সারাবিশ্বেই শিল্প কারখানা এবং বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য বেড়েই চলেছে। বাণিজ্যিক এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্রমেই পরিবেশের পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্টের কারণে জলবায়ু মোকাবিলা সারা বিশ্বের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাই ক্রমবর্ধমান শিল্প কারখানা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখন ভাবনার প্রধান বিষয় পরিবেশের সাথে টিকে থাকা এবং ব্যবসাকে পরিবেশ বান্ধব করা।
প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করার ফলে বৈশ্বিক আবহাওয়া হুমকির মুখে; Source: onyalife.com
তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া অর্থাৎ পরিবেশ যেন দূষিত না হয়, সেই কৌশলগুলো নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে। আপনার যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশের জন্য কতটুক ভূমিকা রাখতে পারে বা পরিবেশে আপনার প্রতিষ্ঠানের দ্বারা কোনো ক্ষতি হতে পারে কিনা, কার্যত এই বিষয়গুলো নিয়েই এখনকার সব উদ্যোক্তাদের ভাবা দরকার।
পরিবেশ বাঁচাতে সবাইকে গাছ লাগানো উচিত; Source: thenewdaily.com.au
কেননা আপনার প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রভাব যদি পরিবেশে পড়ে, তাহলে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান পুননির্মান হলে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে আপনার প্রতিষ্ঠানটি হুমকিস্বরূপ। আপনার ব্যবসায় যেন কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন না হয় এবং পরিবেশের উপর প্রভাব না পড়ে, এই বিষয়গুলো নিয়ে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস নিয়ে আজকের এই লিখা।
১. পুনর্ব্যবহার করার জন্য সিস্টেম উন্নত করা
আপনার প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই একটি পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল স্টেশন থাকতে হবে। আপনার প্রতিষ্ঠানের পণ্যের যেকোনো ধরনের মোড়ক বা লেবেল পুনর্ব্যবহার করার জন্য, অথবা পরিবেশের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব যেন না পড়ে। সেজন্য এই পুনর্ব্যবহার স্টেশনটি থাকা খুবই জরুরী। আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য অবশ্যই এমন কিছু কর্মচারী বা কর্মকর্তা দরকার, যারা পুনর্ব্যবহার স্টেশন পরিচালনায় দক্ষ।
২. কাজের শেষে প্রয়োজনীয় সকল ডিভাইসের বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ রাখা
এটি সকলের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রয়োজন শেষে অবশ্যই সকল ডিভাইসের বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ রাখতে হবে। যেমন কম্পিউটার বন্ধ করার পাশাপাশি কম্পিউটারের সুইচ অফ করা উচিত, মোবাইল ফোনের চার্জ সম্পন্ন হওয়ার পর চার্জার আনপ্লাগড করা উচিত, রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে লাইট, ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশনসহ খালি রুমের সমস্ত কিছুর সুইচ অফ করে দেওয়া উচিত, অথবা অটো টাইমার সেট করতে হবে।
পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল সিস্টেম রাখা প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; Source: independent.co.uk
এর বিকল্প হিসেবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। যেমন নির্দিষ্ট সময়ের পর তাদের অফিসের বা ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া। এতে করে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে।
৩. প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র ডিজিটালাইজডভাবে সংরক্ষণ করা
আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সকল নথিপত্র বা তথ্যগুলো সংগ্রহের জন্য কাগজপত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনুন। কাগজপত্রের অপচয় রোধ করার জন্য ডকুমেন্টগুলো ডিজিটালাইজড করতে পারেন। যেমন ডাটাবেজ সার্ভার অথবা বিভিন্ন ইমেইলের মাধ্যমে।
রুম ত্যাগ করার পূর্বে সমস্ত ইলেকট্রিক ডিভাইসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা উচিত; Source: patch.com
যদি আপনার প্রতিষ্ঠানে অনলাইন সুবিধা না থাকে, তাহলে কাগজ পত্রের ব্যবহার কমানোর জন্য কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় লেখা প্রিন্ট করতে পারেন এবং ফন্টের আকারগুলো ছোট করা যেতে পারে, যেন কালি এবং কাগজের অপচয় রোধ করা যায়। খুব সহজে যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য টেকসই কাগজ ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ।
৪. সকল ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস পুনর্ব্যবহার পদ্ধতি রাখা
ইলেকট্রনিক্স সকল ডিভাইস পুনর্ব্যবহার পদ্ধতি রাখা একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। এতে করে প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং ক্লায়েন্টদের কাছে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের পুরনো কম্পিউটার বা ভাঙা মনিটরের মতো বৈদ্যুতিক ডিভাইসগুলো পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তা আবার কাজে লাগাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৫. নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার কমানো
পরিবেশ দূষণ কমাতে কাজে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করা পরিহার করুন। কাজে যাওয়া আসার জন্য সর্বদা সাইকেল ব্যবহার করুন অথবা হাঁটার অভ্যাস করুন। যাদের বাসা থেকে কর্মস্থল দূরে, তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনা; Source: newshub.co.nz
আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন। প্রয়োজনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করার জন্য পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে কর্মীদের উৎসাহিত করুন। এতে করে গাড়ির ক্ষতিকারক অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ কম দূষিত হবে এবং আপনার শহর যানজট মুক্ত হবে।
৬. সবুজ গাছ লাগানো
আপনার প্রতিষ্ঠান বা অফিসে সবুজ গাছপালা লাগান। যদি ছোট অফিস হয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ছোট ছোট গাছ বা ফুলের টব রাখতে পারেন। এগুলো শুধু আপনার অফিসের সৌন্দর্য বাড়াবে তাই নয়, বরং বায়ুবাহিত দূষণগুলোকে সংশ্লেষণ করবে এবং বাতাসে অক্সিজেন নির্গত করবে। যা আপনার কর্মচারীদের স্বাস্থ্য ভালো রাখবে এবং মেজাজ ভীষণভাবে উৎফুল্ল রাখবে।
৭. প্রতিষ্ঠানে রান্নাঘরের সুবিধা রাখা
আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের খাবারের জন্য কিচেন বা রান্নাঘর সুবিধা রাখুন। অফিসেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার সুব্যবস্থা করুন। এতে করে কর্মী এবং কর্মকর্তারা বাহির থেকে প্লাস্টিকের বক্সযুক্ত খাবার কিনে আনবে না।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কিচেন ব্যবস্থা রাখা উচিত; Source: time.com
খাবারের সুবিধার কারণে প্লাস্টিকের বক্সযুক্ত খাবারগুলো প্রতিষ্ঠানে আসবে না, যা পরিবেশ দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও বাহিরের ক্ষতিকারক খাবারের জন্য শারীরিক যে সমস্যাগুলো হয়, তা প্রতিরোধ হবে।
৮. প্লাস্টিক পলিথিন বা প্লাস্টিক প্যাকিং পরিহার করা
পরিবহন বা বিতরণ কাজে প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের পরিমাণ হ্রাস করা শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য উপকার তা নয়, বরং আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমাবে। তাই যতটুকু সম্ভব প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনুন।
৯. প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পরিবেশের উপর যথাযথ শিক্ষা দেওয়া এবং তাদেরকে ক্ষমতায়ন করা
দিনশেষে আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই আপনার প্রতিষ্ঠানের সুনাম বা দুর্নামের কারন হবে। আর তাই আপনার কর্মীদেরকে সুশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করুন এবং তাদেরকে ক্ষমতায়ন করুন। পরিবেশের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখার জন্য তাদেরকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সেমিনার বা সচেতন করার মত কাজগুলো করতে হবে। তাহলেই কেবল তারা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুস্থ রাখতে এবং নিজেদের কাজে যত্নশীল হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
১০. প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা
আপনি শুধু আপনার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের কথাই ভাববেন, এমনটি করা উচিত নয়। বরং আপনার উচিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কাজ করে বা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশ নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে যুক্ত হওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষদেরকে সচেতন করা এবং পদ্ধতিগুলো শেয়ার করা।
Feature image source: percentotech.com