রাফায়েল ভারান: সর্বকালের সেরা হওয়ার পথে এক ফরাসি ফুটবলার

২০১১ সালের প্রথম দিকে জিনেদিন জিদানের কাছে কয়েকজন স্কাউট খবর দিলেন এক প্রতিভাবান কিশোর সম্পর্কে। ঐ স্কাউটরা কোনো ক্লাবের কিংবা ন্যাশনাল টিমের নিয়োগপ্রাপ্ত নয়, এরা শুধুমাত্র প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলার খুঁজে অন্য বড়সড় স্কাউটদের খবর দেয় অর্থের বিনিময়ে। জিনেদিন জিদান তাদের তথ্যে প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও ‘জানুয়ারি’ থেকে ‘মে’ পর্যন্ত সেই কিশোরটিকে পর্যবেক্ষণ করেন গোপনে। তিনি একটি স্টেটমেন্ট তৈরি করে ১৮ বছর বয়সী সেই কিশোরের সকল তথ্য তৎকালীন রিয়াল মাদ্রিদের হর্তাকর্তা হোসে মরিনহোর কাছে পাঠালেন।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

মরিনহো কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আরো ২০-৩০টি ফাইল পর্যবেক্ষণ করে জিদানের পাঠানো ফাইলটি হাতে নিলেন। ঘুমাতে যাবেন নাকি ফাইলটি খুলবেন সেটা ভাবতে ভাবতে খুলেই ফেললেন উপরের প্লাস্টিকের মলাট। অন্য ফাইলগুলো দেখতে সময় নিলেন মাত্র মিনিট ৫, কিন্তু অন্যগুলোর মতো ঐ ফাইলটি ৫ মিনিট দেখার পর ভালদেবেস ফ্যাসিলিটির কুকারকে আরেক মগ কফি দিতে বলে বসে পড়লেন ফাইলটি নিয়ে। হয়তো ভেবে বসেছেন কিংবদন্তী জিনেদিন জিদান পাঠিয়েছিলো তাই এত সময় নিয়ে পড়া? আসলে তা নয়!

ঐ কিশোরের ৭ বছর বয়স থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটা দিনের হিসাব করছেন মরিনহো। জিদানের পাঠানো কিছু ভিডিও দেখলেন সারারাত ধরে। পরেরদিন ম্যানেজমেন্টের সাথে ট্রান্সফার মৌসুম নিয়ে মিটিং এ জানিয়ে দিলেন নিজের সিদ্ধান্ত, কল করা হয় সুদূর ফ্রান্সের ফুটবল ক্লাব RC Lens এ। ঐ ক্লাবটি তাদের ইতিহাসের প্রথমবার এমন কোনো বড় ক্লাব থেকে প্রস্তাব পেয়েছে খেলোয়াড় বিক্রির কিন্তু প্রেসিডেন্ট গার্ভাইস মার্টেল যে খেলোয়াড়টির নাম শুনলেন তাতে মারাত্মক রকমের আশ্চার্যও হয়ে গেলেন।

বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন আপনারা কি ভেবেচিন্তে বলছেন, সে তো এখনো ছোট! তার পরিবার ছাড়তে চাইবে না তাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেষ ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট রাজি হলেন তবে শর্তও দিয়ে দিলেন। যদি ঐ খেলোয়াড়ের পরিবার এবং তিনি ব্যক্তিগত ভাবে রাজি হন তাহলে ক্লাবের কোনোপ্রকার আপত্তি থাকবে না। লেন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্টের কথামত জিদানকে দিয়ে ফোন করানো হলো কিশোর ফুটবলারটির বাবার কাছে। তিনি কল ধরেননি, ধরেছেন যার জন্য এত আয়োজন সেই কিশোর ছেলেটি।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

ফোনের অপর প্রান্তে জিদান বলছিলেন

আমি জিদান, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনেছ? আমি তোমাকে রিয়াল মাদ্রিদে আনতে চাচ্ছি। তুমি কি তোমার বাবার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারবে?

