জ্যামাইকার ছোট্ট শহর ট্রিলনি পারিশ। ২১ আগস্ট, ১৯৮৬। এই শহরে জন্ম নেয় একটি সাধারণ ছেলে। নাম উসাইন সেন্ট লিও বোল্ট। বাবা ওয়েলেসলি, মা জেনিফার বোল্ট। ভাই সাদেকি ও বোন শেরিনকে নিয়ে বেড়ে ওঠে ছেলেটি। বাবা মুদি দোকানদার। বাবার সাথে মাও দোকান চালাতে সাহায্য করতেন। ছোট্ট বোল্টও চাল-ডাল বিক্রি করতো বাবা-মায়ের সাথে। মুদি দোকানের আয় থেকেই চলতো তাদের সংসার।
সেই চাল ডাল বিক্রি করা ছোট্ট ছেলেটিই আজকের কিংবদন্তী উসাইন বোল্ট। পৃথিবীর সর্বকালের দ্রুততম মানব। যিনি তিনি ১০০ মিটার দৌড় ৯.৫৮ সেকেণ্ডে এবং ২০০ মিটার দৌড় ১৯.১৯ সেকেণ্ডে শেষ করেছেন। ২০১০ সালে ভেঙ্গেছেন নিজের করা বিশ্বরেকর্ড । ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে জয় করেছেন ৯ টি সোনা ৷
কিন্তু ছোটবেলাতে দৌড়বিদ হতে চাননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই মনেপ্রাণে ক্রিকেটকে ভালবাসতেন। তার প্রথম ভালোবাসার নামই ক্রিকেট। স্কুলজীবনে এই ক্রিকেটই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। একসময় স্বপ্ন দেখতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট খেলার। জ্যামাইকার অনেক মাঠেই ব্যাট-প্যাড পরে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে এই দ্রুততম মানবকে। দৌড় থেকে অবসর নেওয়ার পর ক্রিকেট খেলা শুরু করারও সম্ভাবনা ছিল তার। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-২০ লীগ ‘বিগ ব্যাশে’র শেন ওয়ার্নের নেতৃত্বাধীন দল মেলবোর্ন স্টার্সে আলোচনাও হয়েছে এ বিষয়ে।
অথচ এই ক্রিকেট পাগল লোকটিই পাঁচবার বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। তিনবার অলিম্পিক স্বর্ণপদক এবং বিশ্বের ৭ম দৌড়বিদ হিসেবে যুব, জুনিযর এবং সিনিয়র বিভাগের অ্যাথলেটিক ইভেন্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ জয় করেছেন।
ছেলেবেলা ও দৌড়বিদ হয়ে ওঠা
ছোট বেলায় ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের রাস্তায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে সময় কাটত বোল্টের। এই দুটি খেলার প্রতিই বোল্টের ভালো লাগা রয়েছে। যে কোনো খেলার মাধ্যমেই হোক সারাক্ষণ দৌড়ের উপরেই থাকতেন তিনি। প্রাইমারি শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হলেন ওয়েলডেসিয়া প্রাইমারি স্কুলে। সেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্প্রিন্ট ট্র্যাকে ১ম পা পড়ে বোল্টের এবং শুরুতেই বাজিমাত করেন বোল্ট। ১০০ মিটারে স্কুলের সেরা দৌড়বিদ হন তিনি। তবে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি যে, বোল্ট ক্রিকেট, ফুটবল যখন যেটা পেতেন সেটাই খেলতেন। তবে ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটের দিকেই এগোচ্ছিলেন বোল্ট। এই বিষয়ে বিস্তারিত নিচে আলোচনা উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর বোল্টের ক্ষিপ্র গতি চোখে পড়ে তার ক্রিকেট কোচের। তার অনুপ্রেরণায় দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বোল্ট। বোল্টকে দেখে অলিম্পিকের সাবেক এক স্প্রিন্টারও বোল্টকে পরামর্শ দেন অ্যাথলেটিক্স এর মনোযোগ দেওয়ার জন্য। জ্যামাইকার হয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ইভেন্টে প্রথম অংশ নেন ২০০১ সালে। প্রথমবার অংশ নিয়েই ২০০ ও ৪০০ মিটারে জিতে নেন রুপা। একই বছর হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটারে অংশ নেন। কিন্তু ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলেও তখন পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা টাইমিং (২১ দশমিক ৭৩ সে.) করেন।
বোল্টের কিছু অনন্য কীর্তি
- তিনবার ২০০ মিটার স্প্রিন্ট জয়ী প্রথম অ্যাথলেট উসাইন বোল্ট। দুইবার করে জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল জনসন ও ক্যালভিন স্মিথ
- দুইবার ১০০ ও ২০০ মিটারের ‘ডাবল’ জয়ের একমাত্র কীর্তি
- ৫টি ব্যক্তিগত স্বর্ণ জিতে বোল্ট স্পর্শ করেছেন কার্ল লুইস ও কেনেনিসা বেকেলেকে। মাইকেল জনসন ও সের্গেই বুবকা অবশ্য এগিয়ে। এ দু’জন জিতেছেন ৬টি করে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক।
