আমাদের নিত্যদিনের অনেক অভ্যাস গড়ে উঠেছে চারপাশ দেখতে দেখতেই। অনেক কিছুই আমরা নিজের মধ্যে ধারণ করি পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বা বলা যায় পারিবারিক কারণে। এমন অনেক অভ্যাসই আছে যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই তা আলিঙ্গন করে বেঁচে আছি। নতুন বছরে চলুন এমন কিছু অভ্যাসের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করি বা অন্যকে মুক্ত হতে সাহায্য করি, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তবে জেনে নিই এমন ১০টি অভ্যাস সম্পর্কে যা আমাদের ত্যাগ করা প্রয়োজন অতি শীঘ্রই।
১. মোমবাতির ব্যবহার
সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় জানা গেছে, কয়েক প্রজাতির মোমবাতি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সৌন্দর্য বর্ধনে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে বা বিভিন্ন উপাসনালয়ে আমরা মোমবাতির ব্যবহার দেখতে পাই। যে সকল মোমবাতি প্যারিফিন ওয়াক্স নামক তৈল জাতীয় দ্রব্য দিয়ে তৈরী, তা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই ধরণের মোমবাতিতে অ্যালকিন, এক্রোলিন, টলুইন, ন্যাপথলিন, ফর্মালডিহাইড ইত্যাদি পদার্থ উপস্থিত থাকে যা এলার্জি, শ্বাসকষ্ট এমনকি ক্যান্সারের জন্যও দায়ী হতে পারে।
মোমবাতির শলতে অনেক সময় লেড নামক দ্রব্য দিয়ে তৈরী করা হয়ে থাকে যা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহার কমে এসেছে। জিংক, তুলা কিংবা সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে শলতে তৈরী করা হয়ে থাকে যা নিরাপদ।
কিন্তু যদি মোমবাতির প্রতি আকর্ষণ থাকে প্রবল এবং তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা হয়ে যায় কঠিন তবে সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী মোমবাতি ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন মৌচাক হতে তৈরী মোম। মোমবাতিতে আলাদা সুগন্ধী যোগ করতে বাতি জ্বলানোর আগে নিজের পছন্দের কয়েক ফোঁটা গন্ধসার তেল দিয়ে নিতে পারেন। এর ফলে ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকলো না, ইচ্ছাও পূরণ হলো।
২. নিয়মিত গোসল
ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত গোসলের প্রয়োজনীয়তা শেখানো হয় পরিবার থেকেই। বড় থেকে ছোট সকলেই নিয়ম করে প্রতিদিন গোসল করা যেন প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এই নিয়মকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তারা বলেছেন প্রতিদিন গোসলে আমাদের দেহের বিভিন্ন রকম ক্ষতি হতে পারে। প্রতিদিনের গোসল আমাদের শরীরের মাইক্রোবায়োম এবং মাইক্রো অর্গানিজমকে ধ্বংস করে যা পরবর্তীতে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। তাছাড়া গোসলের সময় ব্যবহৃত বিভিন্ন সাবান এবং শ্যাম্পু নষ্ট করে আমাদের দেহের ইকোসিস্টেম। প্রতিদিনের গোসলে আমাদের ত্বকে ব্রণ, মেছতা ইত্যাদির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
লেখক জেমস হাম্বলিন বলেন, প্রথম কয়েক সপ্তাহ গোসল না করার পর যে দূর্গন্ধ আমাদের শরীর থেকে আসে, তা আসলে আমাদের নষ্ট হওয়া মাইক্রোবায়োমের ফলাফল। ধীরে ধীরে এটি শরীরের সাথে খাপ খেয়ে যায় এবং একজন মানুষের শরীরের গন্ধে পরিণত হয় সেই দূর্গন্ধ।
তাই একেবারেই গোসল বাদ না দিয়ে, অন্তত প্রতিদিনের নিয়মটা ভঙ্গ করে শুরু করাই যায়।
৩. টাইট জিন্স
বর্তমান যুগে আঁটসাঁট পোশাক এক ধরণের ফ্যাশন। এইসব পোশাকের মধ্যে টাইট জিন্স অন্যতম। মেয়েদের পর এখন ছেলেদের ফ্যাশন জগতেও টাইট জিন্সের ব্যবহার চলে এসেছে পুরোদমে। কিন্তু এই পোশাক অনেক রোগেরও কারণ বটে। টাইট বা স্কিনি জিন্স মেরালজিয়া প্যারেস্থেটিকা , কম্পার্টমেন্ট সিন্ড্রম ইত্যাদির কারণ। যদিও এসকল রোগের সম্ভাবনা খুবই কম কিন্তু শুরু থেকে প্রতিরোধ করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই প্রতিদিনকার পোশাকে টাইট জিন্স এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।
৪. মোবাইল ফোনে আসক্তি
ঘরে বাইরে সকলের হাতেই খুব পরিচিত এক ডিভাইস হলো মোবাইল ফোন। মোবাইলের ফোনের ব্যবহার এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যা এখন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নতুন এক রোগের নাম “টেক্সট নেক“, যার কারণ ক্রমাগত মোবাইলের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকা। নিচু হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে ঘাড়, কাঁধ এবং মেরুদণ্ডের উপরের দিকে ব্যথা শুরু হয়। আমরা কি জানি যে, বর্তমানে শিশুদের স্থুলতার কারণ এই মোবাইল ফোন? বিভিন্ন গেমসের নেশায় তারা সামাজিক কর্মকান্ড বা যেকোনো শারিরীক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে।
শুধু তাই নয়, এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথচারী রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মোবাইলের কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনার স্বীকার হন। বিপদে পড়েন গাড়ি চালকেরাও। কারণ মনোযোগ রাস্তায় না, মনোযোগ তখন টেনে নেয় মোবাইল ফোন।