ছেলেটি তখন পড়ার টেবিলে পরবর্তী দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো! সোজাসুজি বলে দিলো

কাল আমার পরীক্ষা। আমি পড়ছি। কল রাখুন, মজা করবেন না তো জনাব।

পরদিন বিকেলে প্র্যাকটিসে গিয়ে কোচের কাছ থেকে মাদ্রিদের আগ্রহ শুনে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না ছেলেটি। দৌড়ে নিজের বাসায় গিয়ে দেখে তার বাবা-মা হাস্যোজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে তার দিকে। তারা ইতিমধ্যে ক্লাব লেন্সের প্রেসিডেন্ট থেকে সবকিছুই জেনেছেন এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ছেলেকে বিদায় দিতে।

এই ঘটনাগুলো ২০১১ সালের মে মাসের শেষেরদিকে। জুন মাসে রিয়াল মাদ্রিদ ঘোষণা করলো তারা ৯ মিলিয়নের বিনিময়ে ফ্রান্সের ক্লাব RC Lens থেকে ৬ বছরের চুক্তিতে একজন ১৮ বছর বয়সী ডিফেন্ডার সাইন করিয়েছে, তখনই মিডিয়ায় আলোচিত হতে লাগলো ফ্রেঞ্চ ঐ ডিফেন্ডার।

ভারানের বাবা মা এবং তার ছোটবেলার ছবি; source:ouest-France

কিশোর ছেলেটির নাম রাফায়েল ভারান। ১৯৯৩ সালের ২৫ এপ্রিল ফ্রান্সের লিলি শহরে জন্মগ্রহণ করেন সময়ের সেরা এ ডিফেন্ডার। পিতা গেস্টন ভারান ছিলেন মার্টিনিকুইজ দ্বীপের বাসিন্দা এবং মা অ্যান্নি ছিলেন একজন খাঁটি ফরাসি। জেনে রাখা ভালো কিংবদন্তী থিয়েরে হেনরির জন্মও মার্টিনিকুইজ আইসল্যান্ডে যা ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রিত ছিলো। রাফায়েলের বাবা ছিলেন হসপিটালের সুপারভাইজার এবং মা ছিলেন ইংরেজি শিক্ষিকা। রাফায়েল জন্মগ্রহণ করার ১৭ বছর আগে থেকেই তারা লিলি শহরে থাকতে শুরু করেন।

রাফায়েল ভারান ছাড়াও তাদের আরো দুই ছেলে ছিলো, একজন অ্যান্টনি ভারান আরেকজন জনাথন ভারান। অ্যান্টনি পেশাদার ফুটবলার হলেও ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত হয়ে ফুটবল ছেড়ে দেন এবং জনাথন এখনো একাডেমিক ফুটবলে সময় কাটাচ্ছেন। মূলত রাফায়েল ভারানের ফুটবল উন্নয়নে তার ছোট ভাইয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার পিতা চেয়েছিলেন সে ছোটবেলা থেকে রাগবি খেলুক কিন্তু রাফায়েলের পছন্দ ছিলো ফুটবল।

RC Lens এর জার্সিতে ভারান; source:goal.com

৭ বছর বয়সে শহরের ছোট ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করানো হয় তাকে। লিলির ছোট্ট শহর হেল্লিম্মেস এ থাকতো তার পরিবার, সেজন্য AS Hellemmes হয় রাফায়েলের প্রথম ফুটবল ক্লাব। সেখানে দু’বছর থাকার পর ৯ বছর বয়সে তাকে নিজেদের একাডেমিতে নিয়ে যায় RC Lens এবং সেখানেই ভারান ছিলেন ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত।

রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম সিজনে ভারান; source:the peoples person

২০১১ সালে ৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান ফরাসি ফুটবল তারকা। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে মাত্র ১৮ বছর ৪ মাস ২৭ দিন বয়সে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগায় অভিষেক হয় ভারানের। এর ৬ দিন পর আয়াক্সের বিপক্ষে ১৮ বছর ৫ মাস ২ দিন বয়সে চ্যাম্পিয়ন্সলিগে অভিষেক হয় ফরাসি কিশোর রাফায়েল ভারানের। সেবছর ডিসেম্বরে খেলেছিলেন কোপা-দেল রে ম্যাচও।

মাদ্রিদে এসে বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারদের সামনে দিয়ে মাদ্রিদের ডিফেন্সে আলো ছাড়তে সুযোগ দেওয়া হোসে মরিনহো তখন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছিলেন সমালোচকদের যারা তাকে মাদ্রিদে আনায় মরিনহোর কঠোর সমালোচনা করেছিলো।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ভারান; source:zimbio

অতপর ২০১৩ তে মরিনহো বরখাস্ত হন এবং মাদ্রিদে আসেন কার্লো আলচেলত্তি। এর মাঝে ফ্রান্সের অনূর্ধ্ব-১৮ এবং ২০, ২১ দলের হয়েও খেলেছেন ভারান। ২০১৩ সালের মার্চে ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় ভারানের। তারপর খেলেন ২০১৪ বিশ্বকাপ, নির্বাচিত হয়েছিলেন সেরা উদীয়মান তারকার পুরষ্কার তালিকায় ।

