১৯৭১ সালের ১ আগস্ট বিকেলবেলা নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মঞ্চে গটগট করে উঠে আসছিলেন গিটার আর হারমোনিকা হাতে ৩০ বছরের যে যুবক, তিনি আসলে খুব নার্ভাস বোধ করছিলেন। এত লোকের সামনে এর আগে কখনোই তিনি গান করেননি। তাঁকে দেখে কনসার্টের প্রধান আয়োজক জর্জ হ্যারিসন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। হ্যারিসন ধরেই নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত হয়তো ওই যুবকের টিকিটি দেখা যাবে না। আগের দিন রিহার্সেলের সময় তাঁর অস্বস্তি দেখে তেমনই মনে হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নার্ভাস যুবক এসেছিলেন। ৪০ হাজার দর্শকের সামনে একে একে বেশ কয়েকটি গান তিনি গেয়েছিলেন, যার
মধ্যে নয় বছর আগে লেখা তাঁর বিখ্যাত ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’গানটিও ছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তের ওই সাড়া জাগানো সংগীত আসর অনেক দিক থেকেই ছিল ব্যতিক্রমী। আর কনসার্টের ওই মুখচোরা যুবক, যাঁর নাম বব ডিলান, ৪৫ বছর পর নিজেই এক ব্যতিক্রমী ঘটনার জন্ম দিলেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এটা ব্যতিক্রমী এবং অবশ্যই বিস্ময়কর ঘটনা; কেননা, কোনো গান রচয়িতাকে এযাবৎ দেওয়া হয়নি নোবেল পুরস্কার। এত দিন তা কবি আর ঔপন্যাসিকদেরই একচ্ছত্র দখলে ছিল। এমনকি একবার এক দার্শনিকের কপালেও জুটেছিল এ পুরস্কার (বার্ট্রান্ড রাসেল, ১৯৫০)।
পুরস্কারের প্রশংসাপত্রে নোবেল কমিটি বলেছে, ডিলানকে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ‘আমেরিকার মহান সংগীত-ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য।’
যে লোককে গোটা বিশ্ব জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে চেনে, তাঁর হাতে সাহিত্যে নোবেল তুলে দিলে অনেকেরই যে ভ্রু কুঁচকে যাবে, সেটা পুরস্কারের আয়োজকেরা আগাম অনুমান করেছেন। সে জন্য গতকাল স্টকহোমে পুরস্কার ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ড্যানিয়ুস বলেন, তিনি আশা করছেন, এই সিদ্ধান্তের জন্য একাডেমিকে সমালোচনা করা হবে না। ড্যানিয়ুস আরও বলেন, ডিলানকে বেছে নেওয়া বিস্ময়কর মনে হতে পারে বটে, তবে ‘পেছন ফিরে তাকালে আপনারা (গ্রিক কবি) হোমার ও সাপফোকে দেখতে পাবেন। তাঁরা কাব্যিক লেখা লিখেছেন, যেগুলো লেখা হয়েছে কেবল শোনার জন্য, পরিবেশন করার জন্য, মাঝে মাঝে যন্ত্রানুষঙ্গে। বব ডিলানের ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। তাঁকে পড়াও যায় এবং পড়াই উচিত। ইংলিশ ঐতিহ্যমাফিক তিনি এক মহান কবি।’
পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের উইলে বলা আছে, সাহিত্যে নোবেল পাবেন সেই লোক, যিনি ‘সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ অভিমুখে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন’। ডিলান যে এই শর্ত পূরণ করেন, সেটা বোঝানোর জন্য গতকাল ১৮ সদস্যের বাছাই কমিটিকে এই তথ্যটুকুও যোগ করতে হয়েছে যে, ডিলানের গানের লিরিকস বই আকারে বের হয় এবং সেগুলোর একাধিক সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। তা ছাড়া ডিলান টারানটুলা নামে একটি গদ্যকবিতার বইসহ নানা রকম নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এর বাইরে তিনি যে একজন সক্রিয় পেইন্টার, নোবেল ঘোষণায় সে কথাও বলা হয়েছে।
নোবেল কমিটির এই ঘোষণায় কিছুটা স্বীকারোক্তিমূলক সুর ধ্বনিত হলেও নোবেল পুরস্কারের জন্য ডিলানের নাম অন্তত ২০ বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল। তাঁর গানের কথা যে উৎকৃষ্ট কবিতা, এটা এমনকি অনেক প্রথিতযশা কবিও স্বীকার করছিলেন। তাঁর গানে সুর ছাপিয়ে কথা অনেক বেশি করে ধ্বনিত হয়। নিজেও তিনি ছিলেন মার্কিন কবি ডিলান টমাসের ভক্ত। ডিলান নামটাও ওই কবির কাছ থেকে ধার করা।
‘ব্লোয়িন ইন দ্য উইন্ড’ আর ‘টাইমস দে আর-আ-চেঞ্জিং’ গান ষাটের দশকে আমেরিকায় সিভিল রাইটস আন্দোলনে জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিল। শুরুতে ফোক মিউজিকের ঘরানায় থাকলেও সেই ধারা ভেঙে বেরিয়ে আসেন ডিলান। এরপর কেবলই প্রথা ভেঙেছেন। ‘রোলিং স্টোন’ গানের গড়িয়ে পড়া পাথরখণ্ডের মতোই নিরন্তর এক বিদ্রোহী মেজাজে গড়িয়ে গেছেন, কোনো শেওলা জমতে দেননি গায়ে। ২০০৪ সালে বেরিয়েছে তাঁর তিন পর্বের আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব ক্রনিকলস: ভলিউম ওয়ান,যার শেষ অধ্যায়ে তিনি বর্ণনা করেছেন, মার্কিন ব্লুজ গায়ক রবার্ট লেরয় জনসনের গান শুনে তিনি নিজে গান লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। মার্কিন কবি এন্ড্রু মোশন তাঁর গানের কথাকে কবিতা হিসেবেই পড়তে বলেছেন।
‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’
কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানায়?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।
কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাবার আগে?
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শেকল পরে?
কবার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে?
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে।
কত হাজারবারের পর আকাশ দেখা যাবে?
কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে?
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।
SOURCE: PROTHOM ALO