রেকর্ডসংখ্যক নিয়োগের পরও শূন্য পদ দেড় লাখ
গত অর্থবছরে সরকার ৮২ হাজার ৫৮৯টি শূন্য পদে নিয়োগ দিয়েছে, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই বিপুলসংখ্যক নিয়োগের পরও গত অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় শূন্য পদ বেড়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। নতুন পদ সৃষ্টির পাশাপাশি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ায় শূন্য পদও বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে সন্তান চাকরি পাবে—এটাই মনে করেন মা-বাবা। কিন্তু বাস্তবে অনেকেই চাকরি পান না। চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে একসময় দেখেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স তাঁদের চলে গেছে। তখন চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয় পুরো পরিবার।
২০১৫ সালের শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার বেশি। স্নাতক পাস বেকার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। যেখানে এসএসসি পাস বেকারের সংখ্যা সাড়ে ৭ শতাংশ। এক মাস কাজের জন্য প্রস্তুত থেকে এক সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার।
এত বেকারের এই দেশে সরকারি পদ শূন্য কেন, জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণে শূন্য পদে নিয়োগ বিলম্বিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগ দিতে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সেখানে কিছু সময় ব্যয় হয়। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লোক নিতে ভয় পান। কারণ, লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হলেই রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করে অনেকেই ঝামেলায় যেতে চান না।
গত ২৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শূন্য পদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৬, যা আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে শূন্য পদ ছিল ৩ লাখ ৯ হাজার ৫৯১টি। ১০ হাজারের বেশি শূন্য পদ রয়েছে এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা ৯টি। এদিকে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ২০ নভেম্বর সংসদে জানিয়েছেন, সরকারের শূন্য পদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১।
গত অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দপ্তরে ৮২ হাজার ৫৮৯টি পদে নিয়োগ দিয়েছে, যা ২০০৯ সালের পর বছরওয়ারি হিসাবে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৯০৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে।
উপজেলা ভূমি অফিসের জন্য ৪০০ কানুনগো পদে নিয়োগ দিতে ২০০৪ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ভূমি মন্ত্রণালয়। লিখিত পরীক্ষা সময়মতো হলেও মৌখিক পরীক্ষা আর হয়নি। কয়েকজন প্রার্থী বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান। আদালত সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিলে আপিল করে মন্ত্রণালয়। একজন প্রার্থীর অভিযোগ, ৪০০ কানুনগো নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র প্রায় ৮০০ প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। চাকরি দিতে না পারলে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। এই জটিলতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিয়োগপ্রক্রিয়া ঝুলিয়ে দেন। ২০০৪ সালে কানুনগোর শূন্য পদ ৪০০-ই ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে শূন্য পদ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ জনে। কানুনগোর অনুমোদিত পদ ১ হাজার ৬০০টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১৩টি শ্রেণিতে জনবল নিয়োগের জন্য ২০১৪ সালে প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পরে ২০১৫ সালে পুনরায় সংশোধিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। দুই শতাধিক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দেড় বছর পর দুই ধাপে লিখিত পরীক্ষা নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট। লিখিত পরীক্ষার পাঁচ মাস পর মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পছন্দের প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তা স্থগিত করা হয়।
প্রায় প্রতিটি নিয়োগের চিত্র একই রকম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাকরিপ্রার্থীরা এসব পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের পছন্দের প্রার্থীরা সুবিধা করতে না পারলেই নানা ছুতোয় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। অনেকে ধারদেনা করে এ চাকরির পেছনে ছোটেন।
এ বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশনেরðচেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়োগবিধির জটিলতার কারণে অনেক সময় পদ শূন্য থাকে। তা ছাড়া চাকরি থেকে অবসরের কারণেও শূন্য পদ বেড়ে যায়। নতুন পদ সৃষ্টির কারণে পদ শূন্য হয়। পদ শূন্য থাকার আরও একটি কারণ পদোন্নতি। যা-ই হোক, আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি সর্বশেষ শূন্য পদ অন্তর্ভুক্ত করেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ খুব বেশি হচ্ছে। এ কারণেও নিয়োগ বিলম্ব হয়। আগে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য হস্তক্ষেপ করা হতো। বর্তমানে সব শ্রেণির চাকরির জন্যই হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। স্কুলের দপ্তরি নিয়োগের জন্যও সাংসদেরা হস্তক্ষেপ করেন। সম্প্রতি নেত্রকোনায় স্কুলের দপ্তরি নিয়োগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁকে পছন্দ হয়নি স্থানীয় সাংসদের। পরে সাংসদের কথামতো নিয়োগ দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে।
নিয়োগ বিলম্বের আরও একটি কারণ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁরা বলেছেন, আদালতের নির্দেশে সামরিক শাসনামলে জারি করা বিধি বাতিল হয়েছে। এ কারণে দ্য বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস নন-মেডিকেল অফিসার্স অ্যান্ড এমপ্লয়ার্স রিক্রুটমেন্ট রুল, ১৯৮৫ নিয়োগবিধির বৈধতা নেই। এই নিয়োগবিধির কারণে আটকে আছে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ২০ হাজার জনবল নিয়োগের কাজ। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক দ্রুত নিয়োগবিধি শেষ করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছেন।
নিয়োগবিধি বাতিলের কারণে আটকে আছে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রায় ৪ হাজার নিয়োগ। খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়োগবিধি নতুন করে জারির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করি শিগগিরই নিয়োগ দিতে পারব।’
সরকার ২০১৪ সালে পদ সৃষ্টিতে বিলম্ব, শূন্য পদের কারণ এবং দ্রুত শূন্য পদ পূরণের উপায় খুঁজে বের করার জন্য একটি সচিব কমিটি গঠন করেছিল। এ কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে পদ শূন্য থাকার কারণ জানতে চায়। তারা জানিয়েছে, পদ শূন্য থাকার অন্যতম কারণ হলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে বিলম্ব হওয়া। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ শাখার অনুমোদন পাওয়ার পর একই মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। এতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতাকেও দায়ী করেছে। পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার বিলম্বকেও দায়ী করেছে তারা। তা ছাড়া পদ সৃষ্টির যে মূল আদেশ, তা মন্ত্রণালয়গুলোতে থাকে না। নিয়োগবিধি সংশোধনে সময়সীমা অনুসরণ করে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসবের সঙ্গে চাকরিবিধিও যুগোপযোগী নয় বলে উল্লেখ করেছে সচিব কমিটি।
সরকারের জনবল বাছাইয়ের মূল কাজটি করে পিএসসি। এই সংস্থাও জনবল বাছাইয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বিসিএস শেষ করতে এক বছরের বেশি সময় লাগানো উচিত নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ ধরনের পরীক্ষার জন্য এক বছরের বেশি সময় নেওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিটি পরীক্ষায় দীর্ঘ সময় লাগানো হয়।’
বেশিশূন্য পদ যেসবমন্ত্রণালয়ে
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৪৪,৬৮১
জননিরাপত্তা বিভাগ ৩৬,৫৪৭
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২৯,৭৯২
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ১৫,১০৯
রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৪,৩০৪
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১৩,৫৯৯
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৩,২০৩
কৃষি মন্ত্রণালয় ১২,৬৬২
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ১১,৬৮৬
Source: Prothom-Alo