২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ; source: zimbio

হ্যাঁ, ২০১৪ সাল! বিশ্ব দেখেছিলো আরেক রাফায়েল ভারানকে। কার্লো আলচেলত্তির আগমনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ। স্টার্টিং লাইনাপে সার্জিও রামোসের পাশে রাফায়েল ভারানকে দেখে অবাক হয়েছিলো স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পেরেজও। সে নাটকীয় ফাইনালের কথা বিশ্বের এমন কোনো কোনো ফুটবলপ্রেমী নেই যারা জানেন না।

ডিয়েগো গডিনের গোলে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের ১:০ তে লিড এবং ৯২ মিনিটে সার্জিও রামোসের গোলে রিয়ালের সমতা। ১২০ মিনিটে যখন ম্যাচ গড়ালো স্কোর লাইন তখন রিয়াল ৪:১ অ্যাথলেটিকো, ঐ ম্যাচের পুরোটাই খেলেছিলেন রাফায়েল ভারান।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্সলিগ ট্রফি হাতে; source:Twitter

কার্লো আলচেলত্তির সময়ে নিয়মিতভাবেই দেখা যেতো ভারান কে। বহু আকাঙ্খিত ‘লা ডেসিমা’ জেতার পর রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন ‘রাফায়েল ভারান’ একদিন মাদ্রিদের ক্যাপ্টেন হবে। হয়তো প্রেসিডেন্টে পেরেজের কথা শুনেছিলো ফ্রান্সের কোচ। মাত্র ২১ বছর বয়সে ২০১৪ এর অক্টোবরে ফ্রান্সের ক্যাপ্টেন আর্মব্যান্ড পরেন এ রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। অর্জন করেন ফ্রান্সের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন হওয়ার খেতাব।

ফ্রান্সের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক; source:Eurosports

২০১৫ সালে মাদ্রিদ ট্রফিলেস এবং পরেরবার কার্লো আলচেলত্তির বিদায় দু’মিলিয়ে মাদ্রিদের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। মাদ্রিদের কোচ হলেন কিংবদন্তী জিনেদিন জিদান ‘ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’। এসেই জেতালেন ‘১৬ সালের চ্যাম্পিয়ন্সলিগ, আবারো সেই অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষেই। তবে ইঞ্জুরির কারণে ফাইনাল খেলা হয়নি তার তবুও সেবার চ্যাম্পিয়ন্সলিগে তার পার্ফম্যান্স ছিলো চোখে পড়ার মতো।

তখন ভারান পরতেন মাদ্রিদের ২ নম্বর জার্সিখানা, খেলতেন সময়ের সেরা পর্তুগিজ তারকা পেপের সাথে। ১৬’ সালের ইউরোপিয়ান সুপারকাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জেতে রিয়াল মাদ্রিদ, ঐ প্রতিযোগিতায়ও ভারান ছিলেন অভেদ্য।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
জিজুর সাথে ট্রেনিংএ ভারান; source:Marca

জিদানের মাদ্রিদের গতী ছিলো নক্ষত্রের মতো। যার উজ্জ্বলতা এবং গতীর হিসেব লিখতে শুরু করলে শেষ করতে পারবেন না জগতের কোনো সাহিত্যিক। সেই জিদানই আজকের রাফায়েল ভারানকে মাদ্রিদের দুয়ারে এনেছিলেন আর বলেছিলেন টোকা দিতে।

ভারান খেলছেন মাদ্রিদে। এখানেই তো স্বার্থকতা ২৩ বছরের ঐ ফরাসি যোদ্ধার। যে কিংবদন্তীর গল্প শুনে ফরাসি শিশুরা ঘুমায় আর যে কিংবদন্তীর ছবি দেখে ফরাসিরা ফুটবল উন্মাদনায় ভাসে সে জিনেদিন জিদানের সাথেই তার এবারের অগ্রযাত্রা।

ক্লাব বিশ্বকাপ হাতে ভারান; source:Twitter

পেপে-ভারান দারুণ রোটেশন ২০১৬/১৭ সিজনে, উভয়ে খেলেছিলো ২০ এর অধিক ম্যাচ সবমিলিয়ে। মাদ্রিদ সেবার জিতলো ৫টি ট্রফি, উৎসব চললো দিন শেষে রাত পর্যন্ত। এক কথায় স্বপ্নের মতো একটি সিজন কাটালো রিয়াল মাদ্রিদ এবং রাফায়েল ভারান যার জন্য হয়তো জন্মেছিলেন তিনি নিজে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
ইউরোপিয়ান সুপারকাপ হাতে ভারান; source: the Independent

