয়ার গ্লাভসে। কোর্তোয়া এরপর বল দেন ডি ব্রুইনকে। এরপর বুলেট গতির এক প্রতি আক্রমণে মূহুর্তের মধ্যেই বল চলে যায় মাঠে অপর প্রান্তে। নাসের শাদলির ফিনিশিং থেকে গোল পেয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে বেলজিয়াম।
অন্যদিকে জয়ের এত কাছে গিয়েও কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ে বিশ্বকাপে টিকে থাকা শেষ এশিয়ান দলটি। গতিশীল এই ফুটবল ম্যাচে দুই দল মিলে মোট ৩৫টি শট নেয়।
ইনজুরি আপডেট
মার্সেলো ও ডগলাস কস্তা ইনজুরির কারণে মেক্সিকোর বিপক্ষে খেলতে পারেননি। তবে ব্রাজিলের আশার কথা হলো তারা দলের সাথে অনুশীলনে ফিরেছেন। বেলজিয়ামের বিপক্ষে হয়তো তাদের খেলতে দেখা যেতে পারে। মেক্সিকোর বিপক্ষে হলুদ কার্ড দেখায় এবারের বিশ্বকাপে ২টি হলুদ কার্ড দেখার খেসারত স্বরূপ পরের ম্যাচ খেলতে পারবেন না ক্যাসেমিরো।
অন্যদিকে কার্ড বা ইনজুরির কোনো সমস্যা নেই বেলজিয়াম দলে। ফলে পূর্ণশক্তির দল নিয়েই মাঠে নামবে বেলজিয়াম।
ফাইনালের আগের এক ফাইনাল
ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও দলীয় শক্তিতে দুই দলই প্রায় কাছাকাছি। ব্রাজিল কোচ টিটে ও বেলজিয়ামের কোচ মার্টিন্স দুজনই অনেক কৌশলী। আগের ম্যাচেই চ্যাডলি ও ফেলাইনিকে বদলি হিসেবে মাঠে নামিয়ে ম্যাচ বের করে নিয়ে এসেছেন মার্টিন্স। তাই লড়াই শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে নয় দুই দলের কোচের মধ্যেও হবে।
টিটের ব্রাজিল দলটির এবার রক্ষণভাগ এবার অনেক শক্তিশালী। ৪ ম্যাচে মাত্র ১টি গোল হজম করেছে ব্রাজিল। কিন্তু মেক্সিকোর গতিশীল ফুটবল ভালোই ভুগিয়েছিল ২য় রাউন্ডে। ৪ ম্যাচে ১২ গোল করে উড়ন্ত ফর্মে থাকা বেলজিয়ামের আক্রমণভাগের সামনে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে ব্রাজিলের রক্ষণভাগকে। ক্যাসেমিরোকে হারানো মাঝমাঠে ব্রাজিলকে নিশ্চিত ভোগাবে ডি ব্রুইনদের সামনে। আক্রমণভাগে ব্রাজিলের নেইমার, ফিরমিনহোরা ফর্মে আছেন।
বেলজিয়ামের কোচ মার্টিন্স আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলায় বিশ্বাসী। দলকে ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে খেলাতে গিয়ে অনেক সময় রক্ষণভাগে বিপদের মুখে পড়তে হয়। ভিন্সেন্ট কোম্পানিদের রক্ষণভাগ শক্তিশালী হলেও ব্রাজিলের বিপক্ষে তাদের খেলার ধরনের জন্য নিজদের সেরাটা দেওয়ার বিকল্প নেই। মাঝমাঠের ডি ব্রুইন দুর্দান্ত ফর্মে আছেণ। দুই উইংগার হ্যজার্ড ও মার্টিন্সের গতি আর স্কিল অসাধারণ। স্ট্রাইকার লুকাকু ৪ গোল করে রয়েছেন গোল্ডেন বুট জয়ের দৌড়ে।
শক্তি আর সামর্থ্যে ব্রাজিল ও বেলজিয়াম প্রায় সমানে সমান। ফুটবল খেলায় একটি কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয় তা হলো, “অনেক সময় আক্রমণ করাই হলো সেরা রক্ষণ।” ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবল আর অকুতোভয় আক্রমণাত্মক ও গতিশীল ফুটবল খেলা বেলজিয়ামের ম্যাচে দুই দলের সামর্থ্যের বিচারে রক্ষণাত্মক খেলার কোনো সুযোগ নেই। আর তাই তো ম্যাচটি হতে যাচ্ছে এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।