তাই পরবর্তীতে মোবাইল ফোনটা হাতে নেওয়ার আগে একবার ভাবি প্রয়োজনটা কতটুকু।
৫. পায়ের ওপর পা তুলে বসা
পায়ের ওপর পা তুলে বসা কিংবা ইংরেজিতে ক্রসিং লেগস মহিলাদের সবচেয়ে পছন্দনীয় এবং উপযুক্ত। সুন্দরভাবে পায়ের ওপর পা তুলে বসাকে অনেকে নিয়ম হিসেবেও মেনে থাকেন। কিন্তু এই অভ্যাসটি বয়ে আনতে পারে অনেক ক্ষতি। কাঁধ ও ঘাড়ের ব্যথা থেকে শুরু করে উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবেও বসার এই অভ্যাসটিকে দায়ী করা যায়। তাছাড়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এভাবে বসার কারণে শরীরের বিভিন্ন শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই লম্বা সময়ের জন্য বসে না থেকে হাঁটাচলা করে শরীরকে আরাম দেওয়া উচিত।
৬. ফাস্ট ফুড বা তৈল জাতীয় খাবার
অনেক সময় ফাস্ট ফুডকে স্বাস্থ্যসম্মত বলে অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিও এই ধরণের খাবার খেয়ে থাকেন। কিন্তু যেকোনো ফাস্ট ফুড বা স্ট্রিট ফুড কখনোই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আমাদের যখন ক্ষুধা লাগে তখন আমাদের শরীর আমাদের জানান দেয় আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন। আর ক্ষুদার্থ অবস্থায় মোটামুটি সব খাদ্যই সুস্বাদু বলেই মনে হয়। তাই এই সময়টায় আমাদের খাওয়া উচিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য। তৈল জাতীয় বা যেকোনো ফাস্ট ফুড থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করি আজ থেকেই।
৭. পেটের ওপর ভর দিয়ে ঘুমানো
ঘুমানোর সময় আমাদের কারোরই জ্ঞান থাকে না কিভাবে শোয়া উচিত। কিন্তু ঘুমানোর পদ্ধতির ওপর শরীর স্বাস্থ্যের অনেকটাই নির্ভর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এক পাশে কাঁধের ওপর ভর করে ঘুমালে ঘাড়ে এবং কাঁধে ব্যথা হতে পারে। কেননা তখন শরীরের পুরো ভারটাই কাঁধের ওপর যাচ্ছে। অনেকে আবার পেটের ওপর ভার দিয়ে ঘুমাতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। এটা আরো বেশী ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। তাই শোয়ার সময় একটু সতর্ক হওয়া উচিত সকলেরই।
৮. রোদে ঘোরাফেরা
সূর্যের আলো একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি’ সরবারহ করে তেমনি পাশাপাশি ক্ষতিকর বেগুনী রশ্মিও নির্গমন করে। কিন্তু রোদের উপকারিতার তুলনায় হয়তো ক্ষতির পরিমাণটাই অধিক। Dr. Jacqueline Gerhart বলেছেন, সূর্য রশ্মি দেহের অনেক কোষ বিনষ্ট করে। এটি এককালীন কোনো প্রক্রিয়া না হওয়ায়, নতুন কোষে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা ক্যান্সারে রূপান্তর হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন রোদে যাওয়ার আগে সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করার কথা। প্রতি দুই ঘন্টায় একবার এই ক্রিম ব্যবহার করা উচিত।
৯. ঘুমের অভাব
বর্তমানে রাত জাগা যুবসমাজের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। ছোটবেলা থেকে মা বাবার কাছে আমরা সবাই শুনে আসছি পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা। যদিও তার প্রয়োজনীয়তা এখনো আমাদের কাছে জানা থাকলেও আমরা নিজের ক্ষতি করে যাচ্ছি সর্বক্ষণ। ঘুমের অভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। সেই সাথে ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ, মনোযোগ স্থাপনে অক্ষমতা এমনকি মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি স্তন ক্যান্সারের পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারে। একজন ব্যক্তির অন্তত দিনে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। এতে শরীর ও মন দুই ভাল থাকে।
১০. ব্যথার ঔষধ কিংবা ঘুমের ঔষধ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসার ঘটছে যত আমাদের সহ্য ক্ষমতা কমছে তত। আজকাল একটু মাথা ব্যথাতেই আমরা খেয়ে নেই দুই একটি ব্যথার ঔষধ। ঘুম আসছে না বলে খেয়ে নেই ঘুমের বড়ি এবং তা কোনো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই। আমাদের শরীর কতটুক নিতে সক্ষম তা না জেনেই আমরা নিজেরা নিজেদের ঔষধ গ্রহণ করি যা পরবর্তীতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ঘুমের ঔষধ এবং ব্যথার ঔষধ একত্রে সেবনকে অনেকে মাদকের সমমান বলে থাকেন। যা নেশায় পরিণত হতে সময় নেয় না খুব একটা। এসকল ঔষধ শরীরে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের বাসা বাঁধতে সাহায্য করে। নষ্ট করতে থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সকলের ঔষধ সেবন করা উচিত এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই কোনো।
সবশেষে, সুস্থ দেহে সুন্দর মনের বাস। তাই সুন্দর ভাবে বাঁচতে নিজেকে সুস্থ রাখি এবং সে সাথে কাছের মানুষদের সুস্থতার খেয়াল রাখি।