এরপর ২০১৭/১৮ সিজনের শুরুতে পেপে মাদ্রিদ ছাড়ায় নিয়মিত দলে জায়গা পান ভারান। তবে সার্জিও রামোস, মার্সেলোর ইঞ্জুরি এবং আক্রমণভাগের ব্যর্থতায় মাদ্রিদ লিগ এবং কোপা-দেল রে হারায়। কিন্তু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একক নৈপুণ্যে চ্যাম্পিয়ন্সলিগ জিতে নেয় মাদ্রিদ যেখানে ভারান ছিলেন মাদ্রিদ ডিফেন্সের প্রধান তারকা।

চতুর্থ চ্যাম্পিয়ন্সলিগ ট্রফি সেলিব্রেশনে ভারান ২০১৮ সালে; source:UEFA/Twitter

প্রতিটি ম্যাচে ৭.৫+ রেটিং নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্সলিগের সেরাদের কাতারে চলে যান ভারান। নির্বাচিত হন চ্যাম্পিয়ন্সলিগে সিজনের সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে নামের পাশে ১৫টি ট্রফি এবং ব্যক্তিগত অর্জনে ৫ বার ফিফাপ্রো বিশ্ব একাদশে স্থান, বাকি রইলো তো গোটা একযুগ ক্যারিয়ারের। ডিফেন্ডারদের ক্যারিয়ার একজন উইঙ্গার থেকেও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে সে হিসেবে ধরা যায় আরো ১০ বছর অনায়াসে খেলবে সে হোক সেটা মাদ্রিদে কিংবা অন্যকোথাও।

রাশিয়া বিশ্বকাপে গোল দেয়ার পর ভারান; source:AllFootball

অতপর ডাক এলো জন্মভূমি থেকে, যেতে হবে রাশিয়ায় জাতিকে বিশ্বকাপ উপহার দিতে ফরাসি রক্ষণভাগের প্রধান হিসেবে। বার্সেলোনার মেইনম্যান উমিটি, মিডে পগবা-কন্তে, আক্রমণে গ্রীজম্যান, এম্বাপ্পে সাথে ভয়ঙ্কর হার্নান্দেজের লেপ্টব্যাক হিসেবে খেলাটা বিশ্বকে প্রমাণ করে দিয়েছিলো প্রজন্মের সেরা দল নিয়ে ফরাসিরা রাশিয়ায় গিয়েছিলো বিশ্বকাপ জিতেতে।

তাদের দলে যখন বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার তখন আর কীইবা লাগে? আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, বেলজিয়ামের মতো দলকে রুখে দিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চে যখন জিদান, থিয়েরে হেনরি, মিশেল প্লাতিনিদের সেই ফ্রান্স তখন তাদের গ্রুপপর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত একটুখানি খতিয়ে দেখা যায়।

বিশ্বকাপে ভারান এবং উমিতি; source:Goal.com

বার্সা তারকা সামুয়েল ওমিতির সাথে রিয়াল মাদ্রিদ তারকা রাফায়েল ভারান এবং তরুণ দু’জন ফুলব্যাক সহ ফরাসি দুর্ভেদ্য রক্ষণভাগ গড়েছিলো ৯৮’ বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্স দলের ফুটবলার দিদিয়ের দেশম। আর সেই নিঁখুত-নির্ভুল ডিফেন্সই ফ্রান্সের সফলতার অর্ধেক দাবিদার টুর্নামেন্ট শেষে। ১৫ তারিখ সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত ফাইনালে প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ফ্রান্স জিতলো বিশ্বকাপ তাদের ইতিহাসের দ্বিতীয়বারের মতো, কোচ দিদিয়ের দেশমও গর্বিত।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে ভারান; source:Twitter

আর বর্তমান সময়ের সেরা ডিফেন্ডার রাফাল ভারানের নামের পাশে যুক্ত হলো আরেকটি ট্রফি। এটি মাদ্রিদের হয়ে নয়, নিজের দেশ ফ্রান্সের হয়ে ফুটবলের সর্বোচ্ছ ট্রফি উঁচিয়ে ধরা, ভারানের ক্যারিয়ার যে এখানেই স্বার্থকতা। সেই সাথে ১১তম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্সলিগ এবং বিশ্বকাপ উভয় জেতা ফুটবলার ভারান। ‘১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্সলিগ এবং বিশ্বকাপ উভয়টাই জিতে গড়লেন অমর কীর্তি যার তুলনা আসলেই হয় না।

রাফায়েলের স্বপ্নের বিশ্বকাপ; source:Real Madrid Official

প্রথম থেকে এই পর্যন্ত বিশ্লেষণ করুণ আর বলুন একজন ফরাসি ডিফেন্ডারের নাম যার অর্জন, পার্ফম্যান্স ভারান থেকেও ভালো এবং গৌরবময়। মাত্র ২৫ বছরে ক্লাব ফুটবলের সকল ট্রফি জিতে তাক লাগিয়েছিলেন বিশ্বকে, খেলছেন বিশ্বের সেরা ক্লাবের হয়ে। বিশ্ব তখন জিজ্ঞাসা করেছিলো দেশের হয়ে জিতেছো কি বলবে? আজকে সময় হয়েছে বিশ্বকে জানানোর সোনালি ট্রফিটা চুমু খেয়েছে ফ্রান্সের লিলি শহরের বুড়ো গেস্টন এবং অ্যান্নি দম্পতির ছেলে যার কাঁধে দিদিয়ের দেশম তুলে গিয়েছিলেন ফরাসি রক্ষণভাগের বিরাট দায়িত্ব।

বিশ্বকাপ দেখে থাকলে ফ্রান্সের ৪ নাম্বার জার্সির সুপারম্যানকেও আপনি দেখে থাকবেন। দেখে থাকবেন তার অমানবিক গতি এবং ট্যাকেলগুলো যার মূলে ছিলো ফরাসিদের হয়ে কিছু জেতার তীব্র ক্ষুধা। মাত্র ২৫ বছর বয়সে সর্বকালের সেরা মালদিনির নামের পাশেও ছিলো না ৪টি চ্যাম্পিয়ন্সলিগ ট্রফি কিংবা ১টি বিশ্বকাপ।

ভারানের সকল ট্রফি; source:Careerm

বাস্তব জীবনে ভারান খুব ঠান্ডা মেজাজি এবং চুপচাপ থাকেন। বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের সাথে আর ট্রেনিং গ্রাউন্ডে সময় কাটান। সার্জিও রামোস তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, কারণ রামোস থেকে শিখেন সবকিছু। বিয়ে করেছেন নিজের হাইস্কুল প্রেমিকাকেই।

ভারান এবং তার সহধর্মিণী; source:mujerhoy.com

২০১৫ সালে নিজের বাল্যকালের প্রেমিকা ক্যামিল্যি টায়েটগাটকে বিয়ে করেন এ তরুণ ফরাসি ডিফেন্ডার। উল্লেখ করেছিলেন এক সংবাদ-সম্মেলনে পরিবার-ফুটবলকে দেয়ার পর যতটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে ক্যামিল্যি সেটার সবটুকুর দাবিদার। হ্যাঁ, একজন মহান খেলোয়াড় হতে হলে একজন মহীয়সীর অবদান থাকা অনস্বীকার্য, হয়তো ভারানের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু ১০ বছর পর যখন রাফায়েল ভারানের নামের পাশে উইকিপিডিয়ায় আরো ১৫টি ট্রফি থাকবে তখন লেখকরা ভারানের সাথে সে মহীয়সীকে যুক্ত লিখবেন হাজারো হেডলাইন।

সুদর্শন ভারান; source:Twitter

রাফায়েল ভারানকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হচ্ছে তার ডিফেন্সিভ স্কিল। আধুনিক ফুটবলের সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো ১.৫৯ মিটার উচ্চতা, ৮৩ কেজি ওজন সাথে সুঠাম দেহ। অনেকে তার মাঝে মালিদিনিকে খুঁজে পান, কিন্তু মালিদিনি সবার উপরে তাই তার সাথে তুলনা হবে না ভারানের। তবে প্রজন্ম যদি মালদিনির সামান্য ডিফেন্সিভ স্কিল দেখতে চায় তাহলে নিশ্চিন্তে উপভোগ করতে পারে রাফায়েল ভারানের খেলা। অ্যাকটিভ ডিফেন্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে গতিসম্পন্ন রাফায়েল ভারান, তার গতিই তার সফলতার মূল কারণ।

ভারানের সকল মেজর ট্রফি; source:Marca

তার একটি বিশেষ গুণের কথা জিদান একাধিকবার বলেছেন আর সেটি হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম এবং ম্যাচের শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত নিজেকে প্রথম মিনিটের মতো সজীব এবং উদ্যম রাখার মানসিকতা। এ কারণগুলোই তাকে করেছে বর্তমান বিশ্বের সেরা। ফ্রান্সের অধিনায়ক এখন গোলকিপার হুগো লরিস, তারপর ক্যাপ্টেন হবেন রাফায়েল ভারান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *