প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা আবিষ্কার, নানান উদ্ভাবন। কিন্তু ঠিক কতগুলোরই খবরই বা আমরা জানি কিংবা রাখি? কতগুলো প্রযুক্তি শুধু উদ্ভাবিত হয় কিন্তু প্রকাশিত হয় না, কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাথে সাথেই ছড়িয়ে যায় সর্বত্র, ছড়িয়ে দেয় এক নতুন মাত্রা, আর কিছু প্রযুক্তি হারিয়ে যায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে। তেমনি ২০১৭ সালও ছিল একটি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বছর, যে বছরে ঘটে গেছে নানান কিছু, হয়ে গেছে নানান উদ্ভাবন। সেই হাজারো উদ্ভাবনের মধ্য থেকে সেরা, তাক লাগানো ১০টি প্রযুক্তি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে MIT Technology Review যেখানে স্থান পেয়েছে মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা, সিকিউরিটি সিস্টেমকে আরো আধুনিক করা, নতুন প্রযুক্তিবান্ধব যান, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সৌর কোষ, জিন থেরাপি সহ আরও কিছু প্রযুক্তি। পর্ব ১ পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন। চলুন জেনে নেই সেই সব প্রযুক্তি সম্পর্কে।
৪. কোয়ান্টাম কম্পিউটার-এর বাস্তবিক প্রয়োগ
বিজ্ঞানভিত্তিক মুভি বা চলচ্চিত্র যারা দেখেন, তারা নিশ্চয়ই এমন কম্পিউটারের কথা শুনেছেন, যা এখনকার সুপার কম্পিউটারের চেয়েও অনেক গুণ বেশি দ্রুতগতির কিন্তু আকারে ছোট। অত্যন্ত দ্রুতগতির এই ধরনের কম্পিউটারই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হিসেবে পরিচিত। অনেক বছর ধরে চলা গবেষণার ফলাফলগুলোর মধ্যে যেগুলো এ বছর বাস্তবে রূপ নিয়েছে, তার মধ্যে এ ধরনের কম্পিউটার অন্যতম। মূলত কম্পিউটারের আকার ছোট রেখেই এর কর্মদক্ষতা আরও বাড়াতে এ ধরনের কম্পিউটারের উদ্ভাবন করা হচ্ছে।
সাধারণ কম্পিউটারের প্রসেসর কোটি কোটি ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। তবে আকার ছোট করতে গিয়ে সেই প্রসেসরের আকারও ছোট করতে হচ্ছে এবং ট্রানজিস্টরের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে একসময় এই ট্রানজিস্টরের আকার পরমাণুর সমান আকৃতির হয়ে যাবে। এদিকে ট্রানজিস্টর কাজ করে বাইনারি পদ্ধতিতে। অর্থাৎ ০ ও ১ দ্বারা কম্পিউটারে যেকোনো কাজের সংকেত পাঠানো হয়। আর প্রতিটি শূন্য বা এক-কে একটি বিট হিসেবে গণ্য করা হয়। এখন ট্রানজিস্টরের আকৃতি যদি পরমাণুর সমান হয়ে যায়, তবে সেখানে এই বিট সংকেত পাঠানোটা বেশ দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে বিটের বদলে ট্রানজিস্টরে ব্যবহার করা হবে কোয়ান্টাম বিট বা কিউ বিট। মূলত, পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করেই এই কোয়ান্টাম বিটের উদ্ভাবন করা হয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহৃত কোয়ান্টাম বিট একই সময়ে একাধিক বিট সংরক্ষণ করতে সক্ষম। এ বছর আইবিএম, গুগল, মাইক্রোসফট ও ইন্টেল-এর মতো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল কাঠামো উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
৫. সৌরকোষ প্রযুক্তি
সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার পদ্ধতির সঙ্গে প্রায় সবাই পরিচিত। শক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় অনেক শক্তিই আর মেটাতে পারছে না পৃথিবীর অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। তাই প্রতিনিয়তই মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে নতুন কোনো শক্তি/শক্তির উৎসের খোঁজ, যাকে তারা ব্যবহার করতে পারবে নিজ কাজে, খরচ পড়বে কম, পাওয়া যাবে অনেক শক্তি কিন্তু কম পরিশ্রমে। তেমনই এক শক্তির উৎস সূর্য যা থেকে আমরা পেতে