- ৮টি স্বর্ণ জয়ের বিরল রেকর্ড। এই রেকর্ডে বোল্টের সঙ্গী কার্ল লুইস ও মাইকেল জনসন। কার্ল লুইস তিনটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে জিতেছিলেন ৮টি স্বর্ণ। মাইকেল জনসনকে ৮টি স্বর্ণ জিততে খেলতে হয়েছিল ৫টি আসর। মস্কোতে ৩টি স্বর্ণ জিতে উসাইন বোল্ট র্স্প করেছেন এই দুজনকে। মেয়েদের মধ্যে অবশ্য ৮টি স্বর্ণ আছে মার্কিন স্প্রিন্টার অ্যালিসন ফেলিক্সের।
অবসরের ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন
২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকের পর ট্র্যাক থেকে বিদায় নেবেন। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন উসাইন বোল্ট। ২০১৬ সালে অবসর নিচ্ছেন না তিনি। অংশ নেবেন ২০১৭ সালের লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও। বুটজোড়া তুলে রাখতে পারেন এর পর। অবসর প্রশ্নে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কারণটাও ব্যাখ্যা করেছেন এ গ্রহের দ্রুততম মানব, ‘রিওর পরই অবসর নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভক্তরা চায়, আমি যেন অন্তত আরও একটা বছর খেলে যাই। আমার স্পনসররা একই মত দিয়েছে। কোচও বলেছেন, এটা করা যেতে পারে।’
সাফল্যের রহস্য
বোল্টের ক্ষিপ্র গতির রহস্য খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা রাতের ঘুম হারাম করে ফেলেছেন। অবশেষে তাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে তারা যা বলেছেন তা হলো, উসাইন বোল্টের সাফল্যের পেছনে রয়েছে নিখুঁত হাঁটু। হাঁটুর জোরেই নাকি তিনি অ্যাথলেটিকস বিশ্ব কাঁপাচ্ছেন। জ্যামাইকান অ্যাথলিটদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যে তরুণদের পা বিশেষ করে হাঁটু চমৎকার আছে, তারাই ভালো স্প্রিন্টার হতে পারছেন। এই সমীক্ষা ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ৩০০ জন স্কুল অ্যাথলিটের ৮ বছর থেকে ২২ বছর পর্যন্ত বেড়ে ওঠা দেখার পরে সিদ্ধান্তে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু অপরপক্ষে নর্থুম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জন মানিং বলেছেন, দুই হাঁটুতে সিমেট্রি থাকলে অ্যাথলিটরা সাফল্য পেতে পারেন। বোল্টের ক্ষেত্রেও এক কথা প্রযোজ্য। তবে আমাদের সিমেট্রি তত্ত্বকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আরও গবেষণা দরকার। এই মুহূর্তে জামাইকান অ্যাথলিটদের দিকে সন্দেহের তীর ছোঁড়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ডোপ করেই এমন সাফল্য পাচ্ছেন তারা। এক ঝাঁক অ্যাথলিট সাসপেন্ড হয়ে রয়েছেন। বোল্ট, ব্লেকদের দিকেও অনেকে আঙুল তুলেছে।
টানা তিন বার বর্ষসেরা
উসাইন বোল্ট সর্বমোট পাঁচ বার বর্ষসেরা অ্যাথলেট (পুরুষ) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে টানা তিনবার তিনি বর্ষসেরা পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০০৮, ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ এই পাঁচ বছর তিনি বর্ষসেরার পুরস্কার জয় করেন। মাঝখানে ২০১০ সালে সালে বোল্টকে হতাশ করে উৎসব করেছিলেন কেনিয়ান মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ ডেভিড রুডিশা। না হলে টানা ছয়বারের একটা রেকর্ড গড়ে ফেলতেন উসাইন বোল্ট।
বোল্টের নিজের কিছু কথা ও বোল্ট সম্পর্কে অন্যদের কিছু কথা
- ‘ফোর্বস’ সাময়িকীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বোল্ট বলেছিলেন, ‘জীবনে আমি খুব বেশি সফলতা লাভ করতে পারিনি! কারণ, আমি একজন অলস প্রকৃতির মানুষ।’
বরাবরের মতো খামখেয়ালি স্বভাবের উসাইন বোল্ট একবার বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় খেলা ছাড়া আর কোনো কিছুই আমি চিন্তা করতে পারতাম না।’ - ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের জীবন্ত কিংবদন্তি কার্ল লুইস বলেন, “বোল্ট অবিশ্বাস্য, সে অন্য গ্রহের।”
- ইভেন্টটির আরেক মহাতারকা মাইকেল জনসন বলেন, “পৃথিবীতে এমন কোনো অ্যাথলেট নেই, যিনি বোল্টকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।”