মাশরাফি, সাকিব ও তাসকিন : মায়ের চোখে কেমন তাঁরা

0

হাজারো ব্যস্ততা শেষে তাঁরাও খোঁজেন মায়ের আঁচল। মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান ও তাসকিন আহমেদ যখন বাড়িতে ফেরেন, তাঁদের মায়েদের চোখে-মুখে খেলে অপার্থিব আনন্দ। এই ঈদেও ছেলের সঙ্গে তাঁদের সময় কাটবে দারুণ। তিন ক্রিকেট-তারকার মায়েরা শোনাচ্ছেন তাঁদের ছেলেদের গল্প। জানাচ্ছেন মায়েদের চোখে কেমন তাঁদের ছেলেরা

মাশরাফির মায়ের অপেক্ষা

হামিদা মুর্তজার অপেক্ষা ফুরোল বলে। ক্রিকেট ব্যস্ততা সেরে ইংল্যান্ড থেকে তাঁর ছেলে দেশে ফিরেছেন কদিন আগে। দু-এক দিনের মধ্যে ঈদ করতে ছেলে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা দেবেন নড়াইলে। বাড়িটা মুহূর্তেই রূপ নেবে আনন্দভুবনে।

হামিদার মন তাই ব্যাকুল, কখন আসবেন বাড়ির বড় ছেলে ‘কৌশিক’, ক্রিকেটে যাঁর পরিচয় মাশরাফি বিন মুর্তজা নামে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে যেহেতু বেশি দেরি নেই, হামিদার মুখে খেলছে খুশির আভা, ‘এখন তো নাতি-নাতনি হয়েছে, অন্য রকম আনন্দ। আসলের চেয়ে যে সুদের আনন্দ বেশি! ও এলে আমাদের বাড়ি লোকে ভরে যায়। একটা উৎসব উৎসব ভাব ছড়িয়ে পড়ে। যত দিন থাকবে, পরিবেশটি এমনই থাকবে।’

মাশরাফি বাড়িতে ফিরলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ততা বাড়বে হামিদা মুর্তজার। রেঁধে খাওয়াবেন ছেলের প্রিয় সব খাবার। মায়ের হাতের কোন খাবার বেশি পছন্দ মাশরাফির? ‘আলু ভর্তা, ডাল, ডিম ভাজি, ইলিশ মাছ ভাজি, লাউ শাক দিয়ে কই, লাল শাক দিয়ে চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস…।’ তালিকা বড় হতে থাকে মাশরাফির মায়ের। একটা আফসোসও ঝরে পড়ে তাঁর, খেলার কারণে প্রিয় খাবার সব সময়ই যে খেতে পারেন না ছেলে!

দেশে থাকলে যত ব্যস্ততাই থাক, নড়াইলের বাইরে কোথাও ঈদ করেন না মাশরাফি। কিন্তু কখনো কখনো খেলার ব্যস্ততায় বিদেশে ঈদ করতে হয়েছে তাঁকে। ঈদে মাশরাফি বাড়িতে না থাকলে মনের অবস্থা কেমন হয় সেটি বলছিলেন হামিদা, ‘যে কয়েকবার ও বিদেশে ঈদ করেছে, শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো নড়াইল নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। আর সে যখনই নড়াইলে আসে, ঈদ-ঈদ মনে হয় সবার!’

বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক শুধু নন, মানুষ হিসেবেও মাশরাফি অতুলনীয়। দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে সম্মান-অর্জন যেমন পেয়েছেন, তেমনি উঠেছেন খ্যাতির চূড়ায়। তবে ছেলে যত বড় তারকাই হোন, মায়ের কাছে সব সময়ই তিনি অতিসাধারণ। হামিদা মুর্তজার চোখে তাই ক্রিকেটার হওয়ার আগের মাশরাফি আর এখনকার মাশরাফির কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে না, ‘ও সব সময়ই একই রকম। ছোটবেলা থেকে পরিষ্কার মনের মানুষ। আনন্দ-মজায় থাকতে পছন্দ করে। সন্তানের বাবা হওয়ায় এখন পরিবারকে একটু সময় দেয়—এই যা পার্থক্য।’

ছেলে বড় ক্রিকেটার হলেও হামিদা শুরুতে চাননি মাশরাফি ক্রিকেট খেলুন। আর দশটা মায়ের মতো অভিন্ন চাওয়া ছিল তাঁর, ‘ছেলে ক্রিকেটার হবে তখন ভাবা কঠিনই ছিল। ভাবতাম লেখাপড়া করে চাকরিবাকরি করবে। হয়তো পিএইচডি করবে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল মাশরাফি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবে। সব বাবা-মায়ের এমন ইচ্ছে থাকে।’

ছেলে অধ্যাপক হননি। কিন্তু তাঁর যে ক্রিকেট-মস্তিষ্ক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রিকেট’ নামের বিষয় থাকলে সেটির অধ্যাপক মাশরাফি হতেই পারতেন!