পারি অফুরন্ত শক্তি, যাকে কাজে লাগাতে পারি বহুভাবে। সূর্যের রশ্মি থেকে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। তবে এই অ্যানালগ পদ্ধতিতে সৌরশক্তি সঞ্চয়ে একদিকে যেমন প্রয়োজন অনেক জায়গার, তেমনি অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতাও অনেকাংশে কম। তা ছাড়া এ পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুলও বটে। সেই সঙ্গে প্রতিকূল আবহাওয়ায় সৌরশক্তি সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ ধরনের নানা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি-এর একদল গবেষক ২০১৭ সালে আবিষ্কার করেছেন নতুন ধরনের সৌরশক্তি সংরক্ষণের ‘সোলার সেল’। নতুন এ সোলার সেল আগের চেয়ে অধিক পরিমাণে সৌরশক্তি সংরক্ষণ করতে সক্ষম, যাতে ব্যবহার করা হয়েছে উদ্ভাবনী প্রকৌশল ও উন্নত উপকরণ বিজ্ঞান। নতুন এ পদ্ধতিতে সূর্যের আলোক রশ্মিকে প্রথমে তাপে রূপান্তর করা হয়। এরপর সেটিকে আবার রশ্মিতে রূপান্তর করে বহুগুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন করা হয়। তবে আগের সোলার প্যানেলের চেয়ে আকৃতিতে ছোট হয়েও ৩০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম এই হট সোলার সেল। যদিও এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই এর প্রচলন শুরু হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
৬. ৩৬০ ডিগ্রি সেলফি
এক সময় ক্যামেরা ছিল যাতে মাত্র শখানেক ছবি তোলা যেত, তারপর নতুন ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন পড়তো আবার নতুন ফিল্ম। তারপরে একে একে সেই ক্যামেরাগুলোকে পেরিয়ে এলো ডিজিটাল ক্যামেরা। এরপর ক্যামেরায় লাগলো একের পর এক প্রযুক্তির ছোঁয়া। শুধু ছবি তোলা নয়, সুরক্ষার জন্যেও ব্যবহৃত হতে লাগলো এই ক্যামেরা। আর এর সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে এখনকার যুগে এসেছে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা, যা কিনা শুধু সামনে নয় দেখতে পারে পুরো ৩৬০ ডিগ্রিতে অর্থাৎ যাতে ছবি তোলার পরে আশেপাশের পরিবেশটাও দেখা যায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
আজ যে কেউ মাত্র ৫০০ ডলারেরও কম দামে একটি ৩৬০° ক্যামেরা কিনতে পারবেন, যা কিনা মিনিটের মধ্যে একটি ভিডিও রেকর্ড করতে সক্ষম এবং এই ভিডিওটিকে ফেসবুকে বা ইউটিউবে আপলোড করতেও পারবেন আপনি। নিউইয়র্ক টাইমস এবং রয়টার্সের সাংবাদিকরা হাইতির হারিকেনের জন্যে গাজার একটি শরনার্থী ক্যাম্পের তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন যার ছবি এবং ভিডিওগুলো তৈরি করতে ৩৫০ ডলার মূল্যের একটি স্যামসাং গিয়ার ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। ৩৬০° ফরম্যাটটি এতটাই গুরুত্ববহ হয়ে পড়েছে যে এটি সংবাদ ঘটনাগুলির ফুটেজের জন্য একটি নতুন মাত্রা-যোগ করেছে, এমনকি টুইটারও লাইভ ভিডিওর প্রতি উৎসাহিত হয়ে লাইভ ভিডিও ব্যবস্থাটি চালু করছে ‘পেরিস্কোপ’ নামক একটি অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে।
তাছাড়া শুধু ছবি তোলা কিংবা সুরক্ষার জন্য নয়, যেকোনো লাইভ প্রোগ্রামে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ক্যামেরাগুলো। কোনো লাইভ খেলা/ম্যাচেও ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যামেরাগুলো। যার প্রধান কারণ প্রযুক্তির উন্নতির কারণে ক্যামেরাগুলোর দারুণ পারফরমেন্স এবং সহজলভ্যতা। এসেছে ভিডিও এবং অডিও ধারণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন যা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে দর্শকের কাছে। দর্শক পাচ্ছে আগের তুলনায় দারুণ এবং ভিন্ন ধাঁচের ছবি ও ভিডিও, সাথে থাকছে মনমাতানো শব্দের খেলা।