‘সফলতা’ কী অসাধারণ একটি শব্দ! পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ ছোট এই শব্দটির সংস্পর্শে আসতে প্রতিনিয়ত নানা রকম লড়াই করে যাচ্ছেন। কেননা বেঁচে থাকার জন্য যেমন প্রয়োজন অক্সিজেন, ঠিক তেমনি মনের শান্তির জন্য প্রয়োজন সফলতা। আর এজন্যই সফলতাকে মনের অক্সিজেনের সাথে তুলনা করলে মনে হয় না খুব একটা দোষের কিছু হবে। আর তাই প্রত্যেকেই দিনের শেষে সফলতার প্রকৃত স্বাদ পেতে চান।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, আপনাকে যদি এই মুহুর্তে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি সফল? ছোট এই প্রশ্নের উত্তরে সিংগভাগ মানুষ হয়তো বলবে, “সফলতা, এতো ভিন্ন গ্রহের একটি শব্দ”। সত্যিই যদি সফলতাকে এতো অলৌকিক বা অবাস্তব কিছু মনে করে থাকেন, তাহলে আজকের এই লেখাটি আপনার জন্য।
পৃথিবী কত অদ্ভুত এক জায়গা। যেখানে কেউ সফলতার ধারের কাছেও যেতে পারেন না, আবার অন্যদিকে কেউ সফলতার রেকর্ড করে বসে থাকেন। তেমনি একজন মাইকেল ফেলপস। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা এই সাঁতারু, সত্যিই সফলতার এক অন্যনাম। জীবনের নানা কঠিন সময়ের মাঝেও সফলতাকে যিনি নিয়ে গেছেন এক অন্য পর্যায়ে।
কে এই মাইকেল ফেলপস
মার্কিন যুক্তরাষ্টের এই সাঁতারু পৃথিবীর সবচেয়ে সফলতম একজন অলিম্পিয়ান। মহান এই সাঁতারু তার সম্পূর্ণ জীবনে এত বেশি মেডেল জিতেছেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে নির্দিষ্ট কোনো খেলায় কোনো দেশের হয়ে সর্বোচ্চ। ফেলপস চার অলিম্পিকে মোট ২৮ মেডেল অর্জন করেন যার মধ্যে স্বর্ণ ছিল ২৩ টি। আপাত দৃষ্টিতে এই কীর্তিকে খুব বড় মনে না হলে, চলুন একটা পরিসংখ্যান দেখে আসি। আমাদের তথা বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত অলিম্পিকে কোন সাফল্য না থাকায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে নজর দিতে চাই।
১৩০ কোটির বিশাল একটি দেশ যেখানে ৫৭ অলিম্পিকে সর্বোমোট ২৮ টি মেডেল অর্জন করতে পেরেছে, সেখানে মাইকেল ফেলপস মাত্র ৪ অলিম্পিকে একাই ২৮ টি মেডেল অর্জন করেছেন। এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন, কতোটা মানসিক শক্তি থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে এত অসাধারণ কীর্তি অর্জন করা সম্ভব।
প্রাথমিক জীবন
১৯৮৫ সালের ৩০ জুন মাইকেল ফেলপস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর (Baltimore) মেরিল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৭ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখা শুরু করেছিলেন। সাঁতারে তিনি এত বেশি মনোযোগী ছিলেন যে, ১০ বছর বয়সেই জাতীয় রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেন। পরবর্তীতে ১২ বছর বয়সে একই বিভাগে আবারো নিজের রেকর্ড ভাঙেন। ১৫ বছর বয়সেই স্কুল ছাত্র থাকা অবস্থায় আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু হিসাবে অলিম্পিকে যোগদান করেন এবং ১৯ বছর বয়সে আবারো জাতীয় পর্যায়ে নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙেন।
রেকর্ড বালক ফেলপস অনেক বেশি গোছালো এবং নিজের খেলার প্রতি ফোকাসড ছিলেন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৬ অলিম্পিকে তিনি সর্বমোট ২৮টি মেডেল অর্জন করেন।
২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের জন্য ফেলপসের নিবিড় অনুশীলন দেখে মানুষ তাকে পাগল ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু মানুষের কথায় কান না দিয়ে ফেলপস ভাবছিলেন কীভাবে মার্ক স্পিটজের (Mark Spitz) রেকর্ড ভাঙ্গতে পারবেন। মার্ক স্পিটজ ছিলেন তখনকার সময়ে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ সাঁতারুদের মধ্যে একজন। যিনি ১৯৭২ সালে সাঁতারের বিভিন্ন বিভাগে একই আসরে ৭ টি স্বর্ণ পদক অর্জন করেছিলেন।
যেভাবে ভেঙ্গেছিলেন এতসব রেকর্ড
এতো এতো রেকর্ড দেখে আপনার মনে হতে পারে, ফেলপসের জন্মই হয়েছে রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু কথায় আছে, Practice makes a man perfect অর্থাৎ একমাত্র অনুশীলনই পারে একজন মানুষকে উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে। আর জীবনে চলার পথে শর্টকাট কোনো পন্থা নেই। আমাদের অনেকের কাছে ছোট ছোট এই বাক্যগুলোর কোনো গুরুত্ব না থাকলেও পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক সফল ব্যক্তিরা সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন এই বিষয়গুলোর উপর। যার বড় প্রমাণ মাইকেল ফেলপস। ছোটবেলা থেকে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, প্রত্যেক রেকর্ড করার পর খাতা কলম নিয়ে বসতেন এবং পরের রেকর্ড কীভাবে অতিক্রম করবেন, সে ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতেন।
ফেলপসের কঠোর অনুশীলনের একটি দৃষ্টান্তের কথা না বললেই নয়। ২০০৪ সালে ফেলপস যখন বললেন, তিনি মার্ক স্পিটজের ৭টি স্বর্ণের রেকর্ড ভাঙ্গবেন, তখন অনেকেই বিষয়টিকে মজা হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু ফেলপস পড়াশোনা শুরু করলেন, এই রেকর্ড গড়ার পথে মার্ক কীভাবে অনুশীলন করেছিলেন। তিনি দেখলেন, মার্ক প্রতিদিন প্রায় ৮ ঘন্টা অনুশীলন করতেন।
এবার ফেলপস সিন্ধান্ত নিলেন, তিনি আগামী চার বছর প্রতিদিন ১২ ঘন্টা অনুশীলন করবেন। যার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ১০০ কিলোমিটার, প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার এবং ৫০ সেকেন্ডে ১০০ মিটার অতিক্রম করার অনুশীলন করবেন। এভাবেই চার বছর অনুশীলন করার পর বেইজিং অলিম্পিকে ৮টি স্বর্ণ জয় করলেন আর পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, মানুষের জন্মই হয়েছে মূলত অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য।
সংকটাপন্ন জীবন
রেকর্ডের বরপুত্র মাইকেল ফেলপসের জীবনের গল্প এতক্ষণ পর্যন্ত খুব মসৃণ মনে হলেও তিনি ছোটবেলা থেকে নানারকম সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন। ৯ বছর বয়সে তার বাবা-মার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের পর তিনি মায়ের আদরেই শৈশব ও কৈশোর পার করতে থাকেন। কিন্তু বাবা-মায়ের এই বিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারেন নি কখনোই। একা একা কেঁদে পার করেছেন অনেকদিন। কিন্তু মা এবং তার ব্যক্তিগত কোচের পরামর্শে সুইমিং পুলকেই জীবন সাথী বানিয়ে নিয়েছিলেন। আনন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন সাঁতারের মাধ্যমেই।
২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে বিশ্ব রেকর্ডের পর তিনি বিশ্বের ৫ম ধনী খেলোয়াড় হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু অতিমাত্রায় আর্থিক সন্তুষ্টির কারণে মাইকেল ফেলপস ড্রাগ, যৌন কেলেঙ্কারি সহ বেশ কিছু অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি এজন্য তাকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়।
এজন্যই হয়তো গুণীজনেরা বলেন, অতিমাত্রায় সুখ মানুষের মনুষত্ব নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্যই তিনি মার্কিন সুইমিং ফেডারেশন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ হন। একই সাথে ২০১২ সালের অলিম্পিকেও অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ২০১৪ সালে মাইকেল ফেলপস মা ও কোচের অনুপ্রেরণায় পুনরায় নতুন উদ্যমে ফিরে আসেন প্রাণের সাঁতারে। এবং ২০১৬ সালের অলিম্পিকে আবারো ৫টি স্বর্ণ পদকসহ সর্বমোট ২৩টি স্বর্ণ জয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেন। যা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো অলিম্পিক খেলোয়াড়ের জন্য সর্বোচ্চ।
শেষের শুরু
মাইকেল ফেলপসের এই ঈর্ষণীয় সফলতার গল্প থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ ফেলপস তার প্রতিটি সংকটাপন্ন পরিস্থিতিকে সহজভাবে উপলব্ধি করেছেন, অনুপ্রেরণায় রূপান্তরিত করেছেন এবং অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন।
Featured Image: uk.businessinsider.com