তখন ১৮৭১ সাল। মন্ট্রিল জেনারেল হাসপাতালের এক ডাক্তারী ছাত্র- পরীক্ষায় পাস করা, ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, কি করবেন, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন – এসব নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়েছিলেন। তখন তিনি টমাস কার্লাইল এর লেখা একুশটা কথা পড়েছিলেন যা তার ভবিষ্যৎ জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। যে কথা গুলো পড়েছিলেন : “অস্পষ্টতায় ভরা দূরের কিছুর চেয়ে কাছের স্পষ্ট কিছু দেখাই আমাদের দরকার”।
পরবর্তীতে সে ছাত্রটি হয়েছিলেন তাঁর কালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসক। ইংল্যান্ডের রাজা তাঁকে নাইট উপাধি দেন। মৃত্যুর পর তাঁর জীবনী প্রকাশের জন্য দুটো বিরাট বইয়ে ১৪৬৬ টি পাতা লেগেছিল। ঐ চিকিৎসক হলেন “স্যার উইলিয়াম অসলার”।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাঁর এই সাফল্যের গোপন রহস্য কি? তিনি বলেছিলেন “এটা হল আমার দৈনিক জীবন যাপনের ফল”। কথাটার অর্থ কি?
একবার তিনি এক বক্তৃতায় তার ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন “আমি একবার এক বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজে আটলান্টিক পার হয়। সেখানে ক্যাপ্টেন একটা বোতাম টিপতেই আশ্চর্য এক কান্ড ঘটে। কিছু যন্ত্রপাতির শব্দ জেগে ওঠার সংগে সংগে জাহাজের প্রতিটি অংশ একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তোমরা জাহাজের চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্যভাবে তৈরী। তোমাদের সব যন্ত্রপাতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রন কর যাতে দৈনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হও – এতেই তোমরা নিরাপদে চলতে পারবে। একটা বোতাম টিপে জীবনের লোহার দরজাগুলো দ্বারা রুদ্ধ করে দাও অতীতকে। আর একটা বোতাম টিপে বন্ধ করে দাও নবাগত ভবিষ্যতকে। ভবিষ্যতের ভারের সংগে অতীতের বোঝা যুক্ত হয়ে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতকে অতীতের মতই বন্ধ করে দাও। ভবিষ্যত হল আজ। আগামীকাল বলে কিছুই নেই। মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানসিক দুশ্চিন্তা করে। তাই অতীত আর ভবিষ্যতকে রুদ্ধ করে রোজকার জীবন নিয়েই বাঁচতে চেষ্টা কর”।
স্যার অসলার কি তবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরী থাকতে বারন করেছেন? না, কখনই না। তিনি বলেছিলেন, “ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়ার সবচেয়ে সেরা পথ হল সমস্ত বুদ্ধি, ক্ষমতা আর আগ্রহ দিয়ে আজকের কাজ করে যাওয়া”।
একবার এক সামরিক ডাক্তার এক হতাশ সৈন্যকে বলেছিলেন: “আমি চাই জীবনটাকে বালিঘড়ি মনে কর। তুমি জানো বালিঘড়িতে হাজার হাজার বালুকনা থাকে, তারা ধীরে ধীরে যন্ত্রটার ভিতরের ছোট ফুটো দিয়ে পড়তে থাকে। যন্ত্রটা না ভেংগে আমরা একসংগে বেশী বালি ঢোকাতে পারি না। তুমি বা আমি সকলেই বালিঘড়ির মত। সকালে আমরা কাজ শুরু করার সময় শত শত কাজ থাকে, সে সব একে একে করতে না গেলে বালিঘড়ির মত অবস্থা হবে, তাতে আমাদের শরীর ও মন দুটোই ভেংগে পড়বে। বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই নতুন জীবন”।
বিখ্যাত রোমান কবি হোরেসের একটা লেখা :
“সেই মানুষই সবার চেয়ে সুখী,
যিনি আজকের দিনকে নিজের বলতে পারেন।
তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি বলেন
আগামীর বিপদকে ভয় করি না, কারণ আমি আজ বেঁচেছি …”।
“আমরা সবাই দিগন্তপারের কোন মায়া গোলাপের স্বপ্নে আচ্ছন্ন। কিন্তু জানালার পাশে যে অসংখ্য গোলাপ ফুটে রয়েছে তা আমরা দেখি না”।
কালিদাসের একটা কবিতা স্যার অসলার তাঁর ডেস্কে রেখে দিতেন। কবিতার ভাব এই রকম “আজকের জীবনই সবকিছু, এতে রয়েছে জীবনের পরিপূর্ণতা। কারণ গতকাল তো শুধু স্বপ্ন আর আগামীকাল সে তো কল্পনা, শুধু আজকের মধ্যেই রয়েছে বেঁচে থাকার আনন্দ। আজ ভাল করে বেঁচে থাকলেই গতকালই সু্খ স্বপ্ন হয়ে ওঠে আর আগামীকাল হয় আশায় ভরপুর। তাই আজকের দিনকেই সানন্দে গ্রহন কর”।
আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা আজকের সুন্দর দিনটিকে হেলায় ভাসিয়ে দিয়ে আগামি দশ বছর পরের কথা চিন্তা করেন। দশ বছর পরে বাড়ি, গাড়ি, অর্থ, প্রাচুর্যের কথা ভেবে আজকের দিনটিকে নষ্ট করেন। আজকের কাজটি কাল করব, পরশু করব- এমন ভেবে ভেবে হয়ত আর কাজটি করা-ই হয় না। কারণ কেউ জানেনা আগামীকাল কি হবে তার জীবনে! অথচ আজকের দিনটিকেই যদি সুন্দর ভাবে পরিচালনা করা যেত তাহলে আগামীকাল আশায় ভরপুর হয়ে উঠত, আগামীকালের জন্য বেঁচে থাকার সাহস সঞ্চয় হতো। তাই অতীত আর ভবিষ্যতকে লোহার কপাটে আবদ্ধ করে রাখুন। শুধু রোজকার জীবন যাপন করুন। তাহলেই জীবনে প্রকৃত সুখ খুজে পাবেন। আর জীবনে সুখী হওয়া-ই তো আমাদের আসল উদ্দেশ্য।
মো: দেলোয়ার জাহান সোহাগ
সভাপতি, চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব
[তথ্য সূত্র: ডেল কার্নেগীর রচনাসমগ্র]