মা শিরিন আক্তারের সঙ্গে সাকিব। ছবি: প্রথম আলোসাকিবের মায়ের চোখে যে স্বপ্ন

হামিদা মুর্তজার মতো শিরিন আক্তারের একই অপেক্ষা—তাঁর ‘ফয়সাল’ বাড়িতে আসবেন কবে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষ করে মাত্র ছেলে ফিরেছেন দেশে। গত শনিবার যখন শিরিন আক্তারের সঙ্গে কথা হলো, নিশ্চিত করতে পারেননি সাকিব আল হাসান কবে যাবেন মাগুরায় ঈদ করতে। শুধু ছেলে নয়, গত দুই বছর তাঁদের বাড়ি আলোকিত করে আছে আরও একজন—আলায়না হাসান অউব্রে, সাকিব-কন্যা।

িবশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। মানুষ সাকিবের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও খেলোয়াড় হওয়ার আগে ও পরের একটা পার্থক্য দৃশ্যমান মা শিরিন আক্তারের চোখে, ‘আগে সে ইচ্ছেমতো ঘুরত-বেড়াত, এখন সেটা পারে না। খেলার ব্যস্ততা থাকায় এখন বেশির ভাগ সময়ে বাইরে থাকে। রাস্তাঘাটে হাঁটলে মানুষ বলে, সাকিব আল হাসান যায়। আগে তো আর এটা বলত না। পার্থক্য বলতে এসবই।’

ছেলের তারকাখ্যাতি শিরিন ভীষণভাবে উপভোগ করেন, ‘আমি ওর সঙ্গে বেশ কয়েক জায়গায় গেছি। এ বছর ভারত-শ্রীলঙ্কা গেলাম। হয়তো কোথাও যাচ্ছি, ঘুরতে বা কেনাকাটা করতে, মানুষ মোবাইল হাতে দৌড়ে আসছে ছবি তুলতে। কি ছোট, কি বড়। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে। বুঝি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও সে জনপ্রিয়।’

সাকিব যে ক্রিকেটার হবেন, সেটি যেন নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পরই। কিন্তু হামিদা মুর্তজার মতো শিরিনও একটা সময় চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোক, ‘এখন তো অনেক বাবা-মা ছেলেকে মাঠে দিয়ে আসেন। তখন এটা ছিল না। আমিও চেয়েছি সে পড়াশোনা করুক। বিকেএসপিতে যখন ভর্তি হলো, ভেবেছি যদি জাতীয় দলে সুযোগ পায়…না হলে পড়াশোনা করবে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে।’

মানুষ হিসেবে সাকিবের সততা শিরিনকে সব সময়ই গর্বিত করে। কিন্তু ছেলের হঠাৎ রেগে যাওয়াটা ভাবায় তাঁকে, ‘যখন অনেক বিরক্ত হয়, মানুষ তখনই রাগে। তবে ওর এটা পরিবর্তন করলেই ভালো।’

১১ বছরের ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে কিংবা ব্যক্তিগত সাফল্যে সাকিবের প্রাপ্তির খাতাটা বহু মণি-মুক্তায় পূর্ণ। তাঁর মা স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জয় করবে। আর সেই দলে থাকবেন সাকিব। মায়ের এই স্বপ্ন পূরণ হলে নিশ্চিত আনন্দ-জোয়ারে ভাসবে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বঙ্গীয় বদ্বীপ!

তাসিকনকে আদর করছেন মা সাবিনা ইয়াসমিন। ছবি: সংগৃহীতমাকে তাসকিনের উপহার

ঈদে মাশরাফি-সাকিবের মতো নিজ এলাকায় ফেরার তাড়া নেই তাসকিন আহমেদের। তাই হামিদা মুর্তজা কিংবা শিরিন আক্তারের মতো অপেক্ষা নেই তাঁর মা সাবিনা ইয়াসমিনের। মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন রোডে তাঁদের বাড়ি, ঈদ উদ্‌যাপন ঢাকাতেই।

তবে মায়ের অপেক্ষা বাড়ে যখন তাসকিন খেলতে যান দেশের বাইরে। এবারও সেই অপেক্ষা ছিল, যা ফুরিয়েছে গত শনিবারে। সাসেক্স, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড—৫০ দিনের সফর শেষে ঘরে ফিরেছেন তাসকিন। বিদেশে খেলতে গেলে ছেলেকে নিয়ে সাবিনার মাথায় খেলে হাজারো চিন্তা, ‘নিজের প্রতি যত্ন নিতে পারে না, একটু খামখেয়ালিপনাও আছে। চিন্তাটা সে কারণেই।’

নিজের প্রতি যত্নবান না হওয়াটা যেমন ভাবায়, তেমনি ছেলের সততা, পরোপকারী আর উদার মানসিকতায় গর্ব খুঁজে পান মা, ‘ক্রিকেটার হিসেবে তার যতটুকু নামডাক হয়েছে, এসব নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। পার্থক্য শুধু একটাই, আগে বাসায় থাকত। এখন ক্রিকেট-ব্যস্ততা থাকায় বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকে।’

মাকে উপহার দিতে ভালোবাসেন তাসকিন। যদিও মায়ের কাছে তাসকিনের প্রতিটি উইকেটই বিরাট উপহার! সে না হয় মাঠের কথা। কিন্তু মায়ের জন্য এবার ছেলে কী উপহার নিয়ে এলেন? ‘বিদেশ থেকে ফেরার সময় সব সময়ই কিছু না কিছু আনে। এবার এসে বলল, “মা, তোমার জন্য তেমন কিছু আনতে পারিনি।” খানিক পর ব্যাগ থেকে কী যেন বের করল—দেখি সোনার ব্রেসলেট! এভাবে চমকে দেবে ভাবিইনি।’ বলছিলেন সাবিনা।

এবারই নয়, মাঝেমধ্যেই মাকে নানাভাবে চমকে দেন তাসকিন। বছর দুয়েক আগের একটা স্মৃতি মনে পড়তে সাবিনার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘একবার মা দিবসে আমাকে একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। আগে থেকে জানতাম না ঠিক কোথায় যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে এত ভালো লাগল, ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেলাম!’

শুধু মাকে নয়, মাঠেও নিশ্চয়ই সামনে আরও চমক উপহার দেবেন তাসকিন, দুর্দান্ত বোলিংয়ে মুগ্ধ করবেন সবাইকে।

collected

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *