দেখতে দেখতে রাশিয়া বিশ্বকাপ প্রায় শেষ হতে চলছে। গ্রুপ পর্বের পর দ্বিতীয় রাউন্ড এবং কোয়ার্টার ফাইনালও শেষ। বাকি আছে এখন শুধুমাত্র সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল খেলা। তবে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপ অন্য বিশ্বকাপের চেয়ে একটু ভিন্ন হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ চারে নেই জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেনের মতো ফেবারিট কোনো। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানি। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে আর্জেন্টিনা এবং কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিল।
দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে রাশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে স্পেন এবং উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে পর্তুগাল। ফলে রাশিয়া বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার মতো কিংবদন্তী খেলোয়াড়ের বিদায় হয়েছে অনেক দ্রুত। এছাড়া রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনটি ম্যাচ এবং কোয়ার্টার ফাইনালের রাশিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচটি ট্রাইবেকারে গড়িয়েছে ফলে গোলরক্ষকরা নায়ক বনে গেছেন এই চার ম্যাচে। রাশিয়া বিশ্বকাপের শুধুমাত্র নক-আউট পর্ব নয় গ্রুপ পর্বও ছিলো অনেক বেশি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’।
সেমিফাইনালে চার দলের মধ্যে কোন দুইটি দল রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে টিকিট কাটবে সেটা নিয়ে যেমন জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই, তেমনি ফুটবল বোদ্ধাদের ভাবনার শেষ নেই কে পেতে যাচ্ছেন রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার ‘গোল্ডেন বল’। ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটি নির্ধারণ করা হয় মূলত সাংবাদিকদের ভোটের মাধ্যমে। ফিফার টেকনিক্যাল কমিটি সংক্ষিপ্ত তালিকা বিভিন্ন দেশের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিকট প্রকাশ করেন সেখান থেকে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভোটের মাধ্যমে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করেন।
ফুটবল বিশ্বের গৌরবান্বিত এই ব্যক্তিগত পুরষ্কারটি পূর্বে পেলে, গারিঞ্চা, ইয়োহান ক্রুইফ, ববি চার্লটন, দিয়েগো ম্যারাডোনা, অলিভার কানের মতো মহারথীরা জিতেছেন। সর্বশেষ ২০১৪ বিশ্বকাপে ‘গোল্ডেন বল’ জিতেছেন আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি। এবার মেসি, রোনালদো, ইনিয়েস্তাদের এই পুরস্কার জেতার সুযোগ নাই কারণ তাদের দল অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন বল কার হাতে উঠবে সেটি বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, গোল্ডেন বল জয়ের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দী হিসেবে যেসব খেলোয়াড়ের নাম থাকতে পারে।
লুকা মডরিচ
ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার ইউরোপিয়ান ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত এক নাম। তিনি তার পায়ের জাদু দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছেন অগণিত ফুটবল ভক্তকে। ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার তার ফুটবলশৈলী রাশিয়া বিশ্বকাপেও প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার আর্মব্যান্ড তুলে দেওয়া হয়েছে তার হাতে। তার প্রতি সেই আস্থা খুব ভালোভাবে পূরণ করে যাচ্ছেন তিনি। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ক্রোয়েশিয়া ইতিমধ্যে সেমিফাইনালে তুলেছেন। তার নেতাসুলভ পারফর্মেন্সের কারণেই গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়া নাইজেরিয়া এবং আর্জেন্টিনাকে একেবারে বিধ্বস্ত করেছে।
আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে পরাজিত করার পেছনে তার অবদান ছিলো অনেক বেশি। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বক্সের বাইরে থেকে গোলার মতো শটে দূর্দান্ত এক গোল করেছেন। এছাড়া তিনি পাঁচ ম্যাচ খেলে দুইটি গোল করেছেন। গ্রুপ পর্বে নাইজেরিয়া এবং আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তিনি দলকে জেতানোর পাশাপাশি ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এর পুরষ্কারও পেয়েছেন। পাঁচ ম্যাচে তিনি প্রায় আড়াই শতাধিক পাস দিয়েছেন। প্রতিটি ম্যাচে গড়ে তিনি ৫৯.৪টি করে পাস করেছেন যার মধ্যে ৭৫.৪ ভাগ পাস ছিলো নিঁখুত। ক্রোয়েশিয়ার এই মিডফিল্ডার রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত যে পারফর্মেন্স করেছেন সেটা থেকে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ‘গোল্ডন বল’ পাওয়ার বড় দাবিদার।
এডেন হ্যাজার্ড
রাশিয়া বিশ্বকাপে এবার শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবে মস্কোতে পা রাখে ইউরোপের ‘রেড ডেভিলস’ বেলজিয়াম। শিরোপা প্রত্যাশা নিয়ে এখন পর্যন্ত অপরাজিত হিসেবে সেমিফাইনালে উঠেছে বেলজিয়াম। দূরন্ত, দূর্দান্ত এবং অনবদ্য এই বেলজিয়ামকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এডেন হ্যাজার্ড। বেলজিয়ামের হয়ে তিনি প্রতিটি ম্যাচেই খেলেছেন এবং দলের প্রয়োজনে কখনো নিচে নেমে খেলেছেন আবার কখনো দলের হয়ে গোল করেছেন।
দ্বিতীয় রাউন্ডে বেলজিয়াম যখন জাপানের কাছে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে তখন দলের ত্রানকর্তা হিসেবে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং দলকে উজ্জীবিত করেন এডেন হ্যাজার্ড। শেষ পর্যন্ত বেলজিয়াম জাপানের কাছে ৩-২ গোলে জয় নিছিয়ে নিয়ে মাঠ ছাড়ে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ব্রাজিলের বিপক্ষে বেলজিয়াম ছিলো আরো অনবদ্য। ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে এডেন হ্যাজার্ডের দল সেমিফাইনালে পা রেখেছে। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচ খেলে হ্যাজার্ড ২টি গোল নিজে করেছেন এবং আরও ২টি গোল অন্য খেলোয়াড়কে দিয়ে করিয়েছেন।
পানামা এবং তিউনিসিয়ার বিপক্ষে অনবদ্য ফুটবল খেলে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হয়েছেন। এখন পর্যন্ত এডেন হ্যাজার্ড গোলমুখে পাঁচটি শট নিয়েছেন যা থেকে তিনি ২টি গোল করেছেন। এছাড়া বেলজিয়ামের ৫ ম্যাচের সবগুলোতে জয়ের পেছনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পাস করেছেন তিনি। বেলজিয়ামের হয়ে পুরো রাশিয়া বিশ্বকাপে তার অনবদ্য পারফর্মেন্স তাকে গোল্ডেন বল জয়ীর সম্ভাব্য তালিকায় স্থান করে দিতে পারে। হয়তো শেষ পর্যন্ত জিতেও নিতে পারেন।
নেইমার
ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের পোস্টারবয় নেইমারকে ঘিরে উত্তেজনা, উন্মাদনা, আশা, ভরসা সব ছিলো ব্রাজিলের ভক্ত এবং সমর্থকদের। দলের হয়ে তিনি দারুণ খেললেও শেষ পর্যন্ত তাকে বিদায় নিতে হয়েছে বেলজিয়ামের কাছে হেরে। তবে দল হিসেবে ব্রাজিল যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপে দারুণ করেছেন, তেমনি নেইমারের একক পারফর্মেন্সও ছিলো নজরকাড়া।
রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি প্রমাণ করেছেন কেন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আশানূরূপ খেলতে না পারলেও গ্রুপ পর্বের পরের দুইটি ম্যাচে তিনি দারুণ করেছেন। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডে মেক্সিকোর বিপক্ষেও তার পারফর্মেন্স ছিলো অনবদ্য। নিজে এক গোল করেছেন এবং ফিরমিনোকে দিয়ে আরেক গোল করিয়ে ২-০ গোলের জয় তুলে নিয়েছেন।
কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ভালো খেলেও প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া এবং ভাগ্যের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। পাঁচ ম্যাচে ২টি গোল নিজে করেছেন এবং একটি অ্যাসিস্ট করেছেন। এছাড়া প্রতি ম্যাচে গড়ে ৫০টি করে সফল পাস দিয়ে প্রায় দুইশত সফল পাস করেছেন।
লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যখন দ্বিতীয় রাউন্ড হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেন, নেইমার তখন অনবদ্য পারফর্ম করে দলকে কোয়ার্টারে নিয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে নজরকাড়া পারফর্মেন্স তাকে ‘গোল্ডেন বল’ জয়ের দৌড়ে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত জিততে পারবেন কিনা, সেটা সময়ই বলে দিবে।
কিলিয়ান এমবাপ্পে
রাশিয়া বিশ্বকাপের সবটুকু আলো নিজের উপর কেড়ে নিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়েছেন গত মৌসুমে পিএসজিতে খেলা এমবাপ্পে। গ্রুপ পর্বে পেরুর বিপক্ষে প্রথম গোল করার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনাকে একাই হারিয়ে দিয়েছেন। আর্জেন্টাইন রক্ষণকে ছেলেখেলা করেছেন তার দূরন্ত গতি এবং নিঁখুত শটে মাধ্যমে।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুই গোল করার পর বিশ্বকাপের স্পটলাইট পড়ে তার উপর। প্রতিপক্ষরা তাকে আটকানোর জন্য বাড়তি ছক কষতে শুরু করে। সেই বাড়তি ছকের কারণে কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের রক্ষণের কাছে বোতলবন্দী হয়ে থাকতে হয় তাকে। তবে এর মধ্যেও তিনি ঝলক দেখিয়েছেন।
ফ্রান্সকে সেমিফাইনালে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। সেই সাথে তিনি পেলের পরে দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে দুই গোল করার রেকর্ড গড়েছেন। পাঁচ ম্যাচে তিনি ৩ গোল করেছেন এবং এই তিন গোল করার জন্য তিনি গোলপোস্টে মাত্র ৫টি শট নিয়েছেন। রক্ষণভাগকে কিভাবে চূর্ণ করতে হয় সেটি খুব ভালোভাবে করে দেখিয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। তিনি এখন পর্যন্ত যে ৩টি গোল করেছেন তার প্রত্যেকটি তিনি বক্সের মধ্যে থেকে করেছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জয়ের সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে এমবাপ্পে নিজের ইতিমধ্যে সম্ভাব্য তালিকায় তুলেছেন বলেই ধারণা করা যায়।
Featured Image: standard.co.uk